বাংলাদেশ গত বছরের আগস্ট মাস থেকে এলএনজি (গ্যাস) আমদানি করা শুরু করেছে। এই গ্যাস মধ্যপ্রাচ্যের দুটি দেশ কাতার ও ওমান থেকে আমদানি করা হয়। সাগরপথে এটি বাংলাদেশে আনার জন্য উত্স দেশে গ্যাসটিকে যথেষ্ট ঠান্ডা করে তরল করে নেওয়া হয় এবং এই তরলীকৃত গ্যাস জাহাজে করে বাংলাদেশে পৌঁছানো হয়। তরল অবস্থায় এই গ্যাসকে লিকুইফাইড ন্যাচারাল গ্যাস বা এলএনজি বলা হয়। মহেশখালী উপকূলসংলগ্ন সাগর এলাকায় প্রতিষ্ঠিত দুটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনালে এই এলএনজি পৌঁছানোর পর তা পুনরায় গ্যাসীয় অবস্থায় রূপান্তরিত করে পাইপলাইনের মাধ্যমে মূল ভূখণ্ডে অবস্থিত জাতীয় গ্যাস গ্রিডে সরবরাহ করা হয়। এই কার্যক্রমের মাধ্যমে বাংলাদেশ গ্যাস ব্যবসায় এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে, যেটি সম্পর্কে ইতিপূর্বে এ দেশের জনসাধারণ অবগত ছিল না।
এলএনজি একটি ব্যয়বহুল জ্বালানি। উচ্চমূল্যের কারণে মূলত ধনবান দেশগুলোতে এটির ব্যাপক ব্যবহার দেখা যায়। বাংলাদেশ মধ্যপ্রাচ্য থেকে যে এলএনজি আমদানি করছে, তার দাম পড়ে প্রতি ইউনিট (হাজার ঘনফুট) ৮ থেকে ১০ ডলার, আর দেশে উত্তোলিত গ্যাসের দাম পড়ে প্রতি ইউনিট ২ থেকে ৩ ডলার। পেট্রোবাংলা উচ্চমূল্যের আমদানি করা এলএনজি গ্যাসকে দেশীয় স্বল্প মূল্যের গ্যাসের সঙ্গে মিশ্রিত করে সরবরাহ করে। তাই এই মিশ্রিত গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি করার প্রয়োজন হয়ে থাকে। কর্তৃপক্ষ এ বছর জুলাই মাসে গ্যাসের দাম গড়ে ৩৩ শতাংশ বৃদ্ধি করে। এর মধ্যে শিল্প খাতে ৩৭ শতাংশ, বিদ্যুৎ খাতে ৪১ শতাংশ ও সার কারখানায় ৬৪ শতাংশ মূল্য বৃদ্ধি করা হয়। আগামী বছরগুলোতে গ্যাসের দাম আরও বৃদ্ধি করা হবে। কারণ, সে সময় আমদানি করা এলএনজির পরিমাণ আরও বৃদ্ধি পাবে। বর্তমানে পেট্রোবাংলাকে আমদানি করা প্রতিদিন প্রায় ৬০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের খরচ বহন করতে হচ্ছে। আর এটি এ বছর বর্ধিত গ্যাসের মূল্য দিয়েও মেটানো যায় না। তাই এটি মেটাতে গ্যাস উন্নয়ন তহবিল (দেশে গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য সঞ্চিত অর্থ) থেকে অর্থ জোগান দেওয়া হয়, বাকিটা আসে সরকারি ভর্তুকি থেকে। বর্তমান পরিকল্পনা অনুযায়ী বাংলাদেশে এলএনজি আমদানির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে হবে ২০২৫ সালে প্রতিদিন ২৩০ কোটি ঘনফুট এবং ২০৩০ সালে প্রতিদিন ৩০০ কোটি ঘনফুট। আর এ সময়ব্যাপী দেশের নিজস্ব গ্যাসের সরবরাহ ক্রমাগতভাবে কমতে থাকবে। অর্থাৎ সে সময়ে দেশে ব্যবহৃত গ্যাসের উল্লেখযোগ্য অংশ হবে এলএনজি। আর এ কারণে গ্যাসের দাম যে আরও যথেষ্ট পরিমাণ বাড়ানো হবে, তা বলা যায়।
গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধিতে সামাজিক–রাজনৈতিক পরিসরে সব সময়ই ব্যাপক সমালোচনার সূত্রপাত ঘটে। কেউ কেউ মনে করেন, বাংলাদেশে গ্যাসের দাম অন্যান্য দেশ যেমন পশ্চিমা দেশগুলো থেকে কম, তাই দাম বাড়ানো যুক্তিসংগত। অপর এক পক্ষ যুক্তি দেখায় যে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধিতে জনজীবনে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। কারণ, গ্যাসের