গত বছর পিটসবার্গ সিনাগগে অভিবাসীবিদ্বেষী এক উন্মত্তের গুলিতে ১১ জন নিহত হওয়ার পর আমি এটিকে ‘ট্রাম্পিজমের ভাবাদর্শে উদ্বুদ্ধ দেশীয় সন্ত্রাস’ হিসেবে উল্লেখ করেছিলাম। ২০১৮ সালে মধ্যবর্তী নির্বাচনের প্রচারণার সময় ট্রাম্প যখন অভিবাসীতে দেশ ছেয়ে যাচ্ছে বলে আতঙ্ক ছড়াচ্ছিলেন, সেই মুহূর্তেই ওই সন্ত্রাসী সিনাগগে এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে ১১ জনকে হত্যা করেছিল। সিনাগগটিকে রক্তে ভাসিয়ে দেওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগে হামলাকারী অনলাইনে নিজের বক্তব্য তুলে ধরেন। তিনি একটি ইহুদি শরণার্থী সহায়তা সংস্থা ‘বাইরে থেকে আসা আমাদের হত্যাকারীদের’ আমেরিকায় পুনর্বাসনে সাহায্য করছে বলে অভিযোগ করেছিলেন। শনিবার এল পাসোতে যা হলো, তা সেই ঘটনারই পুনরাবৃত্তি।
ট্রাম্প ২০২০ সালের পুনর্নির্বাচনের প্রচার এই গ্রীষ্মেই শুরু করে দিয়েছেন। গত নির্বাচনের আগে তিনি বর্ণ ও জাতিগত বিভাজন এবং অভিবাসনবিরোধিতা নিয়ে যেভাবে প্রচারণা চালিয়েছিলেন, এবারের প্রচারণায় সেই উন্মাদনাকে দ্বিগুণ করেছেন। ট্রাম্প একের পর এক অভিবাসনবিরোধী প্রচারণা চালিয়ে সাধারণ আমেরিকানদের মধ্যে এই ভয় ঢুকিয়ে দিচ্ছেন যে হিস্পানিকরা রাজনৈতিক শক্তি দখল করে ফেলতে পারে। এই ভয় থেকেই অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসী এল পাসোর ওয়ালমার্টে ঢুকে যতজন সম্ভব ততজন হিস্পানিককে হত্যা করেছে। এটি নিঃসন্দেহে ট্রাম্পের উসকানিতে চালানো সন্ত্রাস।
ট্রাম্প প্রথম থেকেই শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদের পক্ষে খোলামেলাভাবে বক্তব্য দিয়েছেন। এতে কট্টর ডানপন্থীরা প্ররোচিত হয়েছেন এবং অভিবাসীদের বিরুদ্ধে তাঁরা একজোট হয়েছেন। ট্রাম্প যখন টুইটারে এবং টেলিভিশনে অভিবাসীদের ‘দখলবাজ’ এবং ‘আমেরিকার জন্য উপদ্রব’ বলে মন্তব্য করেন, তখন অভিবাসীদের ওপর রেগে থাকা যেকোনো নাগরিক উদ্দীপ্ত হতে পারেন। এ ধরনের শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের মনে হওয়া খুব স্বাভাবিক যে অভিবাসীদের হত্যা বা উচ্ছেদ করলে প্রশাসন এ নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য করবে না।
ট্রাম্প গদিতে বসার পরপরই যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী আসা কমিয়ে ফেলার জন্য সাতটি মুসলিমপ্রধান দেশ থেকে অভিবাসীদের আমেরিকায় আসা স্থগিত করেন এবং অস্থায়ী ভিত্তিতে সব ধরনের অভিবাসন কার্যক্রম বন্ধ রাখেন। এর পরের প্রতিবছরই তিনি যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী আগমন কমাতে থাকেন এবং ২০২০ সালে এই সংখ্যা শূন্যে নামিয়ে আনা হবে বলেও ট্রাম্প হুমকি দিয়েছেন।
ট্রাম্প আদমশুমারির যে দাবি তুলেছেন, সেটিও শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের অন্যতম অ্যাজেন্ডা। এই আদমশুমারি করা হলে যাঁরা এখনো নাগরিকত্ব পাননি কিংবা সদ্য নাগরিকত্ব পেয়েছেন, তাঁদের সংখ্যালঘু হিসেবে চিহ্নিত করা সহজ হবে। এতে তাঁদের রাজনৈতিক প্রভাব আরও কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়ন করতেই ট্রাম্প নাগরিকত্ব না পাওয়া শিশুদের মা–বাবা থেকে আলাদা করে আটক রাখার মতো পৈশাচিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
গত মাসে ট্রাম্প চারজন অশ্বেতাঙ্গ কংগ্রেস সদস্যকে ‘বাইরে থেকে আসা’ লোক বলে উল্লেখ করে তাঁদের আমেরিকা ছেড়ে চলে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীরা সব সময় অশ্বেতাঙ্গরা ‘প্রকৃত আমেরিকান’ নয় বলে যে দাবি করে আসছে, এই মন্তব্যের মধ্য দিয়ে ট্রাম্প সেটিকেই অনুমোদন করেছেন। এল পাসোতে হামলা করার আগে হামলাকারী অনলাইনে লিখেছিলেন, ‘টেক্সাসে হিস্পানিকদের দখলদারির জবাব’। তার মানে হামলাকারী প্রকারান্তরে ট্রাম্পের অভিবাসীবিরোধী অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে এই হামলা চালিয়েছেন।
ট্রাম্প বলেছেন, অবৈধ অভিবাসীদের কষ্টদায়কভাবে আটকে রাখলে অভিবাসী আসা কমে যাবে। ট্রাম্পের এই নীতি ধরেই হামলাকারী হামলা চালিয়েছেন। হিস্পানিকদের ওপর এই বর্বর হামলা এখন তাঁদের স্বদেশে ফিরে যেতে ‘উদ্বুদ্ধ’ করবে। হামলাকারী লিখেছেন, আমেরিকাকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচানোর জন্যই তিনি এই কাজ করেছেন।
ট্রাম্প তাঁর অনুসারীদের সরাসরি হামলা চালাতে বলেননি, আবার তা বলতে বাদও রাখেননি। তিনি ধারাবাহিকভাবে এমন সব বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন, যা সহিংসতাকে প্রচ্ছন্নভাবে উসকে দিচ্ছে। গত সপ্তাহে তিনি বাল্টিমোরের সংখ্যালঘু বাসিন্দাদের উপস্থিতিকে ‘ইঁদুরের উপদ্রব’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এল পাসোতে হামলা করা ব্যক্তি ট্রাম্পের এই বক্তব্যে প্ররোচিত হয়ে থাকতে পারেন।
যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হতে আরও ১৫ মাস বাকি। এ সময়ে ট্রাম্পের এই সহিংসতা উসকে দেওয়া আরও কতটা ভয়ানক মাত্রায় গড়াবে, তা ভাবলে গা শিউরে ওঠে। আশঙ্কা হয়, এল পাসোর মতো ঘটনা আরও ঘটতে পারে।
দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত
ডেভিড শানজার : ডিউক ইউনিভার্সিটির স্যানফোর্ড স্কুল অব পলিসির অধ্যাপক