এরশাদ আর নেই—প্রথম আলোর অনলাইনে খবরটি পড়ে অতীতের অনেক কথাই মনে পড়ল। আজকের প্রজন্মের কাছে এরশাদ একজন রাজনীতিক, একটি দলের প্রধান এবং একাদশ জাতীয় সংসদের বিরোধী দলের নেতা। কিন্তু আমাদের প্রজন্ম এবং তারও আগের ও পরের প্রজন্ম এরশাদকে অন্যভাবে দেখেছে। বিশেষ করে যাঁরা তাঁর শাসনকালে নিগৃহীত হয়েছেন, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাঁরা তাঁকে ভিন্নভাবে মূল্যায়ন করবেন। সেই মূল্যায়ন করার আগে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে এই লেখাটি লিখছি।
১৯৩০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি অবিভক্ত ভারতের কোচবিহার জেলায় এরশাদের জন্ম। সেই হিসাবে তিনি দীর্ঘজীবন কাটিয়েছেন। তাঁর জীবনের দুটি দিক। একটি সেনা জীবন, আরেকটি রাজনৈতিক জীবন। বাংলাদেশের দুজন সেনাপ্রধান সেনাবাহিনীতে থাকতে সরাসরি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন—জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। আবার জিয়া যখন সেনাপ্রধান, তখন এরশাদ ছিলেন উপসেনাপ্রধান। তিনি সেনাবাহিনীর প্রধান হন জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনী থেকে অবসর নিয়ে রাষ্ট্রপতি পদ গ্রহণ করার পর।
১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে এক সেনা অভ্যুত্থানে জিয়া নিহত হওয়ার পর এরশাদ নতুন ভূমিকায় আসেন। জিয়ার ‘হত্যাকারীদের’ বিচারে তাঁর সমর্থন ও উৎসাহ ছিল। আবার ১৯৮১ সালের ১৫ নভেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ড. কামাল হোসেনের বিপরীতে বিচারপতি সাত্তারকে প্রকাশ্য সমর্থন জানিয়েছিলেন তিনি। এরশাদ মনে করেছিলেন, বয়োবৃদ্ধ বিচারপতিকে দিয়ে তিনি যা করাতে পারবেন, সেটি অন্যকে দিয়ে সম্ভব নয়। ১৫ নভেম্বরের নির্বাচনের পর এরশাদ ক্ষমতায় সেনাবাহিনীর হিস্যা পেতে ১২ দফা দাবিও পেশ করেছিলেন। তিনিই বিচারপতি সাত্তারকে দিয়ে জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল গঠন করিয়েছিলেন, যদিও সেটি তাঁর মনঃপূত হয়নি। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন বিএনপির মধ্যেও অন্তঃকলহ বাড়ছিল। রাষ্ট্রপতি জিয়া ৩০ মে চট্টগ্রামে গিয়েছিলেন দলের কলহ মেটাতেই। এই প্রেক্ষাপটে এরশাদ ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ ক্ষমতা দখল করেন এবং সংবিধান স্থগিত করে সেনা শাসন জারি করেন। তবে তিনি নিজে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হয়ে শিখণ্ডী রাষ্ট্রপতি পদে বসিয়েছিলেন বিচারপতি আহসানউদ্দিন আহমদকে। ১৯৮৩ সালের ১১ ডিসেম্বর তাঁকে সরিয়ে এরশাদ নিজেই রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন। এরপর এরশাদের শাসনকালের পুরোটাই ছিল ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ, আন্দোলনমুখর। শেষ পর্যন্ত গণ-অভ্যুত্থানের মুখে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
ধারণা করা গিয়েছিল, ক্ষমতা ত্যাগের মধ্য দিয়ে এরশাদ ও তাঁর সহযোগীদের রাজনৈতিক জীবন শেষ হবে। কিন্তু সেটি হয়নি। ক্ষমতাপিয়াসি দুই প্রধান দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যকার বিরোধের সুযোগ নিয়ে এরশাদ তাঁর রাজনৈতিক গুরুত্ব বহাল রাখতে পেরেছিলেন। দুই প্রধান দলের মধ্যে তিনি আওয়ামী লীগকে মিত্র হিসেবে নিয়েছিলেন। তিনি কখনো ভুলতে পারেননি যে খালেদার প্রথম পাঁচ বছরের শাসনের পুরোটাই তাঁকে জেল খাটতে হয়েছিল। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এরশাদের রাজনৈতিক শক্তিই ছিল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যকার বৈরিতা। বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতা যা-ই হোক না কেন, নব্বই ও শূন্য দশকে বাংলাদেশে কোনো দল এককভাবে ক্ষমতায় যাওয়ার কথা চিন্তা করতে পারেনি। এ কারণেই একদিকে ১৪ দলীয় জোট ও মহাজোট হয়েছে, অন্যদিকে চার দলীয় জোট হয়েছে।
এ কারণে অনেকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এরশাদকেই সবচেয়ে ভাগ্যবান রাজনীতিক বলে মনে করেন। নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যাকে ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছে, তিনিই গত ২৯ বছর ধরে রাজনীতির মাঠ দাপিয়ে বেড়িয়েছিলেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি ছিলেন সংসদে বিরোধী দলের নেতা।
