এরদোয়ানের সঙ্গে কার্যকর কোনো চুক্তি করতে হলে মস্কোকে অনেক বড় মূল্য চুকাতে হবে
এরদোয়ানের সঙ্গে কার্যকর কোনো চুক্তি করতে হলে মস্কোকে অনেক বড় মূল্য চুকাতে হবে

এরদোয়ানের সিরিয়া অভিযানে প্রধান বাধা রাশিয়া নাকি যুক্তরাষ্ট্র

বিশ্বের মনোযোগ যখন ইউক্রেনের ওপর চাপিয়ে দেওয়া রাশিয়ার যুদ্ধের ওপর নিবদ্ধ, ঠিক তখনই তুরস্ক সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ পরিচালনার প্রস্তুতি নিচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের কৌশলগত লক্ষ্য অর্জনের জন্য আঙ্কারা পূর্ব ইউরোপের সংঘাতময় পরিস্থিতিকে সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করেছে। এটা এখন আর গোপন কোনো বিষয় নয় যে সিরিয়া সীমান্তের ভেতরে ৩০ কিলোমিটারের একটা নিরাপদ অঞ্চল সৃষ্টির লক্ষ্য রয়েছে তুরস্কের। কিন্তু সেটা করার জন্য প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানকে ন্যাটোর ক্ষমতাধর সঙ্গী যুক্তরাষ্ট্রের সবুজসংকেত পেতে হবে। একই সঙ্গে বন্ধুবেশী শত্রু রাশিয়ারও মৌন সমর্থন পেতে হবে।

তুরস্কের সামরিক অভিযানে এখন উত্তর সিরিয়ার তেল রিফাত, কোবানি, আইনাস্যা ও ম্যানবিজ শহরগুলো দখলে নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। বর্তমানে অঞ্চলটি কুর্দি নিয়ন্ত্রিত পিপলস প্রটেকশন ইউনিটসের (ওয়াইপিজি) অধিকারে রয়েছে। তুরস্ক ওয়াইপিজিকে সন্ত্রাসী সংগঠন এবং বেআইনি কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টির (পিকেকে) অংশ বলে মনে করে। এরদোয়ানের জন্য এখন মূল সমস্যা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র ওয়াইপিজিকে আবার ইসলামিক স্টেটের (আইএসআইএস) বিরুদ্ধে একটি মিত্রশক্তি বলে মনে করে। কুর্দিদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র কি আবার ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ করবে?

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র নেড প্রাইসের সাম্প্রতিক বক্তব্য থেকে এটা বোঝা যাচ্ছে যে যুক্তরাষ্ট্র ও তুরস্ক এখনো উত্তর সিরিয়ার ব্যাপারে মতৈকে পৌঁছাতে পারেনি। প্রাইস বলেছেন, ‘সীমান্তে তুরস্কের বৈধ যে নিরাপত্তা উদ্বেগ, সেটাকে আমরা স্বীকৃতি দিই। কিন্তু আবার, আমাদের উদ্বেগের কারণ হচ্ছে, নতুন কোনো পদক্ষেপ ওই অঞ্চলের স্থিতিশীলতাকে নষ্ট করবে।’

সিরিয়ার কুর্দিদের ভাগ্য রাশিয়ার চেয়ে অনেক গুণ বেশি নির্ভর করছে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর। ওয়াশিংটন যদি আঙ্কারার পরিকল্পনায় সাড়া দেয়, তাহলে উত্তর সিরিয়ার গুরুত্বপূর্ণ অংশের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করবে তুরস্ক। ভবিষ্যতে এই ভূখণ্ডকে তারা দামেস্কে প্রেসিডেন্ট আসাদের বিরুদ্ধে ব্যবহারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার সুযোগ পাবে।

ন্যাটোর সদস্য হতে ফিনল্যান্ড ও সুইডেন যে আবেদন করেছে, তাতে যেন তুরস্ক অন্তর্ঘাত সৃষ্টি না করতে পারে, সে জন্য তুরস্ককে ওয়াশিংটনের প্রয়োজন। এ কারণে পূর্ণ সম্ভাবনা আছে যে যুক্তরাষ্ট্র শিগগিরই উত্তর সিরিয়ায় তুরস্কের সামরিক অভিযানকে চুপিসারে সমর্থন দিয়ে দেবে।

বাইরের শক্তির সমর্থন ছাড়া কুর্দিদের পক্ষে তুরস্কের সামরিক বাহিনী এবং ইদলিবে অবস্থানরত তাদের প্রক্সি বাহিনীর সম্মিলিত আক্রমণে টিকে থাকা অসম্ভব। যুক্তরাষ্ট্র যদি তুরস্ককে উত্তর সিরিয়ায় সামরিক অভিযান থেকে বিরত রাখতে না পারে, তাহলে কুর্দিরা তাদের কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ এলাকা থেকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ হারাবে। তবে এখনো গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে, তুরস্কের সামরিক বাহিনী কি ম্যানবিজ অধিকার করতে পারবে? সিরিয়ার পশ্চিম ও পূর্বের মধ্যে সংযোগকারী এম-৪ নামের মহাসড়কের প্রধান সংযোগস্থলে এ শহরটির অবস্থান। রাশিয়ার সেনারা এই সড়ক নিয়মিত টহল দেয়। ক্রেমলিনের সঙ্গে কোনো বোঝাপড়ায় আসার আগে তুরস্ক ম্যানবিজে আক্রমণ করবে না বলেই মনে হয়।

রাশিয়ার প্রেক্ষাপটে ম্যানজিবের সঙ্গে ইদলিবের জাবাল আল-জাইওয়া বদল করে নেওয়াটা হবে সবচেয়ে ভালো বিকল্প। কিন্তু আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রাশিয়ার এখনকার দুর্বল অবস্থান এবং ইউক্রেনে তাদের সামরিক ব্যর্থতা—এ দুই কারণে তুরস্ক রাশিয়ার সঙ্গে এ রকম কোনো বোঝাপড়ায় যাবে বলে মনে হয় না। বরং ম্যানবিজ অভিযানে বিরত থেকে মস্কোর কাছ থেকে অর্থনৈতিক কিছু সুবিধা পাওয়ার চেষ্টা করবে বলে মনে হয় তুরস্ক। রাশিয়ার জ্বালানি ও খাদ্যশস্য কম দামে পাওয়ার চেষ্টা তারা করবে। রাশিয়া এখন যে একঘরে অবস্থায় রয়েছে, তাতে তুরস্কের ওপর কোনো শর্ত আরোপ করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। এর মানে হচ্ছে, এরদোয়ানের সঙ্গে কার্যকর কোনো চুক্তি করতে হলে মস্কোকে অনেক বড় মূল্য চুকাতে হবে।

গণমাধ্যমের খবরে জানা যাচ্ছে, সিরিয়া থেকে তাদের কিছু সেনা ইউক্রেনে নিয়োগ করেছে রাশিয়া। এ থেকেও বড় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ সম্প্রতি বলেছেন, ‘সিরিয়াতে যে লক্ষ্য নিয়ে রাশিয়ার সেনারা গিয়েছিল, তার প্রায় সবটাই অর্জিত হয়েছে।’ এ বক্তব্য থেকে যে ইঙ্গিত স্পষ্ট করে মিলছে, সেটা হলো সিরিয়া এখন রাশিয়ার অগ্রাধিকারের বিষয় নয়।

এ ক্ষেত্রে ক্রেমলিনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে যাতে নতুন কোনো উত্তেজনা সৃষ্টি না হয়, তা এড়ানো এবং তুরস্কের সঙ্গে তুলনামূলকভাবে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখা। সবকিছুর বিচারে এটা ভাবা অভাবনীয় হবে না যে তুরস্ক যদি সিরিয়াতে নতুন করে আক্রমণ শুরু করে, তাহলে সেটা দেখেও না দেখার ভান করবে রাশিয়া। যদিও এ ধরনের ঘটনা ক্রেমলিনের জন্য আরেকটি অপমানকর বিষয় হবে।

সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল–আসাদের ঘনিষ্ঠ মিত্র রাশিয়া। তা সত্ত্বেও বাস্তবতা এখন যা, তাতে মস্কো সিরিয়ার সার্বভৌমত্ব ও ভূখণ্ডগত অখণ্ডতা রক্ষার নিশ্চয়তা দিতে পারবে না। তবে রাশিয়ার নিষ্ক্রিয়তার মানে হচ্ছে, ক্রেমলিনের ওপর আঙ্কারার আধিপত্যকে স্বীকার করে নেওয়া। এ ক্ষেত্রে রাশিয়া তুরস্কের হামলার প্রতিক্রিয়ায় সিরিয়ার আসাদ বাহিনীকে দিয়ে ইদলিবে সামরিক হামলা শুরু করে দিতে পারে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, আসাদের বাহিনী এমন কোনো অভিযানে জড়াতে আগ্রহী নয়, যেখানে তুরস্কের সেনাবাহিনী কিংবা তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় পালিত সিরিয়ান ন্যাশনাল আর্মির মতো প্রক্সি বাহিনীর উপস্থিতি রয়েছে।

এদিকে উত্তর সিরিয়ায় এরদোয়ানের অভিযান ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় রাশিয়া, তুরস্কের সীমান্তবর্তী একটি ঘাঁটিতে যুদ্ধ বিমান ও হেলিকপ্টার গানশিপ পাঠিয়েছে। এ পদক্ষেপ আঙ্কারার প্রতি ক্রেমলিনের বার্তা। কিন্তু ইউক্রেনে রাশিয়ার সেনাবাহিনীর লেজেগোবরে অভিযান সম্পর্কে তুরস্ক খুব ভালো করেই জানে। এ ছাড়া ভূরাজনৈতিক হাওয়া এখন রাশিয়ার পক্ষে নেই, সেটাও তারা ভালো করে জানে। এ বিবেচনায় সীমান্তবর্তী ঘাঁটিতে রাশিয়ার যুদ্ধসরঞ্জাম মোতায়েনের বিষয়টা তুরস্কের কাছে খালি কলসির আওয়াজের মতোই মনে হবে। তুরস্কের সামরিক পরিকল্পনার ক্ষেত্রে এটি বাধা হয়ে দাঁড়াবে না।

সিরিয়ার কুর্দিদের ভাগ্য রাশিয়ার চেয়ে অনেক গুণ বেশি নির্ভর করছে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর। ওয়াশিংটন যদি আঙ্কারার পরিকল্পনায় সাড়া দেয়, তাহলে উত্তর সিরিয়ার গুরুত্বপূর্ণ অংশের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করবে তুরস্ক। ভবিষ্যতে এই ভূখণ্ডকে তারা দামেস্কে প্রেসিডেন্ট আসাদের বিরুদ্ধে ব্যবহারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার সুযোগ পাবে।

এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ মনোজ দে
নিকোলা মিকোভিচ সার্বীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং রাশিয়া, ইউক্রেন ও বেলারুশের বিদেশনীতি সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