মন্তব্য প্রতিবেদন

এমন নৃশংস ঘটনা আর চাই না

২১ আগস্টের হামলার পর। তখনো আইভি রহমান (বসা) বেঁচে ছিলেন। ফাইল ছবি
২১ আগস্টের হামলার পর। তখনো আইভি রহমান (বসা) বেঁচে ছিলেন।  ফাইল ছবি

১৫ বছর আগে, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগের সমাবেশে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় সে সময়ের বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের নেতারা অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছিলেন। তবে আইভি রহমানসহ আওয়ামী লীগের ২২ নেতা-কর্মী নিহত হয়েছিলেন। আহত হয়েছিলেন কয়েক শ মানুষ। তাঁদের অনেকেই চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেছেন। তাঁদের কেউ কেউ আর স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাননি।

সেদিন বিকেলে ইসলামি জঙ্গিগোষ্ঠী হরকাতুল জিহাদের গ্রেনেড হামলায় আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনাসহ দলের মূল নেতৃত্ব নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলে দেশের জন্য তা এক ভয়ংকর পরিস্থিতি তৈরি হতো।

হরকাতুল জিহাদের নেতা মুফতি আবদুল হান্নান এবং গ্রেপ্তারকৃত জঙ্গিদের দেওয়া তথ্যানুযায়ী এটা দেশবাসীর কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মূল লক্ষ্য ছিল শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের হত্যা করা।

কিন্তু আমাদের মনে আছে, ২০০৪ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের পক্ষ থেকে এমন অবিশ্বাস্য কথাও প্রচার করা হয়েছিল, আওয়ামী লীগ নিজেরাই জনগণের সহানুভূতি ও সমর্থন পেতে ওই গ্রেনেড হামলা চালিয়েছিল। তাদের বক্তব্য ছিল, গ্রেনেড হামলা এমনভাবে করা হয়েছে যেন শেখ হাসিনা বেঁচে যান এবং বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট সরকারকে একটি বিব্রতকর অবস্থায় ফেলা যায়।

২০০৪ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদেও জোট সরকারের সাংসদেরা ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলার জন্য আওয়ামী লীগকে দায়ী করে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। তাঁরা বলেছিলেন, জনগণের ভোটে ক্ষমতায় যেতে ব্যর্থ হয়ে এখন নৈরাজ্যের মাধ্যমে তারা (আওয়ামী লীগ) ক্ষমতায় যেতে চায়। সেই ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই আওয়ামী লীগের সমাবেশে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা ঘটানো হয়েছে। তখন বিএনপি ওই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের জন্য আওয়ামী লীগ ছাড়াও প্রতিবেশী দেশ ভারতের প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করেছিল।

চারদলীয় জোট সরকারের গঠিত এক সদস্যের বিচার বিভাগীয় কমিশনের প্রধান বিচারপতি জয়নুল আবেদীন (তখন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে কর্মরত) তাঁর প্রতিবেদনে প্রায় একই কথা বলেছিলেন। মাত্র ৪০ দিনের অনুসন্ধানে প্রস্তুত সেই তথাকথিত তদন্ত প্রতিবেদনে সেসব মনগড়া তথ্য-ব্যাখ্যাই দেওয়া হয়েছিল, যা জোট সরকারের নেতা-মন্ত্রীরা বলেছিলেন।

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার দেশবাসীকে এটা বিশ্বাস করানোর চেষ্টা করেছিল যে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার পরিকল্পনা অনুযায়ী গ্রেনেড হামলার ঘটনা ঘটেছে। কলকাতায় পলাতক শীর্ষস্থানীয় সন্ত্রাসী সুব্রত বাইনের নেতৃত্বে এই গ্রেনেড হামলার পরিকল্পনা হয়েছিল। চারদলীয় জোট সরকার ও গোয়েন্দা সূত্রের বরাত দিয়ে ওই সব মিথ্যা তথ্য জোট সরকারের সমর্থক পত্রপত্রিকায় প্রচারও করা হয়েছিল। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সমর্থক লেখক ও বুদ্ধিজীবীরা সভা-সেমিনারে একই সুরে বক্তব্য দিয়ে, পত্রিকায় কলাম লিখে সেই মিথ্যা প্রচারে সহায়তা করেছিলেন।

