ঐক্যফ্রন্টের ইশতেহার: রাষ্ট্র মেরামতে ফাঁকি

প্রথম আলো ফাইল ছবি
প্রথম আলো ফাইল ছবি
বাংলাদেশের বর্তমানের যে সংকট, তা শাসনতান্ত্রিক বা সাংবিধানিক সংকট। বাংলাদেশের সংবিধানের পুরো ক্ষমতাকাঠামোই এক দল না শুধু, এক ব্যক্তির কর্তৃত্বে। এর মূলে মেরামত করতে হবে, ওপর থেকে পানি ঢেলে সমাধান হবে না। লিখেছেন রাখাল রাহা

গত ১৭ ডিসেম্বর জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করা হয়েছে। এই ইশতেহারে ‘তারুণ্যের ইশতেহার ভাবনা’ থেকে হুবহু অনেক দাবি গ্রহণ করা হয়েছে, এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি রাষ্ট্রচিন্তা ফোরামের রাষ্ট্রনৈতিক কর্মসূচি, কোটা সংস্কার আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, তেল-গ্যাস-জ্বালানি কমিটির প্রস্তাব, শিক্ষা ও শিশু রক্ষা আন্দোলন, হাওর ও জলমহাল আন্দোলন, নিরাপদ খাদ্য আন্দোলন, ন্যূনতম মজুরি আন্দোলন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতাসহ আরও কিছু অধিকার আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বেশ কিছু দাবিকে বিবেচনা করা হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এটা তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা।

ইশতেহারের ৩৫টি অধ্যায়ে অনেক জনপ্রিয় অঙ্গীকার করা হয়েছে, যেগুলো ‘করা গেলে’ দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতির অনেকখানি গুণগত পরিবর্তন হতে পারে। কিন্তু এগুলো করতে হলে ক্ষমতাকাঠামোর যেখানে যেখানে পরিবর্তনের প্রয়োজন, সেখানে সুনির্দিষ্টভাবে কথা বলতে ঐক্যফ্রন্টের ইশতেহার অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে।

১. যেমন বলা হচ্ছে: ‘প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার ভারসাম্য আনা হবে। মন্ত্রিসভাসহ প্রধানমন্ত্রীকে সংসদের কাছে দায়বদ্ধ থাকার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা নিশ্চিত করা হবে। পরপর দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী থাকা যাবে না। (চতুর্থ অধ্যায়: ক্ষমতার ভারসাম্য নিশ্চিতকরণ)’

কিন্তু ভারসাম্য মানে শুধু প্রধানমন্ত্রী আর রাষ্ট্রপতির বিষয় নয়। ভারসাম্য মানে ক্ষমতাকাঠামোর ভারসাম্য বা চেক অ্যান্ড ব্যালান্স। এই বিষয়কে বহুদিন ধরে আড়াল করে এটাকে যে শুধু রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর দ্বন্দ্বে নিয়ে যাওয়া হয়, ঐক্যফ্রন্টের ইশতেহার তার ব্যতিক্রম কিছু নয়। আর ভারসাম্য আনা হবে কীভাবে? যেমনভাবে এই ইশতেহারের চতুর্থ অধ্যায়েই বলা হয়েছে, ‘সংবিধানের ১১৫ ও ১১৬ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে নিম্ন আদালতকে পুরোপুরি সুপ্রিম কোর্টের অধীনে আনা হবে।’ কিন্তু ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য সংবিধানের কোন কোন অনুচ্ছেদ সংশোধন করা হবে, তা সুনির্দিষ্ট করে কিছুই বলা হয়নি।

দ্বিতীয়ত, পরপর দুই মেয়াদ প্রধানমন্ত্রী মানে কী? ধরা যাক, বেগম খালেদা জিয়া ১৯৯১ সালে এবং ২০০১ সালে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তিনি তো পরপর দুই মেয়াদ ছিলেন না। সুতরাং কোনো দল পরপর তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় না এলে যে–কারও পরেরবার আবার জয়ী হয়ে প্রধানমন্ত্রী থাকার সুযোগ অবারিতই থাকছে। তা ছাড়া এক মেয়াদের মধ্যেই একই দল থেকে ছয় মাসের জন্য প্রধানমন্ত্রিত্বকে হাত বদল করিয়ে আবার নিজের কাছে ক্ষমতা ফিরিয়ে আনার সুযোগও থাকছে। ‘কোনো ব্যক্তি দুবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না’ আর ‘পরপর দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী থাকা যাবে না’—এ দুটো এক কথা নয়।

২. বলা হচ্ছে: ‘একদলীয় শাসনের যেন পুনর্জন্ম না ঘটে, তা নিশ্চিত করা হবে।’ (প্রথম অধ্যায়: প্রতিহিংসা বা জিঘাংসা নয়, জাতীয় ঐক্যই লক্ষ্য)

এটা কেমন করে করা সম্ভব হবে? বাংলাদেশের সংবিধানের পুরো ক্ষমতাকাঠামোই এক দল না শুধু, এক ব্যক্তির কর্তৃত্বে। ইশতেহার অনুযায়ী শুধু ৭০ অনুচ্ছেদের একটুখানি সংশোধন এই কাঠামোর মধ্যে খুব বেশি প্রভাব ফেলতে পারবে না, যদি গোটা সংবিধানের ক্ষমতাকাঠামো অংশের প্রয়োজনীয় সংশোধন করা না হয়। আর এই পরিমাণ সংশোধনের জন্য সরকার পরিবর্তনের নির্বাচন নয়, প্রয়োজন গণপরিষদ নির্বাচন।

গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, এই ইশতেহারে দলীয় প্রধানের সরকারপ্রধান হওয়ার ক্ষেত্রে যে বিধান, তা নিয়ে কিছু বলা হয়নি। আর আমাদের সবারই জানা যে বাংলাদেশের সব কটি দলের কাঠামো হচ্ছে ব্যক্তি বা বড়জোর পরিবারকেন্দ্রিক। ব্যক্তির মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত কিংবা দল ভেঙে আরেকটা দল না বানানো পর্যন্ত সেখানে কোনো পরিবর্তন হয় না। দলীয় প্রধান দলে যে একচ্ছত্র ক্ষমতা ভোগ করেন, দল ক্ষমতায় গেলে সরকারে গিয়েও তিনি সেই ক্ষমতাই একচ্ছত্রভাবে ভোগ করতে চান। সুতরাং একদলীয় শাসনের সূত্র যেখানে অনেকখানিই রয়েছে দলীয় প্রধানের সরকারপ্রধান হওয়ার মধ্যে, সেখানে এ বিষয়ে কিছু না বলে ‘একদলীয় শাসনের যেন পুনর্জন্ম না ঘটে, তা নিশ্চিত করা হবে’—এটা বলা অনেকখানি অর্থহীন।

৩. বলা হচ্ছে: ‘সাংবিধানিক পদে নিয়োগের জন্য সুস্পষ্ট আইন তৈরি করা হবে। ...সব সাংবিধানিক পদে নিয়োগের জন্য...স্বাধীন কমিশন গঠন করা হবে। ...কমিশন কর্তৃক প্রাথমিক মনোনয়নের পর নিয়োগের পূর্বে তাদের নাম জনগণের মতামতের জন্য প্রচার করা হবে।’ (চতুর্থ অধ্যায়: ক্ষমতার ভারসাম্য নিশ্চিতকরণ)

এখানে খেয়াল করার মতো বিষয় হচ্ছে, ধরে নেওয়া হচ্ছে ব্যক্তিই মূল, ব্যবস্থা নয়। ভালো ব্যক্তি সবাই মিলে ঠিক করে দায়িত্ব দিলেই সে ভালো ফল দিতে থাকবে। এটা যে দেয় না, তার উৎকৃষ্ট নজির ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচন এবং সেই একই নির্বাচন কমিশনের অধীনে হওয়া মাগুরার উপনির্বাচন। সাংবিধানিক পদগুলোর স্বাধীন ও স্বনির্ভর হওয়ার ক্ষেত্রে যে সাংবিধানিক বাধা রয়েছে, অর্থাৎ এদের ওপর সরকারের কর্তৃত্ব করার যে বিধান সংবিধানে রয়েছে, সেগুলোর কী করা হবে, এ নিয়ে ইশতেহারে কোনো কথা নেই।

৪. সংসদ কার্যকর করে তোলার জন্য বিরোধী দলকে সংসদীয় স্থায়ী কমিটির পদ দেওয়া, ডেপুটি স্পিকার করাসহ ‘বিরোধী দলের মতকে যথাযথ গুরুত্ব’ দেওয়ার মতো বায়বীয় নানা কথা রয়েছে। কিন্তু একটি কথাও নেই সংসদীয় কার্যপ্রণালি বিধি নিয়ে, যেখানে সংসদকে সরকারি দল, মানে প্রধানমন্ত্রীর একচ্ছত্র কর্তৃত্বে রাখার সব বন্দোবস্ত রাখা আছে।