অস্বীকার করার উপায় নেই, ষাট ও সত্তরের প্রজন্মকে আন্দোলিত করেছিল উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান ও একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ; স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনও তেমনি প্রাণিত করেছিল আশি ও নব্বইয়ের প্রজন্মকে। এই আন্দোলন কেবল রাজনীতিকদের ছিল না, বরং রাজনীতিকেরা একটু পরেই এসেছেন। অনেকে দ্বিধান্বিত ছিলেন। ছাত্র-তরুণ, পেশাজীবী ও সংস্কৃতিসেবীরা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত রাজপথে ছিলেন। সেলিম, দেলোয়ার, বসুনিয়া, দীপালি সহা, তাজুল, নূর হোসেন, মিলনসহ বহু তরুণ জীবন দিয়েছেন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য।
জনগণের ভেতর থেকে গড়ে ওঠা সেই আন্দোলন একপর্যায়ে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল এবং তাঁদের ঐক্যের কারণেই স্বৈরাচারের পতন ঘটেছিল। আবার গণতান্ত্রিক শক্তির বিরোধ ও বিভক্তির সুযোগে স্বৈরাচার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
এরশাদবিরোধী আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে ১৯৯০ সালের ২০ নভেম্বর আন্দোলনরত তিন জোট আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ৮ দল, বিএনপি নেতৃত্বাধীন ৭ দল ও বামপন্থী ৫ দলীয় জোট গণতন্ত্র উত্তরণে যে রূপরেখা দিয়েছিল, তা গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অনন্য দলিল হয়ে আছে। এই দলিলে হত্যা, ক্যু, ষড়যন্ত্রের রাজনীতির অবসান, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে ‘সার্বভৌম সংসদ’ প্রতিষ্ঠা, নাগরিকের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সমুন্নত রাখা, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, মৌলিক অধিকারপরিপন্থী আইন রহিত করার কথা বলা হয়েছিল। আর তিন জোট ঘোষিত আচরণবিধিতে ‘স্বৈরাচারের চিহ্নিত সহযোগী ও অস্ত্রধারীদের’ দলে না নেওয়া, নির্বাচনী বক্তব্যে ব্যক্তিগত কুৎসা রটনা না করা, অপর দলের দেশপ্রেম বা অপর ব্যক্তির ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে কটাক্ষ না করারও অঙ্গীকার ছিল।
রাজনৈতিক জীবন যতই প্রলম্বিত হোক, সুযোগ পেয়েও এরশাদ নিজেকে নিষ্কলুষ প্রমাণ করতে পারেননি। দুর্নীতির দায়ে জেল খেটেছেন। মৃত্যুর সময়েও তাঁর বিরুদ্ধে মঞ্জুর হত্যা মামলা ছিল। মামলা আরও অনেক রাজনীতিকের বিরুদ্ধে ছিল এবং আছে। শুধু মামলার সংখ্যা দিয়ে একজন রাজনীতিককে বিচার করা যাবে না। সেই বিচার করতে হলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও অনুশীলনে কে কতটুকু ভূমিকা রেখেছেন, সেটা দেখতে হবে। ক্ষমতার বাইরে থাকতে আমাদের রাজনীতিকেরা গণতন্ত্রের যেসব বুলি আওড়ান, ক্ষমতায় গিয়ে তার সিকিভাগও পালন করেন না। এ ব্যাপারে এরশাদ ব্যতিক্রম নন বলেই তাঁর সমর্থকেরা তাঁকে অন্যদের সঙ্গে তুলনা করে দেখেছেন। এটাই এরশাদের রাজনৈতিক জীবনকে প্রলম্বিত করেছে। মানুষ এরশাদের শাসনের সঙ্গে তাঁর আগের ও পরের শাসনকেও মিলিয়ে দেখছে। এরশাদ একবার বলেছিলেন, ‘আমাকে স্বৈরাচারী বলা হয় কিন্তু আমার চেয়েও অনেক বড় স্বৈরাচারী আছেন। আমি যদি স্বৈরাচার হয়েও থাকি ছোট স্বৈরাচার।’
এরশাদ প্রয়াত হয়েছেন। সময়ই বলে দেবে বাংলাদেশের মানুষ তাঁকে কীভাবে বিচার করবে। তবে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তিনি যত অন্যায় ও অসংগত আচরণ করুন না কেন, একটি কথা স্বীকার করতে হবে, স্বাধীনতা-পরবর্তী দশকজুড়ে সেনাবাহিনীতে যে বিশৃঙ্খলা ও উপদলীয় সংঘাত ছিল, সেটি এরশাদ প্রশমিত করেছেন। জিয়ার আমলে ১৭/১৮টি সেনা অভ্যুত্থান হলেও এরশাদের আমলে একটি অভ্যুত্থানও হয়নি। এরশাদের জনগণের আস্থা অর্জন করতে না পারলেও তিনি যে বাহিনীর প্রধান ছিলেন, তার সদস্যদের আস্থা অর্জন করেছিলেন।
মৃত্যুর আগেই এরশাদ তাঁর দল জাতীয় পার্টিতে উত্তরাধিকার নির্বাচন করে গেছেন। ছোট ভাই গোলাম কাদেরকে দলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান এবং স্ত্রী রওশনকে সংসদে উপনেতা করে গেছেন। এখন তাঁর অনুপস্থিতিতে দলের নেতা-কর্মীরা এই ব্যবস্থাপত্র মেনে নেবেন কি না, আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাঁর দলের বোঝাপড়া ঠিক থাকবে কি না, সেটিই দেখার অপেক্ষা।
সোহরাব হাসান, প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি।