এক মাস আগে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করার পর গণতন্ত্রপন্থী বিক্ষোভকারীরা ইয়াঙ্গুনে মার্কিন দূতাবাসের সামনে জড়ো হয়েছিলেন। জেনারেলরা যাতে আবার ব্যারাকে ফিরে যান এবং অং সান সু চিকে মুক্তি দেন তার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রতি তাঁরা আহ্বান জানিয়েছিলেন। ২০২০ সালের নির্বাচনে সু চির দল জয়লাভ করলেও সামরিক বাহিনী সু চিকে সরকার গঠন করতে দেয়নি।
প্রশ্ন হলো যুক্তরাষ্ট্রের কি বিক্ষোভকারীদের পক্ষ নেওয়া উচিত? মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এ অভ্যুত্থানকে অস্বীকার করা ছাড়া আর কিছু করার কি এখতিয়ার রাখেন?
যুক্তরাষ্ট্র দ্রুত হস্তক্ষেপ করুক, মিয়ানমারের বিক্ষোভকারীদের এমন আশা প্রকাশের মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়েছে, ডোনাল্ড ট্রাম্প ‘আগে আমেরিকার স্বার্থ’ভিত্তিক নীতিতে চার বছর দেশ চালানোর পরও বিশ্বদরবারে দেশটির নেতৃত্বদানের ভাবমূর্তি একেবারে মরে যায়নি।
গত বছর হংকংয়ের ওপর চীনের দমনাভিযানের প্রতিবাদে হংকংজুড়ে যে বিক্ষোভকারীরা নেমে এসেছিলেন, তাঁরাও ট্রাম্পকে মিত্র বলে মনে করছিলেন। যেহেতু ট্রাম্প চীনের ওপর খাপ্পা ছিলেন, সে কারণে বিক্ষোভকারীরা আশা করেছিলেন, চীনের কমিউনিস্ট কর্তৃত্ববাদী শাসন থেকে মুক্তি পেতে ট্রাম্প তাঁদের সাহায্য করবেন।
বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র বিস্তারে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বদানের লম্বা ইতিহাস রয়েছে। এর জন্য অনেক যুদ্ধেও দেশটিকে জড়াতে হয়েছে। এর ফলে দেশটির গণতন্ত্রবাদী আদর্শ বহু দেশের অনুপ্রেরণা হয়ে আছে। জন এফ কেনেডি বলেছিলেন, ‘সমগ্র মানবজাতির কল্যাণে আমরা আমাদের নীতি ও আদর্শ সম্প্রসারিত করব এবং এর জন্য প্রয়োজনে বিশ্বব্যাপী আমরা লড়াই–সংগ্রাম চালিয়ে যাব’ এবং দেশটি সুদীর্ঘ দিন এ নীতিতে চলে এসেছে।
তবে অনেক ব্যতিক্রমও আছে। ১৯৫৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর ভরসা করে হাঙ্গেরির মানুষ সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে জেগেছিল। কিন্তু মাত্র ১৭ দিনেই সোভিয়েত ইউনিয়ন সেই গণজোয়ার স্তব্ধ করে দিয়েছিল এবং সে সময় যুক্তরাষ্ট্র আন্দোলনকারীদের পাশে দাঁড়ায়নি। আবার পশ্চিম ইউরোপে হিটলারের উৎপীড়ন থেকে মানুষকে মুক্ত করার ঘটনার বাইরেও যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় কখনো কখনো আন্দোলন সফল হয়েছে।
১৯৮০–এর দশকে ফিলিপাইন এবং দক্ষিণ কোরিয়ায় একনায়কত্বের বিরুদ্ধে জনগণ বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল। অবশ্য গত দুই বছরে হংকং, থাইল্যান্ড ও মিয়ানমারে যে ধরনের গণবিক্ষোভ হয়েছে, সেই বিক্ষোভগুলো এ রকম ছিল না। ১৯৮৯ সালে চীনের সরকারবিরোধীরা তিয়েন আনমেন স্কয়ারে যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যাচু অব লিবার্টির আদলে ১০ ফুট উঁচু ‘গডেস অব ডেমোক্রেসি’খ্যাত একটি ভাস্কর্য বসিয়েছিল। পরে সেনাবাহিনীর নিষ্ঠুরতায় তখনকার গণ-আন্দোলনের রক্তক্ষয়ী অবসান হয়েছিল। সেই ভাস্কর্যও ফেলে দেওয়া হয়েছিল। সেখানে বিক্ষোভকারীদের জয় না হলেও ফিলিপাইনে ফার্ডিনান্ড মারকোসকে জনতা উৎখাত করেছিল এবং দক্ষিণ কোরিয়ায়ও সামরিক স্বৈরাচার সরকারের পতন ঘটেছিল। এ দুটি দেশে জনগণের জয়ের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন কাজ করেছিল। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায়ই তাইওয়ানে কর্তৃত্ববাদী সরকারের স্থলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