দাম বাড়ানোর সূত্র ধরে যানবাহনের ভাড়া বৃদ্ধি, যানবাহন ব্যবহার করে পরিবাহিত দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, বাড়িভাড়া বৃদ্ধি, শিল্পকারখানা থেকে তৈরি দ্রব্যাদি ইত্যাদির মূল্যবৃদ্ধি ঘটে থাকে। তাই গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধিতে সমাজের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর ওপর বাড়তি খরচের বোঝা এসে পড়ে। পশ্চিমা দেশে গ্যাসের উচ্চমূল্য বহন করার ক্ষমতা সে দেশের জনসাধারণের থাকতে পারে, কিন্তু আমাদের দেশের নিম্ন বা নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির বিরাট জনগোষ্ঠীর পক্ষে জীবনধারণের জন্য গ্যাস ও তার সঙ্গে জুড়ে থাকা পণ্য ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আছে কি না, সেটিই বিবেচ্য বিষয়। দেশে সাশ্রয়ী গ্যাসের পরিবর্তে উচ্চমূল্যের গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থাপনার ওপর ভর করার প্রেক্ষাপট আলোচনায় আনা যেতে পারে।
প্রথমত, ২০০৫ সালে বাংলাদেশ সাশ্রয়ী পাইপলাইন গ্যাস আমদানির একটি সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করে। সে সময় মিয়ানমার তার সাগরবক্ষে আবিষ্কৃত বড় গ্যাসের মজুত ভারতে রপ্তানি করার জন্য বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ত্রিদেশীয় পাইপলাইন স্থাপনের প্রস্তাব দেয়। বাংলাদেশের পক্ষে ওই পাইপলাইন থেকে গ্যাসের একটি ভাগ বাংলাদেশের কাছে বিক্রি করতে হবে—এ রকম শর্ত সাপেক্ষে গ্রহণ করার সুযোগ ছিল। এই পাইপলাইন গ্যাস ছিল তুলনামূলকভাবে সাশ্রয়ী ও সহজলভ্য। কিন্তু বাংলাদেশ এ প্রস্তাব গ্রহণ করেনি এবং সুযোগটি হাতছাড়া করে। পরিশেষে মিয়ানমার তার সাগরের গ্যাস চীনে পাইপলাইনের মাধ্যমে রপ্তানি করার ব্যবস্থা করে, যা আজ পর্যন্ত চালু রয়েছে। পরে কোনো এক সময় বাংলাদেশ মিয়ানমারের কাছে তার দেশের গ্যাস ক্রয় করার আগ্রহ প্রকাশ করলে মিয়ানমার জানায়, রপ্তানি করার মতো আর কোনো গ্যাস তার কাছে নেই। অর্থাৎ বাংলাদেশ সহজভাবে প্রাপ্ত সাশ্রয়ী মূল্যে গ্যাস আমদানির সুযোগটি সহজভাবেই প্রত্যাখ্যান করে। এটিকে রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণী মহলের অদূরদর্শিতা ও অদক্ষতার সাক্ষ্য হিসেবে গণ্য করা যায়।
দ্বিতীয়ত, ২০১২ ও ২০১৪ সালে যথাক্রমে মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে বাংলাদেশের সমুদ্র সীমানা বিরোধ নিষ্পত্তি হওয়ার পর দেশে যে সমুদ্র বিজয় উৎসব করা হয়, তার ধারাবাহিকতায় সমুদ্র সম্পদ আহরণের কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। নিষ্কণ্টক সমুদ্র অর্জনের পরও বিগত পাঁচ–ছয় বছরব্যাপী বাংলাদেশের সমুদ্র সীমানায় গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম নেই বললেই চলে। মোট ২৬টি সমুদ্র ব্লকের ২২টিই খালি পড়ে রয়েছে। যে চারটি ব্লকে অনুসন্ধান চুক্তি করা হয়েছে তাতে নিযুক্ত তেল কোম্পানিগুলোর কার্যক্রম নেহাতই ধীর ও স্বল্প। গ্যাস বা তেল সম্পদ আহরণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সমুদ্র বিশ্বে সম্ভাবনাময় এলাকাগুলোর মধ্যে সর্বাপেক্ষা অজ্ঞাত সমুদ্র অঞ্চল হিসেবে বিবেচিত হয়। অথচ বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমার ও ভারতের সমুদ্র সীমানার ওপারে ওই দুটি দেশই বড় আকারের গ্যাস সম্পদ আবিষ্কার ও আহরণের কাজ সার্থকভাবে চালিয়ে যাচ্ছে। ভূবিজ্ঞানীরা মনে করেন, প্রাকৃতিকভাবে আন্তর্দেশীয় সীমানার কোনো অস্তিত্ব নেই, তাই বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের সমুদ্র সীমানার ওপারে মিয়ানমারে যে বৃহৎ গ্যাস মজুত আবিষ্কার হয়েছে, তার প্রাকৃতিক ও ভূতাত্ত্বিক ধারাবাহিকতা বাংলাদেশের এপারেও বজায় থাকবে। সে অর্থে বাংলাদেশের পরবর্তী বৃহৎ গ্যাসক্ষেত্রগুলো আবিষ্কৃত হবে মিয়ানমারের সমুদ্র সীমানাসংলগ্ন বাংলাদেশের সমুদ্রবক্ষ এলাকায়। কিন্তু এটি তখনই ঘটবে, যখন সেখানে একটি জোরালো অনুসন্ধান কাজ করা হবে। এই জোরালো অনুসন্ধান দীর্ঘদিনব্যাপী কেন হয়নি, তার ব্যাখ্যা কেউই দিতে পারে না।
স্থলভাগের গ্যাস তুলনামূলকভাবে সাশ্রয়ী। বাংলাদেশের স্থলভাগের একটি বিরাট অংশ অনুসন্ধান কার্যক্রমের বাইরে রয়ে গেছে। অতীতে কেবল সহজতর সম্ভাবনাগুলোয় অনুসন্ধান করে বাংলাদেশের স্থলভাগে যথেষ্ট গ্যাস মজুত পাওয়া যায়। এই আবিষ্কৃত মজুতই দেশের অর্থনীতিকে এত দিন চালিয়ে নিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। এই প্রাপ্ত মজুত অদূর ভবিষ্যতে নিঃশেষ হয়ে যাবে। কিন্তু এর মানে এই নয় যে বাংলাদেশে গ্যাস সম্পদ নিঃশেষ হওয়ার পথে। স্থলভাগের বৃহৎ একটি এলাকায় অনাবিষ্কৃত গ্যাস মজুতের যে বিরাট সম্ভাবনা রয়ে গেছে, তাকে অনুসন্ধানের মাধ্যমে বের করে আনা কেবল সদিচ্ছা ও সুষ্ঠু পরিকল্পনার ব্যাপার।
অতীতে একাধিক আন্তর্জাতিক অনুসন্ধানী সংস্থা পেট্রোবাংলার যৌথভাবে সম্পাদিত জরিপের মাধ্যমে নির্ধারণ করে যে বাংলাদেশে অনাবিষ্কৃত গ্যাস সম্পদের পরিমাণ গড়ে ৩২ টিসিএফ থেকে ৪১ টিসিএফ (ইউএসজিউস-পেট্রোবাংলা যৌথ জরিপ ২০০১ এবং এনপিডি-এইচসিইউ যৌথ জরিপ ২০০২)। বাংলাদেশ বর্তমানে প্রতিবছর প্রায় ১ টিসিএফ গ্যাস ব্যবহার করে। সে হিসাবে বাংলাদেশে ২৫ থেকে ৩০ বছরের গ্যাস সম্পদ অনাবিষ্কৃত রয়ে গেছে।
দেশের নীতিনির্ধারণী মহল এমন একটি ধারণা দ্বারা তাড়িত হয়েছে যে দেশের গ্যাস সম্পদ প্রায় শেষ, সুতরাং বিদেশ থেকে উচ্চমূল্যে হলেও এলএনজি (গ্যাস) আমদানি করার কোনো বিকল্প নেই। বিগত ২০ বছরে গ্যাস অনুসন্ধানে নিষ্ক্রিয়তা বা ন্যূনতম উদ্যোগ উল্লেখযোগ্য নতুন গ্যাস মজুত আবিষ্কারে ব্যর্থতার কারণ। এই ব্যর্থতার ফলে বর্তমানে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে যে উচ্চমূল্যে হলেও এলএনজি আমদানি করা জরুরি হয়ে পড়েছে। আর এই বাড়তি মূল্যের ভার পড়েছে সাধারণ মানুষের ওপর। দেশের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা অনুযায়ী আগামী বছরগুলোতে এলএনজি আমদানি আরও বৃদ্ধি পাবে, যার হাত ধরে দেশে গ্যাসের মূল্য আরও বৃদ্ধি পাবে। এর ফলে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষের জীবনযাত্রা কেবলই কঠিনতর হতে থাকবে। অথচ দেশে একটি সুষ্ঠু ও জোরালো গ্যাস অনুসন্ধান কর্মধারা এর একটি সহজতর সমাধান দিতে পারে। নীতিনির্ধারণী মহলের কর্তাব্যক্তিরা সে পথে চলবেন কি?
ড. বদরূল ইমাম: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক