জরায়ুও নিরাপদ থাকেনি ছাত্রলীগের জন্য। ২০১৫ সালে মায়ের জরায়ুতে থেকে ছাত্রলীগের ছোড়া গুলিতে বিদ্ধ হয়েছিল এক কন্যাশিশু সুরাইয়া। জন্মের পর সুরাইয়ার একটি চোখ পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে, আরেকটির অবস্থাও খুব খারাপ। ছাত্রলীগ যে আক্ষরিক অর্থেই ‘বুলেট’, সেটা প্রমাণ করার জন্য আমাদের হাতে থাকা অসংখ্য তথ্যের একটি এই ঘটনা। বর্তমান ক্ষমতাসীনদের সময়ে ‘বুলেট ছাত্রলীগ’ নেতিবাচক সংবাদ হয় প্রতিনিয়ত। তাই পরীক্ষার হল থেকে ফেসবুক লাইভে একজন ছাত্রলীগ নেতা যখন প্রতীকীভাবে নিজেদের ‘বুলেট’ দাবি করেন, সব রকম অর্থেই সেটার স্বীকৃতি আমরা দিই।
ফেসবুক লাইভে বুক ফুলিয়ে প্রকাশ্যে এসব নিয়ে বলার মধ্যে একটি ভিন্ন দ্যোতনা আছে নিশ্চয়ই। কিন্তু না লিখেও এ প্লাস দিতে হবে কিংবা এ প্লাস না দিলে বোর্ডমোড ভেঙে ফেলা হবে, এ রকম কথা ছাত্রলীগের মুখ থেকে শুনে অনুমান করি, কেউ একেবারে স্তম্ভিত হয়ে পড়েননি। এই সরকারের শাসনামলে সরকারি দল এবং তার অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর দৌরাত্ম্য কোন জায়গায় পৌঁছেছে, সেটি এই দেশে বসবাসকারী মানুষমাত্রই জানেন। তারপরও যাঁরা ছাত্রলীগ নেতার ফেসবুক লাইভে অবাক হয়েছেন, তাঁদের এখন কী অবস্থা ‘এসপি লীগ’–সংক্রান্ত খবর দেখে?
আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ‘এসপি লীগের’ দাপট শিরোনামে গত বুধবারে প্রকাশিত প্রথম আলোর অসাধারণ প্রতিবেদনটিতে আছে স্তম্ভিত করার মতো অনেক বিষয়। রাষ্ট্রীয় চাকরিতে নিযুক্ত একজন মানুষ এতটাই সরাসরি রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছেন যে তাঁর পদের নামে একটি উপজেলার আওয়ামী লীগের একটি গ্রুপেরই নামকরণ করা হয়েছে।
আর সব সরকারি চাকরির মতো সংবিধান মতে পুলিশ ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী’। কিন্তু প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী পুলিশকে একেবারে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করার চর্চা বাংলাদেশের জন্মের পর থেকেই ছিল। কিন্তু এই দফায় আওয়ামী লীগ সরকারে থাকার সময়ে বিশেষ করে ২০১৪ সালের পর থেকে জনগণের ম্যান্ডেটহীনভাবে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে গিয়ে একেবারে দলীয় বাহিনীর মতো পুলিশকে ব্যবহার করেছে। এর মধ্যে ২০১৮ সালের ‘রাতের ভোটের’ পুরো ব্যবস্থাপনায় প্রশাসন এবং বিশেষ করে পুলিশ বাহিনীর ভূমিকার কথা জনগণের মধ্যে খুব জোর দিয়ে আলোচিত হয়। এটা নিশ্চয়ই আমরা বুঝি, সরকার ‘চাহিবামাত্র’ চাকরিবিধি এবং রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের বাইরে পুলিশকে ব্যবহার করতে পারে না, যদি না পুলিশও সেভাবে ব্যবহৃত হতে চায়।
নিজেদের মধ্যে ‘পুলিশ লীগ’ কথাটা অনেকেই বলেন ইদানীং। মানি, এভাবে বলার মধ্যে অতি সরলীকরণ আছে। নিশ্চয়ই শতভাগ পুলিশ একেবারে অন্ধভাবে রাজনৈতিক দলের হয়ে কাজ করেন না। তবে সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান বলে সমাজে প্রায় সব মানুষের মধ্যে যখন একটি ধারণা তৈরি হয়, সেটির আসলে ভিত্তি থাকে। ‘পুলিশ লীগ’ কথাটি দিয়ে মানুষ বোঝাতে চায় বাহিনীটি ক্ষমতাসীনদের একটি অঙ্গ সংগঠনের মতো কাজ করে। পুলিশ কর্মকর্তার আওয়ামী লীগের দলীয় স্লোগান দেওয়া, নির্বাচনী জনসভায় নৌকার পক্ষে ভোট চাওয়া এমন প্রকাশ্য ঘটনার উদাহরণ আছে ভূরি ভূরি। বিভিন্ন এলাকার পুলিশের ক্ষমতাসীন দলের উচ্চ মহল তো বটেই, সেই এলাকার ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে যোগসাজশে নানা কাজ করার যৌক্তিক অভিযোগ আছে।
কিন্তু আলোচিত প্রতিবেদনটিতে ‘এসপি লীগ’ যে অর্থে ব্যবহার করা হয়, সেটি একেবারেই এক নতুন পরিস্থিতির জানান দেয়। আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি, পুলিশের একজন উচ্চপদস্থ অফিসার রীতিমতো স্থানীয় রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছেন। তাঁকে নিয়ে যেসব তথ্য অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, সেগুলো কোনোটিই সরকারবিরোধীদের দেওয়া অভিযোগ নয়, করছেন সরকার দলের নেতারাই।
আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় পুলিশ এক অপরিহার্য বাহিনী, যেটি ছাড়া চলা যাবে না একটি দিনও। অস্ত্রধারী হওয়া এবং বল প্রয়োগের ক্ষমতাপ্রাপ্ত হওয়ার কারণে এই বেসামরিক বাহিনীকে থাকতে হবে, রাখতে হবে কঠোর নিয়ম-শৃঙ্খলার ‘বোতলে’ বন্দী করে। কিন্তু গত কয়েক বছরে পুলিশ বাহিনীর নানা কর্মকাণ্ড দেখে এটা ভাবার যথেষ্ট কারণ আছে— ‘জিন বোতলের বাইরে চলে এসেছে।’
শিবগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক জহির হাসান চৌধুরী বলেন, ‘চর দখলের মতো শিবগঞ্জে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও কৃষক লীগ দখল হয়ে গেছে। সৈয়দ নুরুল ইসলাম তাঁর পছন্দের লোকদের প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে দলকে নষ্ট করেছেন।’ শুধু তিনিই নন, সৈয়দ নুরুল ইসলামের অযাচিত হস্তক্ষেপে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দলও, প্রথম আলোর কাছে এমনটাই অভিযোগ করেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সাংসদ আবদুল ওদুদ। বিষয়টি দলকে অবগত করেছেন কি না, জানতে চাইলে আবদুল ওদুদ বলেন, সবার মধ্যে তাঁকে নিয়ে ভয় আছে।
একজন পুলিশ কর্মকর্তার সরাসরি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া আমাদের যতটা অবাক করেছে, তার চেয়ে বেশি অবাক আমরা হয়তো হব এসব ব্যাপারে তার নিজের মন্তব্য শুনলে। তাঁর অনুসারীদের এসপি লীগ বলা প্রসঙ্গে নুরুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের নুরুল বা এসপি লীগ ইত্যাদি বলার চেষ্টা করে। ওরা (তাঁর সমর্থকেরা) এসপির নামে স্লোগান দেয় না। স্লোগান দেয় আওয়ামী লীগের। কেউ যদি পৃষ্ঠপোষকতা না দেয়, তাহলে দলটাকে বাঁচাবে কে?’ তিনি আরও বলেন, তিনি শিক্ষিত ও মেধাবী তরুণদের রাজনীতি করতে পৃষ্ঠপোষকতা করেন। তাঁর দাবি, যাঁরা পদ না পেয়ে কোণঠাসা হয়েছেন, তাঁরাই এসব প্রশ্ন তুলছেন।
একেবারে খোলাখুলিভাবে নুরুল ইসলাম জানান, তিনি পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে দলটিকে বাঁচিয়ে রাখছেন। এবং শিক্ষিত এবং মেধাবী তরুণদের রাজনীতি করার ক্ষেত্রে তিনি পৃষ্ঠপোষকতা দেন। তাঁদের মতো মানুষের হাতেই নাকি এখন আওয়ামী লীগ বেঁচে আছে। সরকারি দলের ব্যক্তিগত বাহিনীর মতো করে, বিরোধী দল ও মতকে দমন করার মাধ্যমে সরকারকে তাঁরা টিকিয়ে রেখেছেন, আমরা জানতাম। কিন্তু এখন এটাও জানতে পারছি, তাঁরা ক্ষমতাসীন দলকে টিকিয়ে রাখায় ভূমিকা পালন করছেন রীতিমতো সাংগঠনিক ভূমিকা পালন করার মাধ্যমেও।