তবে ফিলিপাইন, দক্ষিণ কোরিয়া ও তাইওয়ানে গণতন্ত্রপন্থীদের সাফল্যে যেটি কাজ করেছিল, থাইল্যান্ড, হংকং অথবা মিয়ানমারের ক্ষেত্রে তা কাজ করেনি। এর প্রধান কারণ হলো প্রথমোক্ত তিনটি দেশেই শীতলযুদ্ধের সময়কার বামপন্থী সরকার ছিল। এ তিন দেশকে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা সোভিয়েত ইউনিয়নের ‘খদ্দের রাষ্ট্র’ হিসেবে দেখত। ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও সমাজতন্ত্রবিরোধী দেশগুলো একযোগে তাদের বিরুদ্ধে নেমেছিল।
যতক্ষণ না যুক্তরাষ্ট্র সমাজতন্ত্রকে হুমকি হিসেবে দেখেছে, ততক্ষণ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ ও সামরিক সহায়তা নিয়ে এসব দেশের কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলো টিকে ছিল। কিন্তু যখন চীন তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণ এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন আধিপত্য বিস্তার করা শুরু করল, তখন সেই সরকারগুলো অরক্ষিত হয়ে পড়ল। মারকোস ভোট চুরি করার পর জনগণ খেপে গেল এবং যুক্তরাষ্ট্র তঁাকে কোনো ধরনের সহায়তা না করায় তিনি হেলিকপ্টারে চড়ে হাওয়াই দ্বীপে পালিয়ে গিয়ে প্রাণে বাঁচলেন।
দক্ষিণ কোরিয়ার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। সেখানে যুক্তরাষ্ট্র প্রথম দিকে সেনা সরকারকে সমর্থন দিলেও জনগণ সেই সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু করলে যুক্তরাষ্ট্র সে সমর্থন তুলে নেয় এবং গণতন্ত্রের পাশে দাঁড়ায়। পরে জেনারেলরা সরে দাঁড়াতে বাধ্য হন।
থাইল্যান্ড ও মিয়ানমারের জেনারেলদের ক্ষেত্রে ভিন্ন প্রেক্ষাপট দেখা যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বাইডেন তাদের বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপের হুমকি দিলেও যেহেতু চীন তাদের পাশে রয়েছে, সেহেতু এই জেনারেলরা আর ভয় পাবেন না।
থাইল্যান্ডের শাসকেরা বরাবরই চীনের মর্জিমতো চলে উপকৃত হয়েছেন। ফলে তঁারা চীনের আনুগত্য মেনেই চলবেন। হংকং আনুষ্ঠানিকভাবেই চীনের অংশ হিসেবে স্বীকৃত। সে কারণে হংকংয়ের রাস্তায় বিক্ষোভকারীরা কটি মার্কিন পতাকা ওড়ালেন, তাতে কিছু যায় আসে না।
বর্তমানে মিয়ানমারের ওপর চীনের যে প্রভাব রয়েছে, তা যুক্তরাষ্ট্রের নেই। কার্যত এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সেই আগের প্রভাব–প্রতিপত্তি এখন নেই। তবে এখানকার গণতন্ত্রপন্থীরা বাইডেন প্রশাসনের কাছে যে সহায়তা প্রত্যাশা করছে, তা হয়তো যুক্তরাষ্ট্রের আগের সেই প্রভাবকে ফিরিয়ে আনতে উদ্বুদ্ধ করবে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
ইয়ান বুরুমা ডাচ বংশোদ্ভূত মার্কিন লেখক