অন্ততপক্ষে সোভিয়েত ইউনিয়নের পরের রাজনৈতিক দুনিয়ায় আমেরিকান নীতির বাইরে নিজস্ব নীতি বাস্তবায়নের প্রথা, প্রচেষ্টার খোঁজাখুঁজি অনেকাংশে বৃথা। বৈশ্বিক নিরাপত্তার এই ‘জি হুজুর’ বৈধতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে রাশিয়ায় তৈরি অত্যাধুনিক এস ৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থার প্রথম চালান এখন আঙ্কারায়। এই প্রথম ন্যাটোর আকাশসীমায় রাশিয়ার উপস্থিতি নিশ্চিত হলো। ন্যাটোর আকাশ প্রতিরক্ষাব্যূহের সঙ্গে রাশিয়ার তৈরি প্রথম কোনো যুদ্ধ সরঞ্জামের সহাবস্থান ঘটল। আর তা ঘটল ন্যাটোভুক্ত দেশ তুরস্কে।
পরিণামে তুরস্কের অর্থনীতিসহ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতায় কাঠামোগত পরিবর্তন ঘটতে পারে। মার্কিন কংগ্রেসের হুমকি আর চোখ রাঙানি ও ওয়াশিংটনের কর্তাদের অবিরাম নিষেধাজ্ঞার ধমক আঙ্কারার অনড় অবস্থান বদলানোর জন্য অপর্যাপ্তই। তবে এই অবস্থা আঙ্কারা ও ওয়াশিংটনের দীর্ঘদিনের বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের নিরন্তর পরিবর্তিত ছবি।
তুরস্কের এই সিদ্ধান্তের পেছনে আছে দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার প্রচ্ছন্ন হুমকি, আছে ন্যাটো থেকে বের করে দেওয়ার সমস্ত আয়োজন, অর্থনীতিকে ধুলায় মিশয়ে দেওয়ার হুমকি। তবে সবচেয়ে বড় হুমকি ছিল নতুন প্রজন্মের যুদ্ধবিমান এফ ৩৫ প্রকল্প থেকে তুরস্কের বহিষ্কার। প্রায় দেড় দশকের পুরোনো অত্যাধুনিক নতুন প্রজন্মের যুদ্ধবিমান তৈরির এই প্রকল্পে আঙ্কারা প্রায় এক ডজন দেশের সঙ্গে ভাগীদার। এই যুদ্ধবিমানের অনেক যন্ত্রাংশ তৈরি হয়েছে তুরস্কেই। প্রকল্প থেকে এক শর ও বেশি এফ ৩৫ যুদ্ধবিমান কেনার জন্যও প্রায় সতেরো শ কোটি টাকা পরিশোধ করে গত বছর প্রথম চালান গ্রহণ করে আঙ্কারা। কিন্তু গত ৭ জুন পেন্টাগন আঙ্কারাকে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দেয় যে তারা আর এফ ৩৫ বিমানের কলকবজা তুরস্কে উৎপাদন করবে না এবং তুর্কি পাইলটদের এফ ৩৫ এর চালনার জন্য সব ধরনের প্রশিক্ষণ ব্যবস্থার ইতি টানবে। যদি না আঙ্কারা এস ৪০০ কেনা থেকে বিরত না থাকে।
ওয়াশিংটনের কর্তাদের কোনো কিছুই আঙ্কারাকে থামায়নি। কারণ পারস্পরিক নির্ভরতার অভাব। আঙ্কারা সিরীয়যুদ্ধে আন্তর্জাতিকভাবে ঘোষিত ‘সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর’ সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে পাশ্চাত্য শক্তির মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক মানচিত্রে পরিবর্তনের আয়োজন কোনোভাবেই মেনে নেয়নি। আর পাশ্চাত্য আঙ্কারাকে দুষছে রাশিয়ামুখী হওয়ার প্রবণতার জন্য। এই টালমাটাল অবস্থার