ঐতিহ্যের পথে ঘুরে দাঁড়াক মোহামেডান

১৯৮৬ সালে লিগ শিরোপা জয়ী মোহামেডান। ছবি: সংগৃহীত
১৯৮৬ সালে লিগ শিরোপা জয়ী মোহামেডান। ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব মানে এক ফুটবল নস্টালজিয়া। আনন্দ-বেদনার নানা স্মৃতি। সেই মোহামেডান পুনর্জন্মের ক্ষণ গুনছে। কেননা, গত সেপ্টেম্বরে মতিঝিল ক্লাবপাড়া মোহামেডানেও ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে হানা দেয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সবাই হতভম্ব হয়ে যান। মোহামেডানের মতো ঐতিহ্যবাহী একটি ক্লাবের নেতৃত্ব কীভাবে এমন কাজে জড়িত হয়, উত্তর খোঁজেন সবাই। এখনো তা নিয়ে নানা বিশ্লেষণ চলছে। 

ক্লাবটির যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৩৬ সালে। যে প্রতিশ্রুতি ছিল প্রতিষ্ঠার পেছনে, সেটি পূরণে সময় লাগেনি। ঢাকার ফুটবলে মোহামেডান প্রথম চ্যাম্পিয়ন হয় ১৯৫৭ সালে। ’৬৯, ’৬১, ’৬৩, ’৬৫, ’৬৬, ’৬৯ সালে চ্যাম্পিয়ন স্বাধীনতার আগে। তখন মোহামেডান-ওয়ান্ডারার্স ম্যাচ আকর্ষণের কেন্দ্রে থাকত। ইপিআইডিসি, ভিক্টোরিয়ার মতো দলগুলোর সঙ্গে টক্কর দিয়ে সাফল্য তখন পাওয়া সহজ ছিল না। তারপরও মোহামেডান দমে যায়নি, খেই হারায়নি। স্বাধীনতার পর শেখ কামাল প্রতিষ্ঠিত আবাহনী এসেছে। শুরু হলো আবাহনী-মোহামেডান ধুন্ধুমার লড়াই। ফুটবল ম্যাচ মানে মানুষের বড় বিনোদন। এভাবেই চলতে চলতে অবিশ্বাস্য এক কীর্তি গড়ে মোহামেডান। ১৯৮৫ সালের ৮ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৯০ সালের ১৫ মার্চ পর্যন্ত প্রথম বিভাগ লিগে অপরাজিত ছিল তারা! 

অবিশ্বাস্য লাগবে এই তথ্যে যে ১ হাজার ৬৫০ দিনে ঢাকার প্রথম বিভাগ লিগে টানা ৭৬টি ম্যাচ হারেনি মোহামেডান। ৬৩টি জয়, ১২টি ড্র ও ১টি পরিত্যক্ত। পক্ষে ১৬০টি গোল, ২২টি বিপক্ষে। এই সময় টানা তিনবার—১৯৮৬, ৮৮, ৮৯ লিগ চ্যাম্পিয়ন ঢাকা মোহামেডান। ১৯৮৯-৯০ মৌসুমের ইয়ংমেনস ফকিরাপুল ক্লাবের কাছে মোহামেডান ১-২ গোলে হেরে গেলে টানা ৭৭ ম্যাচ অপরাজিত থাকা যায়নি। দিনটি ছিল ১৯৯০ সালের ১৬ মার্চ। তার আগে মোহামেডানের সর্বশেষ পরাজয় ছিল ১৯৮৫ সালের ৭ সেপ্টেম্বর সুপার লিগে আরামবাগের কাছে। সেটিও ১-২ গোলে। ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যাচ্ছে, ষাটের দশকে পাকিস্তানের (মাকরানি) খেলোয়াড়পুষ্ট ভিক্টোরিয়া ঢাকার প্রথম বিভাগ ফুটবল লিগে টানা ৬৭টি ম্যাচ অপরাজিত ছিল। সেই রেকর্ড মোহামেডান ভেঙেছে। সূত্র; একটি অনন্য ইতিহাস, ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব বই। 

অথচ ২০০৭ সালে শুরু হওয়া পেশাদার যুগে গত ১১টি প্রিমিয়ার লিগে ৬০টির বেশি ম্যাচ হেরেছে মোহামেডান। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আবাহনীর হার ২৫টির মতো। সর্বশেষ গত প্রিমিয়ার লিগে ২৪ ম্যাচের মাত্র ৬টি জিতেছে মোহামেডান। ৭টি ড্র ও আর ১১টি হার। ১৩ দলে অবস্থান নবম। গত মৌসুমে ফেডারেশন ও স্বাধীনতা কাপ, দুটিরই গ্রুপ স্তর থেকে বিদায় নেয় সাদা-কালোরা। যা বেশ কয়েক বছর ধরেই যেন মামুলি ব্যাপার। অথচ দৃষ্টিটাকে পেছনে ফেরালে দেখা যায়, মোহামেডানের সোনালি এক অতীত মুগ্ধ করে দেবে। ১৯৯৬ পর্যন্ত মোহামেডান ১৬টি লিগ জেতে, ২০০২ সালে এসে সেটি দাঁড়ায় ১৮টি। অথচ ২০০২ সালের পর দেশের শীর্ষ ফুটবল লিগে মোহামেডান টানা ১৭ বছর শিরোপাহীন! ২০০৭ সালে পেশাদার ফুটবল লিগ শুরুর পর গত ১১টি লিগের নবম আসরে মোহামেডানের কানের পাশ দিয়ে গুলি যায়। অল্পের জন্য ২০১৫-১৬ মৌসুমে বেঁচে যায় অবনমন থেকে। ১১তম দলটি সেবার অবনমিত হয়েছিল। মোহামেডান ছিল দশম। 

সাদা-কালোর এমন পতনের কারণ, নিবেদিতপ্রাণ সংগঠক যেন ডুমুরের ফুল হয়ে গেছেন। ক্লাবের উন্নয়নে কাজ করার আন্তরিকতা হারিয়ে গেছে। সাদা-কালোর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা দুর্দিনের কান্ডারি মোহাম্মদ শাহজাহান, আবুল হাসনাত, এস এ মহসীন, আমির জং গজনবীর মতো বরেণ্য সংগঠক হারিয়ে গেছেন। ১৯৫৬ সাল থেকে মোহামেডানের উন্নয়ন আর এগিয়ে চলায় অকাতরে শ্রম দিয়েছেন শামসুল ইসলাম। টানা ১২ বছর ক্লাবটির ফুটবল সম্পাদক থাকা সবার ‘দুলাভাই’ বলতেন, ‘মোহামেডান আমার জানপ্রাণ।’ জীবনের পপিং ক্রিজে মোহামেডানের জন্য ব্যাট করে ৮৫ বছর বয়সেও বলেছিলেন, ‘মোহামেডানকে নিয়ে আমার প্রেমে কোনো খাদ ছিল না।’ 

আজ এমন সংগঠকের অভাবে মোহামেডান ধুঁকছে। ধুঁকতে ধুঁকতে ভয়ংকর এক দিক প্রকাশ্যে আসে গত সেপ্টেম্বরে, যার নাম ক্যাসিনো–কাণ্ড। মোহামেডানের মতো ক্লাবেও ক্যাসিনো বুকে শেল হয়ে বিঁধে অগুনতি ফুটবল সমর্থকের বুকে। মোহামেডান অন্তঃপ্রাণ সাবেক ফুটবলার ও সংগঠকেরা হাহাকার করেন। তাঁরা ছুটে আসেন ক্লাবে। আবার ক্লাবটাকে দাঁড় করানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এখন মনে হচ্ছে, ক্যাসিনোর ঘটনা শাপেবর হয়েছে মোহামেডানের জন্য। ক্লাবটির প্রায় দুই যুগের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা লোকমান হোসেন ভূঁইয়া জেলে আছেন। ৮ বছর পর পরিচালনা কমিটির নির্বাচন ২০ জানুয়ারির মধ্যে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা শোনা গিয়েছিল। এই সময়সীমা শেষ পর্যন্ত রক্ষা করা যাবে কি না, তা এখনো পরিষ্কার নয়। তবে আগে-পিছে যখনই হোক, সে নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন নেতৃত্ব ক্লাবটাকে এগিয়ে নেবে, সমর্থকদের এটিই মনের কথা। 

