পশ্চিমা ধাঁচের সেক্যুলার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সঙ্গে মুসলিম বিশ্বের বোঝাপড়ার জায়গাটা সহনীয় করার তাগিদেই ইরাক ও আফগানিস্তান যুদ্ধের ভয়াবহতার মধ্যে তুরস্কে ইসলামপন্থী দল একেপির উত্থান। একেপির অর্থনৈতিক কর্মপন্থা আর এরদোয়ানের রাজনৈতিক দূরদর্শিতায় তুরস্কের পাকাপোক্ত জায়গা হয় বিশ্বরাজনীতিতে। কিন্তু সিরিয়া যুদ্ধের গতিপথ নির্ধারণে আমেরিকান জোটের সিদ্ধান্তে অমত এবং ক্ষেত্রবিশেষে প্রতিরোধ, ভঙ্গুর অর্থনীতি আর অভ্যন্তরীণ কোন্দল এরদোয়ান ও একেপির সুসময়ের ইতি দেখাচ্ছে। একেপি থেকে বের হয়ে যাওয়া এরদোয়ানের এককালের সহযোদ্ধা আলী বাবাজান, আবদুল্লাহ গুল আর আহমেদ দাভুতোগলুর নেতৃত্বে নতুন দুইয়ের অধিক রাজনৈতিক দল গঠন এখন সময়ের ব্যাপার।
২০০৩ পর থেকে এরদোয়ানের দাপটে বিশ্ব নতুন এক তুরস্ককে জেনেছে। বিদেশ নীতিতে ছিল সবার সঙ্গে শান্তি আর অর্থনীতিতে ছিল বিস্ময়কর উত্থান। ইচ্ছা আর বাস্তববাদী অর্থনৈতিক সংস্কার দিয়ে একেপির কল্যাণে ইউরোপের রুগ্ণ দেশের তকমা ছেড়ে তুরস্ক আজ বিশ্বের ১৭তম বৃহত্তম অর্থনীতি। অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে আদর্শিক চিন্তাচেতনায়ও এরদোয়ানের উদারপন্থী সংস্কার ছিল সর্বমহলে গৃহীত। বিশেষ করে ইউরোপকেন্দ্রিক চিন্তার জগৎ থেকে বের হয়ে নিজস্ব ধরনের ‘সেক্যুলার রাষ্ট্র’ তৈরির ধারণা, মুসলিম বিশ্বে নতুন করে রাষ্ট্রের সঙ্গে রক্ষণশীল জনতার আপস–মীমাংসার আশা জাগিয়েছিল। কিন্তু সবকিছুই এখন ইতিহাস। এখন বিশ্ব জানে এক স্বৈরাচার ও রক্ষণশীল এরদোয়ানকে। সাম্প্রতিক নির্বাচনে উপর্যুপরি পরাজয় আর একেপি ভেঙে নতুন দল গঠনের সমাচার আরব বিশ্বসহ মুসলিম বিশ্বে আবার নতুন করে ইসলাম ও পাশ্চাত্য গণতন্ত্র সামঞ্জস্যপূর্ণ কি না, সেই বিতর্ক শুরু করবে।
এরদোয়ানের একচ্ছত্র ক্ষমতা নিশ্চিত করায় একেপি থেকে বহিষ্কারের দীর্ঘ তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন আলী বাবাজান। আইনের মারপ্যাঁচে আবদুল্লাহ গুল ও দাভুতোগলুর সদস্যপদ এখনো বহাল। গত প্রায় ২০ বছরে একেপিতে যোগ–বিয়োগ হয়েছে, কিন্তু এরদোয়ান ও তাঁর প্রতিপত্তি কখনোই প্রাধান্য হারায়নি। ধীরে ধীরে রাষ্ট্রের ও পার্টির সংবিধানের আশ্রয় নিয়ে বিদায় করেছেন আবদুল্লাহ গুল থেকে শুরু করে একেপির প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের অনেককেই—যাঁদের কর্মঠ ও দুর্দান্ত নীতি প্রণয়ন ছিল একেপির সাফল্যের চাবিকাঠি।
