বাংলাদেশের রাজনীতির কে নায়ক আর কে প্রতিনায়ক, তা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। একপক্ষ যাঁকে নায়ক ভাবত, আরেক পক্ষ তাঁকে প্রতিনায়কের আসনে বসাতে পারে। একটি বিষয়ে সবাই একমত হবেন যে আমাদের রাজনীতিতে একজন খলনায়ক আছেন এবং তিনি হচ্ছেন এরশাদ। পুরো নাম হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান। ক্ষমতাসীন মহাজোটের শরিক। পতিত স্বৈরশাসক।
সপ্তাহ দুই আগে চিকিৎসার জন্য এরশাদ যখন সিঙ্গাপুর যান, তখন অনেকেই ধারণা করেছিলেন নির্বাচনের আগে হয়তো তিনি ফিরবেন না। মনোনয়ন নিয়ে দলে ও মহাজোটে যে প্যাঁচ লেগেছে, সেটি খোলার ক্ষমতা তাঁর নেই। সিঙ্গাপুরে যাওয়ার আগে এরশাদ ভর্তি হয়েছিলেন সিএমএইচে। নির্বাচন এলেই এরশাদকে সিএমএইচে ভর্তি হতে হয়। কখনো তিনি স্বেচ্ছায় যান, কখনো যেতে বাধ্য করা হয়। এ কারণে অনেকে এই রোগকে ইলেকশন সিনড্রোম বলে অভিহিত করেছেন।
সিএমএইচে থাকা অবস্থায়ই এরশাদ দলের মহাসচিব পদে পরিবর্তন আনেন। রুহুল আমিন হাওলাদারকে সরিয়ে বসান মসিউর রহমানকে। জাতীয় পার্টির মহাসচিব, যিনি দলের দ্বিতীয় প্রধান, এই পদে পরিবর্তন আনতে কোনো বৈঠক বা আলোচনার প্রয়োজন হয় না। জাতীয় পার্টির গঠনতন্ত্রটি এমনভাবে তৈরি করা যে দলীয় চেয়ারম্যান চাইলে যেকোনো সময় যে কাউকে বাদ দিতে পারেন। যে কাউকে অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন। এভাবে চেয়ারম্যান চাইলে যে কেউ দলের নেতা হতে পারেন। আবার তিনি বাদও দিয়ে থাকেন। বিএনপির গঠনতন্ত্রেও দলীয় প্রধানকে একই রকম ক্ষমতা দেওয়া আছে।
তবে রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক গুঞ্জন আছে যে ‘মনোনয়ন–বাণিজ্যের’ কারণেই এবারে জাতীয় পার্টির মহাসচিব বদল হয়েছে। অনেক মনোনয়নপ্রত্যাশী প্রকাশ্যে অভিযোগ করেছেন। দলীয় অফিসে গিয়ে বিক্ষোভ করেছেন। তবে জাতীয় পার্টির একাধিক সূত্র বলেছে, যদি মনোনয়নের জন্য মনোনয়নপ্রত্যাশীদের কাছ থেকে টাকা নেওয়া হয়ে থাকে, সেটি দলের চেয়ারম্যানের সম্মতিতেই হয়েছে।
জাতীয় পার্টি এবারও আশা করেছিল, ২০১৪ সালের মতো বিএনপি ভোট বর্জন করবে। তাহলে বিরোধী দলের আসনটি তাদের জন্য স্থায়ী হয়ে যাবে। এরশাদ এ–ও বলেছেন, আওয়ামী লীগ ব্যর্থ হয়েছে। ভবিষ্যতে জাতীয় পার্টি এককভাবে সরকার গঠন করবে। এখন দেখা যাচ্ছে, আম–ছালা দুটোই যাচ্ছে।
সিঙ্গাপুরে যাওয়ার আগে এরশাদ দুটি কাজ অমীমাংসিত রেখে যান। এক. জাতীয় পার্টিকে মহাজোট কতটি আসন দিয়েছে, সেটি খোলসা করেননি। প্রথমে জাতীয় পার্টির নেতারা বললেন, তাঁরা মহাজোটের কাছে ১০০ আসন চাইবেন। অন্তত ৬০টি দিলে রাজি হবেন। দর-কষাকষির মাধ্যম হিসেবে তাঁরা ১৪৭টি আসনে লাঙ্গলের প্রার্থী দিয়ে রাখলেন; যার মধ্যে ঢাকা -১৭ আসনে এরশাদের নিজের প্রার্থিতাও ছিল। কিন্তু দর–কষাকষিতে শেষ পর্যন্ত জাতীয় পার্টি সুবিধা করতে পারেনি। আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টিকে ২৫টির বেশ আসন ছেড়ে দিতে রাজি হয়নি। এখন নৌকার অনেক আসনে লাঙ্গলের প্রার্থী আছেন। আবার লাঙ্গলের বেশ কয়েকটি আসনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী আছেন।
গত বৃহস্পতিবার ঢাকায় ফিরে এরশাদ নিজের বাসভবনে সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়ে দিলেন, ‘বোন’ শেখ হাসিনাকে পূর্ণ সমর্থন দিয়ে ঢাকা-১৭ আসন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। ওই আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আকবর হোসেন পাঠান ওরফে নায়ক ফারুক।
তিনি আরও বললেন, ‘ফারুক আমার কাছে এসেছিল। আমি তাঁকে বললাম, টাকা এনেছ। এরপর ফারুক বলল, টাকা তো নেই। তখন আমি বললাম, টাকা লাগবে না। আমি আসনটি তোমাকে ছেড়ে দিলাম।’