৫. বলা হচ্ছে: ‘...খবরদারি নয়, সংসদ সদস্যরা স্থানীয় উন্নয়নে স্থানীয় সরকারের সঙ্গে সহায়তামূলক ভূমিকা পালন করবেন।’ (চতুর্থ অধ্যায়: ক্ষমতার ভারসাম্য নিশ্চিতকরণ)। সহায়তার মানে কী? উন্নয়ন বরাদ্দ বিলিবণ্টনে কর্তৃত্ব কে করবে? সেখানে যে একচ্ছত্র কর্তৃত্ব, তার অবসানে কী করা হবে, এ নিয়ে ইশতেহারে কিছু নেই।

৬. নির্বাচন ও নির্বাচন কমিশন নিয়ে দ্বিতীয় অধ্যায়ে যে কিছু অঙ্গীকার করা হয়েছে, তার মূল কথা হচ্ছে: ‘সকল অংশীজনের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে নির্বাচনকালীন সরকারের বিধান তৈরি করা হবে।’, ‘নির্বাচন কমিশনকে পূর্ণাঙ্গ ক্ষমতা দেওয়া হবে’, ‘সরকারের প্রভাবমুক্ত থাকবে’, ‘তার স্বাধীন বাজেট থাকবে’, ‘নির্বাচনে পেশিশক্তি, কালোটাকা ও গণমাধ্যমের অপব্যবহার রোধ করার জন্য সর্বোচ্চ পদক্ষেপ নেওয়া হবে’ ইত্যাদি। কিন্তু বর্তমান সংবিধান অনুযায়ীই প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সব মন্ত্রী ও সাংসদ যে ইচ্ছা করলে মেয়াদ শেষ হওয়া পর্যন্ত, এমনকি পরবর্তী সরকারের শপথ নেওয়ার আগ পর্যন্ত নিজ নিজ দায়িত্বে থাকতে পারেন, সেগুলোর কী করা হবে, এ বিষয়ে ইশতেহারে কিছু বলা হয়নি। প্রকৃতপক্ষে বাহাত্তর সালে সংবিধান প্রবর্তনের পর থেকে আজ পর্যন্ত কোনো নির্বাচনই দলীয় সরকারের অধীনে কেন গ্রহণযোগ্যভাবে করা যায় না, তার এত বড় ভুক্তভোগী হয়েও এই জোটের দলগুলোর বিষয়টাকে এড়িয়ে যাওয়া রহস্যজনক।

পরিশেষে যেটা বলতে হবে, বাংলাদেশে যখনই ক্ষমতাকাঠামোর গুণগত পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা মানুষের মনে দানা বেঁধে ওঠে, যখনই সে ক্ষমতার ওপর তার নিয়ন্ত্রণের প্রশ্ন সামনে আনে, তখনই কৌশলে সেই জন-আকাঙ্ক্ষাকে জনপ্রিয় কিছু দাবির মোহে ফেলে মানুষের দৃষ্টিকে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়। নিকট অতীতের এ রকম দুর্ভাগ্যজনক একটা দৃষ্টান্ত হচ্ছে ১৯৯০ সালের গণ-আন্দোলন। আমাদের খুবই স্পষ্টভাবে বলতে হবে, বাংলাদেশের বর্তমানের যে সংকট, তা শাসনতান্ত্রিক বা সাংবিধানিক সংকট। আর উপনিবেশ আমলে প্রজাশাসন ও সম্পদ লুণ্ঠনের জন্য ঔপনিবেশিক শাসকেরা যে আইনকানুন বানিয়েছিলেন, সেগুলোই স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রেও সাংবিধানিকভাবে রেখে দেওয়া হয়েছে এবং ক্ষেত্রবিশেষে তা আরও জনবিরোধী করা হয়েছে। আমাদের বলতে হবে, আমরা যদি এই রাষ্ট্রকে মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারভিত্তিক রাষ্ট্র’ গঠনের দিকে নিয়ে যেতে চাই, তাহলে এর মূলে মেরামত করতে হবে, ওপর থেকে পানি ঢেলে সমাধান হবে না।

রাখাল রাহা: গল্পকার। আহ্বায়ক, শিক্ষা ও শিশু রক্ষা আন্দোলন (শিশির)।