মোহামেডান জেগে উঠলে দেশের ফুটবলের জন্যই ভালো। আবাহনী-মোহামেডান দ্বৈরথ আবার জমবে। আবার সারা দেশে পতাকা উড়বে দুই প্রধানের। স্বাধীনতার পর এই আবাহনী-মোহামেডান দ্বৈরথ পঙ্গপালের মতো ঢাকা স্টেডিয়ামে দর্শক টেনে আনত। সেসব আজ হারিয়ে গেল। সমর্থকেরা ঢাকঢোল নিয়ে ক্লাবে ভিড় করার উপলক্ষ পান না। এই মোহামেডান মাথা নিচু হয়ে ক্লাবে ফেরা এক দল, যারা সমর্থকদের বুকের হাহাকার বাড়িয়ে চলে। এক দশকের বেশি সময় মোহামেডানে দেশের শীর্ষ ফুটবলারদের দেখা যায় না। অখ্যাতদের নিয়ে অল্প টাকায় কোনোমতে একটা দল গড়ে। সেই দল যেন পেছনের বেঞ্চের ছাত্র, গভীর সমুদ্রে খড়কুটো ধরে বেঁচে থাকা মানুষের মতো। 

ক্যাসিনো-ঝাপটা শেষে মোহামেডান ভালো ফুটবলার পায়নি। আগামী মৌসুমে আগেই ভালো দল গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ক্লাবটির সাবেক অধিনায়ক বাদল রায়সহ অন্যরা। সেই পঞ্চাশের দশক থেকে মোহামেডানে খেলা জহিরুল হক, জাকারিয়া পিন্টুরাও চান ভালো কিছু হোক। ষাটের দশকে সাদা-কালো জার্সি গায়ে তোলা প্রতাপ শংকর হাজরা, মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন, গোলাম সারোয়ার টিপুরা তাকিয়ে আছেন সামনে। আশির দশকে মাঠ মাতানো ইমতিয়াজ সুলতান জনি, কায়সার হামিদ, সৈয়দ রুম্মন বিন ওয়ালী সাব্বিরসহ সাবেকেরা চান মোহামেডানকে টেনে তুলতে। সবারই অভিন্ন লক্ষ্য, ঐতিহ্যের পথে ফিরে আসুক মোহামেডান। 

সেই স্বপ্ন নিয়ে গত ১৯ নভেম্বর মোহামেডান ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন ভবনে খেলোয়াড়দের নাম নিবন্ধন করে। ষাট-সত্তর দশকের সাদা-কালো জার্সি গায়ে আসেন কয়েকজন সাবেক তারকা। সেই জার্সি ফিরিয়ে আনা হচ্ছে। মোহামেডান চাইছে ঐতিহ্যের সরণিতে আবার পা রাখতে। ক্লাবকে টাকা কামাইয়ের হাতিয়ার হিসেবে নয়, পবিত্র স্থানের মতো দেখলেই মোহামেডান ফিরে আসবে মোহামেডানের মতো। মোহামেডান অন্তঃপ্রাণ মানুষেরা অপেক্ষায় আছে সেই দিনের জন্য। 

মাসুদ আলম প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি
masud.alam@prothomalo.com