গুল বিদায় নিয়েছেন সংবিধানের মারপ্যাঁচে। ২০১৪ সালে রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন শেষে গুলের একেপিতে ফেরার কথা ছিল। কিন্তু মেয়াদ শেষের আগের দিন এরদোয়ান একেপির জরুরি জাতীয় সম্মেলন ডেকে গুলেরই কাছের মানুষ আহমেদ দাভুতোগলুকে একেপি চেয়ারম্যান ও প্রধানমন্ত্রী মনোনীত করে এক ঢিলে দুই পাখি শিকার করেন। এতে গুলের একেপিতে ফেরা আটকে যায় এবং সমালোচকদের মুখও বন্ধ হয়। দীর্ঘদিনের বন্ধুর ইচ্ছায় রাজনৈতিক জীবন খতম হলে গুল নিভৃত জীবন বেছে নিলেও ধীরে ধীরে প্রকাশ্য হতে থাকে এরদোয়ান-গুলের কলহ। এই বিবাদ আর মতবিরোধের আখ্যান বর্ণনা করা হয়েছে গুলের সাবেক সহকারী আহমেদ সেভেরের “12 Years with Abdullah Gül” গ্রন্থে। দীর্ঘ বিরতির পর ২০১৮ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে তুরস্কের মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থনে এরদোয়ানের বিরুদ্ধে গুলের প্রার্থিতা ব্যাপকভাবে আলোচিত হলেও আলোর মুখ দেখেনি।
দায়িত্ব নেওয়ার পর দাভুতোগলু একেপির মধ্যে নিজস্ব বলয় তৈরির চেষ্টা করেন। ফলে দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক ঐতিহ্য ভেঙে একেপিতে এরদোয়ান-দাভুতোগলু শিবির তৈরি হয়। এটা ছিল এরদোয়ানের একচ্ছত্র নেতৃত্বের প্রতি প্রথম কোনো সংঘবদ্ধ হুমকি। একেপির অভ্যন্তরীণ এই অস্থিতিশীলতার সুযোগে গুলেন মুভমেন্টের সদস্যরা—দাভুতোগলুর জ্ঞাতে অথবা অজ্ঞাতে—আবার সরকারের বড় বড় পদে আসীন হন। এর মধ্যে সিরিয়ার যুদ্ধ ও উদ্বাস্তুদের আগমন, রুশ যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করা, তুরস্কের অভ্যন্তরে কুর্দি গেরিলাদের আক্রমণ পুরো পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে। এই ঘোলা পানিতেই দাভুতোগলু আবার হুট করে ২০১৫ গ্রীষ্মের নির্বাচনে এরদোয়ানের বিশ্বস্ত তুরস্কের জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান হাকান ফিদানকে ইস্তাম্বুল থেকে একেপি প্রার্থী ঘোষণা করেন। ফিদানের প্রার্থিতা এরদোয়ানকে রাজনীতি থেকে ছেঁটে ফেলার সন্দেহকে আরও বেশি মজবুত করে। তবে নিন্দুকেরা গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান থেকে ফিদানের প্রস্থানকে গুলেন মুভমেন্টের ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতাই মনে করেন।
এরদোয়ানের প্রকাশ্য বিরোধিতায় ফিদান জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানের পদে ফিরলেও এরদোয়ান-দাভুতোগলু সম্পর্ক আর সুদিনে ফেরেনি। ২০১৫ সালের সেই নির্বাচনে একেপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ার পর বিরোধী দলের সঙ্গে দাভুতোগলুর জোটবদ্ধ হয়ে সরকার গঠনের ইচ্ছা একেপি থেকে দাভুতোগলুর প্রস্থান নিশ্চিত করে। এরদোয়ান ‘জোট সরকারের’ চিন্তা বাতিল করে আবার নির্বাচনে গিয়ে একেপিকে প্রায় ৫০ শতাংশ ভোটে বিজয়ী করান। নতুন সরকার গঠনের ছয় মাসের মাথায় এরদোয়ানের নির্দেশে দাভুতোগলু পদত্যাগে বাধ্য হয়ে প্রমাণ করেন যে এরদোয়ানের ছায়া থেকে বের হওয়ার কোনো প্রচেষ্টাই এরদোয়ানের প্রাচীর ভাঙেনি, বরং দাভুতোগলুর প্রধানমন্ত্রিত্বকেই ভেঙে ফেলেছিল।