মধ্যে ২০১৬ সেনা–অভ্যুত্থানে পরোক্ষ সম্মতি ও অভ্যুত্থান–পরবর্তী পাশ্চাত্যের দ্বিমুখী আচরণের পর আঙ্কারার আস্থা আর বিশ্বাস হারায় ন্যাটো আর ওয়াশিংটন। এই অবিশ্বাস আরও মজবুত হয় অভ্যুত্থান–পরবর্তী তুরস্কের অর্থনীতির টুঁটি চেপে ধরার চিরচেনা পাশ্চাত্য প্রবণতায়। যার কোপানলে পড়ে দিশেহারা অর্থনীতির দুরবস্থা এরদোয়ানবিরোধীদের সাম্প্রতিককালের নির্বাচন জিতিয়েছে। সবকিছু ছাপিয়ে এস ৪০০ কেনার খেসারত অর্থনীতির ওপর মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা যে হবে তা সুনিশ্চিত। তবে এই দুর্দশায় তুরস্কের সাধারণ মানুষের আশার আলো পেন্টাগন এবং হোয়াইট হাউসের মধ্যকার মতভেদ যা এখন পর্যন্ত নির্দিষ্ট অবয়বে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার পরিণাম ও পরিধি কী হবে তা পরিষ্কার করতে দেইনি। পেন্টাগন ও আমেরিকান সিনেট কঠোর অর্থনৈতিক অবরোধের জন্য প্রস্তুত কিন্তু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ভেটোর কারণেই ঘন ঘন থামতে হচ্ছে। সর্বশেষ জি ২০ সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই ভয়াবহ সংকটের জন্য ওবামাকে দায়ী করে বিবৃতি দিয়ে সংকট নিরসনে ক্ষীণ আশা জাগিয়ে রেখেছেন।
২০১৫ সাল। তুরস্কের পক্ষ থেকে আকাশসীমা ভঙ্গের দায়ে রুশ যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার আলোচিত ঘটনাই আজকের আলোচিত এস-৪০০–এর উপাখ্যানের শুরু। যদিও রাশিয়া কখনোই আকাশসীমা লঙ্ঘনের অভিযোগে পাত্তা দেয়নি বরং রাশিয়ার যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার ঘটনাকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে মোকাবিলার খবর আঙ্কারাকে তড়িঘড়ি করে ব্রাসেলস ন্যাটোর সদর দপ্তরে পৌঁছায়। ব্রাসেলসের কর্তারা রাশিয়ার সঙ্গে যেকোনো উত্তেজনা এড়িয়ে চলার পরামর্শ ও কোনো কোনো আমেরিকান সামরিক কর্তাদের যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার ঘটনায় অনেকটা আঙ্কারাকে দোষী সাব্যস্ত করার কৌশল আঙ্কারাকে একলা চল নীতিতে বাধ্য করে। একলা চল নীতির প্রথম ধাপে জাতীয় আকাশ প্রতিরক্ষার নিমিত্তে তুরস্কের আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বানে ব্রিটেন ও চিনের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান সাড়া দেয় কিন্তু ন্যাটো ও ওয়াশিংটনের তোপের মুখে আঙ্কারা ওই দরপত্র বাতিলে বাধ্য হয়। আবার তুরস্কের সঙ্গে ওবামা প্রশাসন কংগ্রেসের দোহাই দিয়ে আমেরিকার তৈরি প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা সিস্টেম বিক্রিতে না করে দেন। মহাঝামেলায় পতিত হয় আঙ্কারা। একদিকে বর্মহীন আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় রুশ ও সিরিয়ার কুর্দি গেরিলাদের তর্জন–গর্জন অন্যদিকের দুর্দিনে পুরোনো পাশ্চাত্যের বন্ধুদের পাশে না পাওয়ার হতাশা।