প্রতিবেদনের এটুকু পড়েই যখন অবাক হয়েছিলাম তখন জানতাম না অপেক্ষা করছে আরও বিরাট ‘চমক’। জনাব ইসলাম তাঁর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড রীতিমতো তাঁর রাষ্ট্রীয় অফিস থেকে পরিচালনা করেন। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের যুগ্ম কমিশনার হিসেবে কর্মরত থাকা অবস্থায় তিনি অফিসে এলাকার লোকজনের সঙ্গে সব রাজনৈতিক কাজ করে থাকেন। ন্যূনতম রাখঢাক নেই তাঁর। প্রথম আলো প্রতিনিধি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে দেখেছেন, তাঁর কক্ষে এলাকার বেশ কয়েকজন লোক। জনাব ইসলাম নিজেই জানান ‘প্রতিদিন চাঁপাইনবাবগঞ্জের অন্তত ৫০ জন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসেন।’
প্রথম আলো প্রতিনিধি উপস্থিত থাকা অবস্থায়ই শিবগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ৮ থেকে ১০ জনের একটি দল নিয়ে আসেন সেখানে। তখন সৈয়দ নুরুল ইসলাম প্রতিবেদককে বলেন, ‘চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার মানুষের কেন্দ্রবিন্দু একটাই। সেটা হচ্ছি আমি।’ পুলিশ কর্মকর্তা হয়ে রাজনীতিতে জড়ানো ঠিক কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি দল-পাগল টাইপের মানুষ। দলকে ভালোবাসি বিধায় দলীয় লোকজনের সঙ্গে সম্পৃক্ততা আছে, যোগাযোগ আছে।’
একজন প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী তাঁর চাকরিকালে সময়ে নিজ অফিসে প্রতিদিন ৫০ জন এলাকার মানুষের সঙ্গে দেখা করেন। তাহলে তাঁর ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করার পরিস্থিতি কী, সেটা বোঝা খুব সহজ। আর যে মানুষের কাছে প্রতিদিন ৫০ জন এলাকার মানুষ আসেন, সেটা নিশ্চয়ই গোপনীয় কোনো বিষয় নয়। অর্থাৎ তাঁর কর্মকাণ্ডে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সম্মতি আছে।
এই পুলিশ কর্মকর্তা এটুকুও নিশ্চয়ই জানেন, এই পত্রিকা বাংলাদেশের নাগরিকদের এক বিরাট অংশের কাছে এক অতি গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় আছে। অর্থাৎ তাঁর বক্তব্য দ্রুতই পৌঁছে যাবে অসংখ্য মানুষের কাছে।
আমি বিশ্বাস করি, জনাব ইসলাম দৃঢ়ভাবে তাঁর কথাগুলো বলেছেন। এখন তাঁরা এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছেন, যেকোনো কৃতকর্মের পক্ষে সরাসরি সাফাই গাইতে তাঁদের আর দ্বিধা নেই। কারণ, তাঁরা জানেন তিরস্কৃত হওয়া দূরেই থাকুক, যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে এমন কাজের জন্য তাঁরা পুরস্কৃত হবেন।
প্রথম আলোর প্রতিবেদনের শেষ পর্যায়ে এসে এই সার্বিক ঘটনাটির ব্যাপারে পুলিশের পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক মুহাম্মদ নুরুল হুদার কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘পুলিশের একজন কর্মকর্তা হয়ে রাজনীতিতে জড়ানো বা রাজনীতিসংক্রান্ত কাজকর্মে জড়ানো সরকারি কর্মচারী আচরণবিধির পরিপন্থী। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের এ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’
আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় পুলিশ এক অপরিহার্য বাহিনী, যেটি ছাড়া চলা যাবে না একটি দিনও। অস্ত্রধারী হওয়া এবং বল প্রয়োগের ক্ষমতাপ্রাপ্ত হওয়ার কারণে এই বেসামরিক বাহিনীকে থাকতে হবে, রাখতে হবে কঠোর নিয়ম-শৃঙ্খলার ‘বোতলে’ বন্দী করে। কিন্তু গত কয়েক বছরে পুলিশ বাহিনীর নানা কর্মকাণ্ড দেখে এটা ভাবার যথেষ্ট কারণ আছে— ‘জিন বোতলের বাইরে চলে এসেছে।’
ডা. জাহেদ উর রহমান ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের শিক্ষক