আজ সক্কালবেলা ঘুম থেকে উঠেই দেখি আকাশ গোমড়া। ধূসর মেঘে ঢাকা। ৩০ ফাল্গুন আকাশটা ধূসর মেঘে ঢেকে থাকার দিন নয়। এখন ভরা বসন্ত। ফাগুনের গান শেষে চৈতি রাগে ঝাঁজালো ঘ্রাণ নেওয়ার সময়। সকালের আকাশে থাকবে চনমনে রোদ, যে রোদে থাকবে তারুণ্যর তাজা সৌরভ। ঘরের ঘুলঘুলি দিয়ে ছায়াছবির প্রজেক্টরের রশ্মির মতো ঘরে ঢুকবে এই রবির আলো। কানে কানে শোনাবে নবজীবনের কাব্য। অথচ এসব ফুঁ।
পরশু সন্ধ্যায় ঘণ্টাখানেক হেঁটেছি। রাস্তা শুকনো ছিল। এলো হাওয়ায় ধুলো উড়েছে বটে, বৃষ্টির আভাস পাইনি। মাঝরাতে হঠাৎ জেগে উঠে দেখি ঝুম বৃষ্টি! শ্রাবণের রাতে যে বৃষ্টি খুব মানায়। আষাঢ় বা বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ হলেও নাহয় মেনে নিতাম। ভরা বসন্তের এই উড়ুক্কু ফাল্গুনে কেন? এ সময় মেঘ থাকবে উড়ুউড়ু, হালকা কাশফুলের মতো হাওয়ায় ভাসবে। বৃষ্টির নামও নেবে না। বৃষ্টিভেজা ফাগুন আমাদের অচেনা। ফাল্গুন নিয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন—‘ফাল্গুনে বিকশিত/ কাঞ্চন ফুল, ডালে ডালে পুঞ্জিত/ আম্রমুকুল।’
ফাল্গুনকে আমরা ফুল দিয়ে চিনি, গাছে গাছে পল্লবিত কিশলয় দিয়ে চিনি, আম আর জামের মুকুল, কাঁঠালের মুচি, লিচুর ফুল দিয়ে চিনি। আর চিনি কোকিলের কুহু গানে। উদাস হাওয়া বইবে, রাস্তায় বেরোলেই নাক–মুখে সুড়সুড়ি দেবে ঈষদুষ্ণ আউলা বাতাস, মৃদু লহরির মতো খুদে ঘূর্ণি শুকনো পাতার নূপুর বাজাবে, মিহি ধূলিকণায় থাকবে ঝাঁজালো আমেজ—এই নাহলে ফাল্গুন!
সারাটা মাস তো গেলই, এই বিদায়বেলায়ও ফাল্গুনে সেই চিরচেনা ফাল্গুনি আমেজ নেই। ফাল্গুন এলে সপ্তাহখানেক পরই শীত পালাতে শুরু করে। লেপ-কাঁথা আবার গিয়ে বাক্স-পেটরায় সেঁধোয়। কিন্তু এ মৌসুমে এখনো অনেক বাড়িতেই গরমের পোশাক আলমারি বা ওয়ার্ডরোবের নিভৃত কোটরে থিতু হতে পারেনি। দফায় দফায় বৃষ্টি আর শীত এক অচেনা ফাল্গুনকে ডেকে এনেছে। দেখা গেছে, নিম্নচাপে সাগর অশান্ত, বন্দরে সতর্কতা সংকেত, আর দেশজুড়ে গুঁড়ি গুঁড়ি বা ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। রাস্তাঘাট কাদায় প্যাঁচপ্যাঁচ। এরই মধ্যে আভাস পাওয়া গেছে, এবারও বৃষ্টির মৌসুমে জলাবদ্ধতায় ডুবে থাকবে রাস্তাঘাট, ভুগবে নগরবাসী।
আমাদের ভালো থাকা ও সুস্থ থাকার ক্ষেত্রে আবহাওয়া একটি বড় বিষয়। ঠান্ডায় কাবু যাঁরা, শীতকালে ভালো থাকেন না। গরমে কাহিল মানুষের জন্য গ্রীষ্মটাও হয় দুর্ভোগের। এরপরও কোনো মাস বা ঋতু তার চিরায়ত বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী আচরণ করলে সতর্ক থাকা যায়। প্রস্তুতি নিয়ে যতটা সম্ভব ভালো থাকা যায়। কিন্তু এবারের ফাল্গুনের মতো অন্য সব মাসও যদি অচেনা অভাজনের মতো আচরণ করে, তাহলে স্বাভাবিক বা ভালো থাকা দায়।
ভালো অবশ্য এমনিতেও থাকার জো নেই। প্রকৃতি ও পরিবেশ আর আমাদের অনুকূলে নেই। গত ১৮ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোয় প্রকাশিত ‘সবচেয়ে দূষিত বায়ুতে বাংলাদেশ দ্বিতীয়’ শীর্ষক খবরে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের পরিবেশ সংরক্ষণবিষয়ক সংস্থা ইপিএর সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী বিশ্বে সবচেয়ে দূষিত বায়ুর দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। এর আগে ২০১৭ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি একই পত্রিকায় প্রকাশিত একটি খবরের শিরোনাম ছিল ‘বিশ্বে বায়ুদূষণে দ্বিতীয় ঢাকা’।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও শিল্পায়নের কারণে বায়ু দূষিত হচ্ছে। রাজধানীতে প্রচুর নির্মাণের কাজ হচ্ছে, যা ধুলা তৈরি করছে। ঢাকার চারপাশে রয়েছে প্রায় পাঁচ হাজার ইটভাটা। প্রতিদিন দেদার ইট পোড়ানোয় প্রচুর পরিমাণে কালো ধোঁয়া নির্গত হচ্ছে। ঢাকার ভেতর রয়েছে বেশ কিছু পোশাক কারখানা এবং অন্যান্য শিল্পকারখানা। এসব কারখানায় উৎপাদন চলাকালে যে ধোঁয়া ও বর্জ্য নির্গত হয়, তা থেকে পরিবেশদূষণ কম হয় না। আর যানজটের শহর ঢাকায় যানবাহনের কালো ধোঁয়ার ক্ষতিকর প্রভাব তো আছেই। গাড়ি থেকে কালো ধোঁয়া নির্গত হওয়ার বিষয়টি এখনো নিয়মিতভাবে পরীক্ষা করা হয় না। ভ্রাম্যমাণ আদালতের তৎপরতা আছে, ধারাবাহিকতা নেই। কলকারখানা ও যানবাহনের কালো ধোঁয়া থেকে ক্ষতিকর কার্বন কণা বাতাসে মিশে ঘটাচ্ছে বায়ুদূষণ। এই স্বাস্থ্যঝুঁকি থেকে পরিত্রাণের উপায় কী?