আবদুল্লাহ গুলের মতোই দীর্ঘ নীরবতার পর গত মার্চের স্থানীয় নির্বাচনে ফিরে আসেন আহমেদ দাভুতোগলু। আঙ্কারা ইস্তাম্বুলসহ অর্ধেকের বেশি বড় শহরে একেপির পরাজয়ের জন্য এরদোয়ানকেই দায়ী করে তিনি ১৭ পাতার ঘোষণাপত্র প্রকাশ করেন। এতে একেপি ও সরকারের মধ্যে স্বজনপ্রীতি ও সীমাহীন দুর্নীতি রোধে পদক্ষেপ নেওয়া, আইনের শাসন, বাক্স্বাধীনতা রক্ষাসহ ভঙ্গুর অর্থনীতি সচলের দাবি তোলা হয়। এসব দাবির মধ্যে প্রভাব বিস্তার করেছিল দাভুতোগলুর কল্পিত ‘ইসলামি রাষ্ট্রের’ অবয়ব।
তবে সাবেক উপপ্রধানমন্ত্রী অর্থমন্ত্রী আলী বাবাজান নির্বাচনের পরের দিনই এরদোয়ানের সঙ্গে সাক্ষাতের পর পদত্যাগ করেন। পদত্যাগ–পরবর্তী বার্তায় তুরস্কের একটি পরিষ্কার রাজনৈতিক ভিশনের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করেন। তবে এই রাজনৈতিক ভিশনের আড়ালে ইউরোপ থেকে দূরে সরে যাওয়া তুরস্ককে আবার ইউরোপর সঙ্গে যুক্ত করার সুরের প্রাধান্য ছিল। পাশ্চাত্যের বড় বড় অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানে সমাদর পাওয়া বাবাজান তুরস্কের জনপরিসরে শ্রদ্ধাভাজন ও দক্ষ হিসেবে জনপ্রিয়। একেপি থেকে তাঁর এই প্রস্থান নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের প্রথম পদক্ষেপ, যদিও আনুষ্ঠানিক দিন-তারিখ এখনো পরিষ্কার নয়। তবে এ বছরের শেষ নাগাদ নাম ঘোষণা হতে যাওয়া ওই পার্টিতে সাবেক রাষ্ট্রপতি ও একেপির সহপ্রতিষ্ঠাতা আবদুল্লাহ গুলের সমর্থনই শুধু না, বরং দলের প্রধান পথনির্দেশক হওয়ার খবরের সত্যতা নিশ্চিত করেছে অনেক তুর্কি সংবাদমাধ্যম।
ভোটের রাজনীতিতে বাবাজান-গুল-দাভুতোগলুর ময়দান দখলের পরিধি আপাত পরিষ্কার না। তবে এই বিরোধিতা দাপ্তরিকভাবে এরদোয়ানকে নিরঙ্কুশভাবে ক্ষমতায় টিকতে দেবে না। রক্ষণশীল ভোটব্যাংকের এই ভাগাভাগিতে প্রধান বিরোধী দল সিএসপি নিজেদের সুদিন দেখেই প্রায় চার যুগ পর আবার ক্ষমতায় ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছে। জটিল এই সমীকরণে কট্টর এরদোয়ানপন্থীদের আশার আলো বাবাজান-দাভুতোগলুর কলহ ও কুর্দি ভোট। বাবাজানের দাভুতোগলুর রক্ষণশীলতায় অনাগ্রহ আর কুর্দিদের মধ্যে এরদোয়ানের জনপ্রিয়তার পুনরুত্থানই এরদোয়ানের গদি সুরক্ষিত করতে পারে। তবে শিগগিরই বাবাজান-গুল-দাভুতোগলুর তুরস্কের সিরিসেনা আর এরদোয়ানের মাহিন্দ্রা রাজাপক্ষে বনে যাওয়ার আর সুযোগ নেই। অপেক্ষা করতে হবে ২০২৩ সালের নির্বাচন পর্যন্ত।
রাহুল আনজুম: ইস্তাম্বুলে বসবাসরত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞানের প্রাক্তন শিক্ষার্থী।