পরের খবর সবার জানা, ২০১৬ সালের সেনা–অভ্যুত্থানে পাশ্চাত্যের ভূমিকা আঙ্কারাকে মস্কোর দুয়ারে নিয়ে যায়। জাল পেতে বসে থাকা পুতিন অনেকটা তড়িঘড়ি করেই ২০১৬–এর শেষের দিকে আঙ্কারার সঙ্গে এস ৪০০ বিক্রির অনুমোদন দেন অপেক্ষাকৃত কম দামে সহজ ঋণে। এস ৪০০ ক্রয় ও এরদোয়ানের সাম্প্রতিক পাশ্চাত্যবিরোধী সতর্ক মনোভাব ও কর্মপন্থা মস্কো-আঙ্কারার সম্পর্কে রকেট গতি দিয়েছে—পারস্পরিক ঐতিহাসিক অবিশ্বাসের মাঝেই। দ্বিপক্ষীয় এই অসম সম্পর্ক শুধুই সাম্প্রতিককালে অর্থনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ না থেকে সিরিয়া, ভেনেজুয়েলা সংকটসহ নানান আন্তর্জাতিক ইস্যুতেও ডাল মেলেছে।
তবে এস ৪০০ বিতর্ক শুধুই তুরস্ক-আমেরিকার মাঝে শুধুই সীমাবদ্ধ না থেকে বরং আমেরিকার যুদ্ধ সরঞ্জাম বিক্রির বাজারের একচেটিয়ায় আধিপত্যের নিরসনে এক আঘাত। এই আঘাত মোচনে সিনেট পাস করেছে CAATSA নামের বিল। যার মূলকথা রাশিয়ার কাছ থেকে অস্ত্র কিনলেই অর্থনৈতিক অবরোধের খপ্পরে পড়তে হবে। অবরোধের হুমকি কাঁধে নিয়েই ভারত, কাতার, চীন, সৌদি আরবসহ অন্ততপক্ষে এক ডজন দেশ এস ৪০০ কেনার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। যদিও আঙ্কারা এই বিল পাসের আগেই রাশিয়ার সঙ্গে এস ৪০০ কেনার চুক্তি করেছিল, তাই আইনের মারপ্যাঁচ থেকেই যাচ্ছে। ওয়াশিংটনের শঙ্কা এমনি, যদি একবার আঙ্কারা এস ৪০০ ব্যবহারে সফল হয় তাহলে বিশ্বের সবাই এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কিনতে আগ্রহী হবে, যা আমেরিকান অর্থনীতির কয়েক হাজার কোটি ডলারের ক্ষয়ক্ষতির কারণ হবে।
ন্যাটো আর পাশ্চাত্যের সঙ্গে আঙ্কারার দলাদলিতে মস্কো অনেকাংশে লাভবান। এস ৪০০ বিক্রির মাধ্যমে পুতিন এরদোয়ানকে পাশ্চাত্য থেকে কিছুটা হলেও দূরে সরিয়েছেন, ন্যাটোর সামগ্রিক প্রতিরক্ষার মধ্যে রাশিয়ার অবস্থান নির্ধারিত করেছেন—যা ছিল সবচেয়ে বড় বিজয় আবার আড়াই শ কোটি ডলারও কামিয়েছেন। সবকিছুতেই যেন পুতিনের জয়জয়কার। তবে এ কথা মানতে হবে যে প্রায় অর্ধদশক ধরে রাশিয়ার সিরিয়া, ক্রিমিয়া, ইউক্রেনসহ পৃথিবীর নানান জায়গায় সাময়িক সামরিক উপস্থিতি পাশ্চাত্যকে ভাবাচ্ছে। তবে আঙ্কারার সঙ্গে মস্কোর দহরম-মহরমের বাতাস ওয়াশিংটন আর ব্রাসেলসকে আঙ্কারা সম্পর্ককে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করবে তা সন্দেহাতীত।
লেখক: ইস্তাম্বুলে বসবাসরত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞানের সাবেক শিক্ষার্থী।
rahulanjumbdasia@yahoo.com