সম্প্রতি হেলথ অ্যালার্ট জারি করার সুপারিশ করেছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি। কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী সংবাদমাধ্যমে বলেন, বায়ুদূষণের মাত্রা ৩০০–এর বেশি হলেই সেটা বিপজ্জনক। আমরা দেখেছি, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ শহরে এই মাত্রা ৪০০–এর ওপরে উঠেছিল। এই মাত্রা জনস্বাস্থ্যের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।
কিন্তু এই এ ব্যাপারে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেই। এ নিয়ে হাইকোর্ট পর্যন্ত হতাশ। আজ প্রথম আলোতে প্রকাশিত ‘বায়ুদূষণ রোধে নেওয়া পদক্ষেপে হতাশ হাইকোর্ট’ শীর্ষক খবরে এ তথ্য জানা যায়। রাজধানীর বায়ুদূষণ রোধে নেওয়া পদক্ষেপ সম্পর্কে হাইকোর্ট বলেছেন, ‘বায়ুদূষণ রোধে নেওয়া পদক্ষেপ আমাদের হতাশ করেছে।।’ গতকাল এক শুনানিকালে আদালত বলেন, ‘মেট্রোরেল ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ যেসব এলাকায় চলছে, সেসব এলাকায় প্রচণ্ড বায়ুদূষণের পাশাপাশি পরিবেশদূষণ ঘটছে। আমাদের মেট্রোরেলও প্রয়োজন। একই সঙ্গে বায়ুদূষণ রোধ করাও জরুরি। আমাদের সন্তানদের রক্ষা করতে হবে। এসব (বায়ুদূষণ) বন্ধ করতে হবে।’
কিন্তু বন্ধ করতে চাইলেই কি তা খুব সহজে করা যায়? যেসব যানবাহন কালো ধোঁয়ার উৎস, দেখা যায় বেশির ভাগই তা বিত্তশালী বা প্রভাবশালী কোনো ব্যক্তির মালিকানাধীন। কাজেই এখানে ব্যবস্থা নেওয়াটা অনেক ক্ষেত্রেই কঠিন। আর আইন না মানার বা পরিবেশ–সহায়ক না থাকার নেতিবাচক মানসিকতা এ ক্ষেত্রে বড় বাধা। ঢাকার ভেতর যেসব কলকারখানা রয়েছে, কেমিক্যাল ফ্যাক্টরি রয়েছে, সেগুলো একবারে সম্ভব না হলেও পর্যায়ক্রমে অন্য কোথাও, উপযুক্ত পরিবেশে স্থানান্তর করতে হবে। এ নিয়ে বসে থাকলে হবে না। উদ্যোগটা নেওয়া জরুরি। একই সঙ্গে ঢাকার নাকের ডগায় বিষফোড়া হয়ে থাকা হাজারো ইটভাটার বিষয়েও খুব গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে। হয় ইটভাটার সংখ্যা সীমিত করতে হবে, অন্যথায় এসব ভাটায় ইট পোড়াতে পরিবেশবান্ধব জ্বালানি ব্যবহারের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। এ নিয়ে বসে থাকার উপায় নেই। পদক্ষেপ নেওয়াটা এখনই জরুরি। নইলে পরিবেশ বদলাতে বদলাতে এমন এক বিরূপ নগর নিয়ে আসবে, যখন এই শহরে ফাগুন বলে আর কিছুই থাকবে না। দিল্লি বা চীনের সাংহাইয়ের চেয়েও কঠিন ধোঁয়াশার আচ্ছাদন ঢেকে রাখবে ঢাকার আকাশ। আর আমরা এই অসহায় নগরবাসী বুড়িগঙ্গার কালো জলে ডুবে থাকা মাছের মতো অচ্ছুত এক জীবন কাটাব।
শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক
sharifrari@gmail.com