একই সংবাদ সম্মেলনে উন্মুক্ত (আওয়ামী লীগসহ ১৪ দলের প্রার্থী রয়েছে) ১৪৬টি আসন থেকেও জাপার প্রার্থীদের সরে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। এর তিন ঘণ্টা পর এরশাদের পক্ষে গণমাধ্যমে পাঠানো একটি বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, উন্মুক্ত আসনগুলো জাপার কোনো প্রার্থী সরে দাঁড়াচ্ছেন না। মহাজোট ব্যতীত জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা মুক্তভাবে নিজ নিজ আসনে লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন। কেউ নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াবেন না।
সন্ধ্যায় রাজধানীর বারিধারার নিজ বাসভবনে সংবাদ সম্মেলনে এরশাদ একটি লিখিত বক্তব্য পড়ে শুনিয়েছিলেন, যাতে বলা হয়, ‘মহাজোটের বৃহত্তর স্বার্থে এবং মহাজোটের প্রার্থীর বিজয় নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনবোধে বিভিন্ন আসনে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে জাতীয় পার্টির প্রতিটি নেতা-কর্মীকে মহাজোটের প্রার্থীর পক্ষে একত্রে কাজ করার অনুরোধ জানানো হয়েছিল। মহাজোটের স্বার্থে আমি নিজেও ঢাকা-১৭ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আকবর হোসেন পাঠান ফারুককে সমর্থন করছি।’
মহাজোটের শরিক দল হিসেবে ২৫টি আসন থেকে নির্বাচন করছে জাপা। এ ছাড়া ১৪৭ আসনে দলের প্রার্থী রয়েছে। ঢাকার আসনটি ছেড়ে দেওয়ায় এরশাদ এখন রংপুর-৩ আসন থেকে মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে এককভাবে নির্বাচন করছেন।
সংবাদ সম্মেলনে উন্মুক্ত আসনে জাপার প্রার্থীরা থাকছেন কি না, একাধিকবার জানতে চাওয়া হলে এরশাদ স্পষ্ট করেই তখন বলেছিলেন, ‘তারা থাকবে না।’ তিন ঘণ্টা পর বললেন, তাঁরা থাকবেন। এরশাদের ভুলো মন। কিছুক্ষণ আগে যা বলেন, মনে রাখতে পারেন না বা মনে রাখতে চান না। তিনি ঘনঘন সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন।
ক্ষমতায় থাকতে তাঁর পদবি ছিল সিএমএলএ বা প্রধান সামরিক প্রশাসক। মানুষ ঠাট্টা করে বলত, সিএমএলএর অর্থ হচ্ছে,‘ক্যানসেল মাই লাস্ট অ্যানাউন্সমেন্ট।’ ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে এরশাদ বলেছিলেন, কিসের নির্বাচন? বিএনপিকে ছাড়া কোনো নির্বাচন হবে না। এরপর দেশবাসী বিস্ময়ের সঙ্গে দেখল, তিনি বাসা থেকে সিএমএইচে স্থানান্তরিত হলেন বা হতে বাধ্য হলেন। তিনি যাঁদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের জন্য চিঠি দিলেন, তাঁদের অনেকের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার হয়ে গেলেও তিনি সাংসদ হয়ে গেলেন। সাংসদ থেকে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হলেন।
এরশাদের এই ‘ভুলোমন’ রাজনীতির জন্য জাতিকে অনেক খেসারত দিতে হয়েছে। তিনি একবার আওয়ামী লীগের ওপর রাগ করে বিএনপি ও জামায়াতের সঙ্গেও জোট করেছিলেন। ভবিষ্যতে সুযোগ পেলে যে আবার করবেন না, সে কথা কে বলতে পারে?
সংবাদ সম্মেলনে এরশাদ বলেছেন, ‘আমার বোন শেখ হাসিনাকে পূর্ণ সমর্থন দিচ্ছি। আমি নির্বাচনে “বোন” শেখ হাসিনাকে সর্বত্র সহযোগিতা করব।’
এই হলো সহযোগিতার নমুনা! তিন ঘণ্টা পরই তিনি সিদ্ধান্ত বদলালেন। এখন ১৪৬টি আসনে আওয়ামী লীগকে একই সঙ্গে ঐক্যফ্রন্ট ও জাতীয় পার্টির প্রার্থীকে মোকাবিলা করতে হবে। কোনো আসনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী ও জাতীয় পার্টির প্রার্থীর মধ্যে সমঝোতা হলে আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে বেকায়দায় পড়তে হবে।
স্নায়ুযুদ্ধের সময় আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে একটি কথা বেশ চালু ছিল। আমেরিকা যার বন্ধু, তার আর শত্রুর প্রয়োজন পড়ে না। বাংলাদেশের রাজনীতিতে সে কথাটি ঘুরিয়ে বলা যায়, ‘এরশাদ যার বন্ধু, তার আর শত্রুর প্রয়োজন হয় না।’ সেটি আমরা আশির দশক থেকেই দেখে আসছি।
সোহরাব হাসান: সাংবাদিক।