বিএনপির নেতৃত্ব এই মিথ্যা প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছিলেন যে সাতক্ষীরা সীমান্ত দিয়ে ভারতের বসিরহাট থেকে গ্রেনেড এনেছিল ঢাকার বাড্ডার সন্ত্রাসী মুকুল। এ ঘটনায় জড়িত থাকার মিথ্যা অভিযোগে সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার রাজধানীর মগবাজারের আওয়ামী লীগের নেতা মোখলেসুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। পরে তিনি জামিনে বের হয়ে সাংবাদিকদের জানান, সিআইডির কর্মকর্তারা তাঁকে রাজসাক্ষী বানানোর কথা বলে আওয়ামী লীগের নেতাদের বিরুদ্ধে আদালতে স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য চাপ দিয়েছিলেন।

একইভাবে তদন্তকে ভিন্ন খাতে নিতে ২০০৫ সালের জুন মাসে জজ মিয়া নামের এক যুবককে নোয়াখালীর সেনবাগ থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। এই জজ মিয়াকে দিয়ে সিআইডি তখন আদালতে কথিত স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায় করে। তাতে নাকি জজ মিয়া বলেছিলেন, টাকার বিনিময়ে সুব্রত বাইনের পরিকল্পনা ও নির্দেশে তিনি নিজেসহ ১৪ জনের একটি দল এই গ্রেনেড হামলায় জড়িত ছিলেন। ওই জবানবন্দিতে জজ মিয়া বলেছিলেন, এর আগে তিনি গ্রেনেড কী জিনিস চোখে দেখেননি। বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ ফটকে খালি জায়গায় বসে কীভাবে গ্রেনেড ছুড়তে হয়, কীভাবে হামলা করতে হবে, তা সুব্রত বাইনরা বলে দিয়েছিল এবং সেভাবে হামলা করা হয়েছিল। অবশ্য পরে জজ মিয়ার মা ও বোন সাংবাদিকদের জানান, জজ মিয়াকে রাজসাক্ষী সাজানোর ঘটনায় সিআইডি ভূমিকা পালন করেছিল। এই সংস্থার তৎকালীন এক বিশেষ পুলিশ সুপার তাঁদের পারিবারিক খরচ চালানোর জন্য প্রতিমাসে নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা দিতেন। জোট সরকারের শেষ দিকে এসব তথ্য ফাঁস হয়ে যায় প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে।

অবশ্য জজ মিয়া আখ্যান নিয়ে প্রথম আলো একেবারে শুরুতেই প্রশ্ন তুলেছিল এবং সন্দেহ প্রকাশ করেছিল। তখন শিশির ভট্টাচার্য্যের একটি কার্টুনসহ প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে জজ মিয়ার কাহিনিকে ‘আষাঢ়ে গল্প’ বলে উল্লেখ করা হয়েছিল (২৯ জুন ২০০৫)। সে সময়ে নানাভাবে বিএনপি সরকারের নেতারা আমাদের বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন, কীভাবে সীমান্তের ওপার থেকে পরিকল্পনা হয়েছে, কীভাবে সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন ও তার সঙ্গীরা এই গ্রেনেড হামলা চালিয়েছে, তা তাঁরা প্রমাণ করে দেবেন। অবশ্য সেটা আর প্রমাণ করতে পারেননি তাঁরা; বরং সত্যকে লুকিয়ে রাখতে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত সত্য লুকিয়ে রাখতে পারেননি।

২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসায় পুরো পরিস্থিতি পাল্টে যায়। ওই বছরের আগস্টে নতুন করে ২১ আগস্ট মামলার তদন্ত শুরু হয়। নেপথ্যের অনেক তথ্যই বেরিয়ে আসতে থাকে। তখন এটা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়ে যায় যে জোট সরকার জেনেশুনে সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ঘটনা এবং উগ্র জঙ্গিগোষ্ঠী ও প্রকৃত আসামিদের আড়াল করার চেষ্টা করেছিল।

বিএনপি জোট সরকার ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা তখন বলার চেষ্টা করছিলেন যে পুলিশ ও সিআইডি তাঁদের ভুল বুঝিয়েছিল। উদ্দেশ্যপূর্ণ তথ্য দিয়ে তাঁদের বিভ্রান্ত করেছিল। পরে তাঁরা যখন সত্য জানতে পারেন, তখন আর তাঁদের কিছু করার সময় ছিল না। কিন্তু তাঁদের এ বক্তব্য মোটেই গ্রহণযোগ্য ছিল না। কারণ, তাঁদের সরকারের উচ্চপর্যায়ের পরামর্শেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা, সিআইডি ও পুলিশের তখনকার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার তদন্তকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করেছিলেন। তাঁরা পেশাদার খুনি চক্র, আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব এবং ভারতের ওপর এই হামলার দায়দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা করে প্রকৃত অপরাধীদের বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন। উদ্দেশ্যমূলকভাবে মামলার আলামত নষ্ট করা হয়েছিল। তৎকালীন সরকারের আহ্বানে বিদেশ থেকে আসা ইন্টারপোল ও এফবিআইয়ের বিশেষজ্ঞদের ভুল তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করা হয়েছিল। অবশ্য বিদেশি বিশেষজ্ঞদের আনাটা ছিল লোকদেখানো একটি কৌশলমাত্র।

তখনই প্রথম আলোর অনুসন্ধানে জানা গিয়েছিল, জোট সরকারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরকে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা সম্পর্কে কোনো তদন্ত করতে নিষেধ করেছিলেন। শক্তিশালী এই সংস্থার প্রধানকেও তদন্তপ্রক্রিয়ায় যুক্ত করা হয়নি। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাঁর পছন্দের সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাদের দিয়ে ২১ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করতে একটি কমিটি করেছিলেন। তবে সেই তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনও কোনো দিন প্রকাশ করা হয়নি।

এসব তথ্যের পটভূমিতে তখনই প্রশ্ন উঠেছিল, তাহলে কি ২১ আগস্ট হামলার সঙ্গে জোট সরকারের উচ্চপর্যায়ের কোনো যোগসাজশ ছিল? প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরে কর্মরত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মনেও এ প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল। ওই হামলার পরপর বিভিন্ন ঘটনা থেকে এমন ধারণাই হয়েছিল তাঁদের। এই প্রশ্ন ওঠা খুবই প্রাসঙ্গিক ছিল। কারণ, জোট সরকার এ ঘটনার তদন্ত সম্পূর্ণ উল্টো পথে চালিত করেছিল।

পরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে যখন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের নেতৃত্বকে হত্যা করতে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার মতো অবিশ্বাস্য ভয়াবহ ঘটনাবলির সব তথ্য বের হয়ে আসে, তখন এটা সত্যি বিশ্বাস করা কঠিন হয়ে পড়ে যে একটি নির্বাচিত সরকার ও নেতৃত্ব কীভাবে তাদের প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক শক্তিকে ধ্বংস করতে গ্রেনেড হামলার ভয়ংকর ঘটনার তদন্ত উল্টো পথে পরিচালনা করতে পারে।

দুই.
নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের শীর্ষস্থানীয় নেতা মুফতি আবদুল হান্নান ২০০৫ সালের ১ অক্টোবর রাজধানীর বাড্ডা এলাকা থেকে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। সেটা ছিল বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের শাসনামল। তখন যৌথ জিজ্ঞাসাবাদ কেন্দ্রে (জেআইসি) মুফতি হান্নান ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে এ ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দিয়েছিলেন। কিন্তু তখন মুফতি হান্নানকে এই মামলার আসামি করা কিংবা তাঁর কাছ থেকে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নেওয়ার কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। মুফতি হান্নান গ্রেনেড আক্রমণকারী ও সহযোগী হিসেবে যাদের নাম প্রকাশ করেছিলেন, তাদের গ্রেপ্তারে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

মুফতি হান্নান ওই সময়ে অর্থাৎ বিগত জোট সরকারের আমলে যৌথ জিজ্ঞাসাবাদ সেলে গোয়েন্দাদের কাছে যেসব তথ্য ও বর্ণনা দিয়েছিলেন, তা প্রথম আলোর হাতে এসেছিল ২০০৭ সালের মধ্যভাগে; যা ২০০৭ সালের ২১ আগস্টে প্রথম আলোতে প্রকাশিত হয়েছিল। এরপর ওই বছরের ২৮ আগস্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার সিআইডির এএসপি ফজলুল কবীরকে তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়ে এ মামলার নতুন করে তদন্ত শুরু করে। তারপর ওই বছরের অক্টোবরে র‌্যাব মুফতি হান্নানের সহযোগী নয়জন জঙ্গিকে অস্ত্র, গ্রেনেড, বিস্ফোরকসহ বিভিন্ন স্থান থেকে গ্রেপ্তার করেছিল। তাঁদের মধ্যে ২১ আগস্টের হামলায় সরাসরি অংশ নেওয়া আবুল কালাম আজাদ ওরফে বুলবুল ও জাহাঙ্গীর আলম ছিলেন। মুফতি হান্নান এবং এই দুজনসহ মোট ছয় জঙ্গি ২০০৭ সালের নভেম্বরে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছিলেন। তাঁদের জবানবন্দি যাচাই-বাছাই করে হামলার পরিকল্পনা, গ্রেনেড সরবরাহ, আক্রমণ ও আক্রমণে সহায়তাকারীদের নাম বেরিয়ে এসেছিল। পরে ২০০৮ সালের ১৭ জানুয়ারি গ্রেপ্তার করা হয় বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুকে। তদন্তে এসেছিল, হামলার তিন দিন আগে সাবেক এই উপমন্ত্রীর ধানমন্ডির বাসায় জঙ্গিরা এক পরিকল্পনা বৈঠক করেছিল। মুফতি হান্নানও আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে এই তথ্য জানিয়েছিলেন। আর ওই সাবেক উপমন্ত্রীর ভাই মাওলানা তাজউদ্দিন যে পাকিস্তান থেকে নিয়ে আসা গ্রেনেড এই হামলার জন্য সরবরাহ করেছিলেন, তা নিয়ে তদন্ত কর্মকর্তাদের কোনো সন্দেহ ছিল না।

সিআইডির তদন্তে গ্রেনেড হামলায় সরাসরি অংশগ্রহণকারী হিসেবে শনাক্ত হওয়া হরকাতুল জিহাদের দুই সদস্য মুরসালিন ও মুত্তাকিন এখনো দিল্লির তিহার জেলে বন্দী। নাশকতার জন্য অস্ত্র-বিস্ফোরক বহনের দায়ে এই দুই যমজ ভাইকে ২০০৬ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি দিল্লি পুলিশ গ্রেপ্তার করেছিল। তাদের বাড়ি বাংলাদেশের ফরিদপুরে। ২১ আগস্ট আক্রমণে অংশ নেওয়া আরেকজন মুফতি আহসান উল্লাহ ওরফে কাজল ২০০৬ সালের ৮ মার্চ দিল্লি পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। কাজল ভারতে সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড চালাতে গিয়ে লস্কর-ই-তাইয়েবার শীর্ষস্থানীয় জঙ্গি ইয়াজদানির সঙ্গে নিহত হন। এসব তথ্য থেকে এটা পরিষ্কার, মুফতি হান্নান ও তাঁর জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গে ভারতের জঙ্গিদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। এ ছাড়া মুফতি হান্নানসহ হরকাতুল জিহাদের বেশির ভাগ নেতাই পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছিলেন। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনার তদন্ত চলাকালে এসব আরও স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল।

তিন.
২০০৪ সালের ২১ আগস্টে হামলার পরপর সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আমার সরাসরি কথা বলার সুযোগ হয়েছিল।

মনে আছে, ২৬ আগস্ট অপরাহ্ণে খালেদা জিয়ার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে আলোচনার সময় তারেক রহমানও উপস্থিত ছিলেন। সেদিন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীকে বেশ বিচলিত মনে হয়েছিল। সে সময় খালেদা জিয়ার আমন্ত্রণে পত্রিকার সম্পাদকেরা তাঁর সঙ্গে আলাদাভাবে দেখা করেছিলেন। খালেদা জিয়া শুরুতেই আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, কারা এ ঘটনা ঘটাতে পারে বলে আপনি মনে করেন? আমার সরাসরি উত্তর ছিল, সুনির্দিষ্টভাবে আমার পক্ষে বলা মুশকিল। তবে ইসলামি জঙ্গিদের দল হরকাতুল জিহাদ, ভারতের আসামের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফা বা বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের ফ্রিডম পার্টি প্রভৃতি হয়তো এ ঘটনার সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারে।

খালেদা জিয়া শুরুতেই বলেন, ফ্রিডম পার্টির এখন আর অস্তিত্ব নেই। তাদের জড়িত থাকার সম্ভাবনা নাকচ করে দেন তিনি। কিন্তু হরকাতুল জিহাদ ও উলফা সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করেননি। তবে তিনি বলেছিলেন, আপনারা ধর্মীয় সংগঠনগুলো সম্পর্কে অতিরঞ্জন করেন, বাড়িয়ে বলেন; আপনারা বায়াসড (পক্ষপাতমূলক) লেখালেখি করেন।

আমার এখনো মনে আছে, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমার সেই আলোচনা কিছুটা সময়ের জন্য উত্তেজনাপূর্ণ ছিল। আমি অভিযোগ করেছিলাম, আপনারা আওয়ামী লীগের মামলা নিচ্ছেন না, নিহতদের লাশ দিচ্ছেন না এবং প্রতিবাদ সমাবেশ বা শোক পালন করতে দিচ্ছেন না। আওয়ামী লীগ শোক প্রকাশও করতে পারবে না?

তখন একপর্যায়ে খালেদা জিয়া উত্তেজিত ভাষায় বলেছিলেন, আওয়ামী লীগকে কিছু করতে দেওয়া হবে না, প্রয়োজনে শায়েস্তা করা হবে। এবং কিছুতেই ’৯৬ সালের অবস্থা তৈরি করতে দেবেন না।

শিশির ভট্টাচার্য্যের আঁকা এই কার্টুনটি প্রথম আলোতে প্রকাশিত হয় ২০০৫ সালের ২৯ জুন

২১ আগস্টের ঘটনার পাঁচ দিন পর ২৭ আগস্ট সকালে দেখা করেছিলাম বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে। শেখ হাসিনা এবং তাঁর দলের নেতৃত্বের প্রতি নৃশংস হামলার ঘটনায় সংহতি ও সহানুভূতি প্রকাশই ছিল আমার ওই সাক্ষাতের উদ্দেশ্য। তখন স্বাভাবিক কারণেই তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা গভীরভাবে শোকাহত এবং উত্তেজিতও ছিলেন। আহত নেতা-কর্মীরা আসছিলেন তাঁর কাছে। একটা অস্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছিল সুধা সদনে। বারবার কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন শেখ হাসিনা। তবে সেদিন তাঁর স্পষ্ট অভিযোগ ছিল, ‘তারেক রহমান ও হাওয়া ভবনের তার সঙ্গীরা হামলার সঙ্গে সরাসরি জড়িত। তারাই পরিকল্পিতভাবে এ ঘটনা ঘটিয়েছে। আমাকে হত্যা এবং আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করাই ছিল এই হামলার উদ্দেশ্য।’ সেদিন সংবাদমাধ্যমের প্রতি তাঁর আহ্বান ছিল, আমরা যেন এই নৃশংস ঘটনার পেছনের ঘটনার সত্য প্রকাশ করি। প্রথম আলো এই ঘটনার সত্য প্রকাশে কখনো পিছিয়ে থাকেনি।

আসলে সেদিন সকালে শেখ হাসিনার নতুন করে জীবন ফিরে পাওয়া এবং আহত অবস্থাতেও যেভাবে দলীয় নেতা-কর্মীদের সাহস ও সহানুভূতি প্রকাশ করে তিনি পরিস্থিতি সামাল দিচ্ছিলেন, সেটা আমাকে বিস্মিত করেছিল।

চার.
আমরা জানি, নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকে দেশে জঙ্গি তৎপরতা শুরু হলেও এ বিষয়ে সুইডিশ সাংবাদিক বার্টিল লিন্টনার বিদেশে প্রথম বড় ঘণ্টাটি বাজিয়েছিলেন। ৪ এপ্রিল ২০০২ ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউতে ‘ককুন অব টেরর’ প্রতিবেদনে যে আশঙ্কা তিনি ব্যক্ত করেছিলেন, তা তখন অনেকেই সেভাবে আমলে নেওয়ার গরজ অনুভব করেননি, বরং অতিদ্রুত ‘ভাবমূর্তি নস্যাৎ তত্ত্ব’ তার জায়গা করে নেয়। একই বিষয়ে প্রথম আলোতে ২০০৪ সালের আগস্টে প্রকাশিত ধারাবাহিক প্রতিবেদনগুলোকেও জোট সরকারের ভাবমূর্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করার চেষ্টা হিসেবে দেখা হয়েছিল।

আমরা জানতাম যে নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকে বাংলাদেশের উগ্রপন্থীরা ইসলাম রক্ষার নামে বিশেষ করে আফগানিস্তান ও কাশ্মীরে পাকিস্তানি মদদপুষ্ট জঙ্গি সংগঠনগুলোর সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলেছিল। একই সঙ্গে ধনী আরব দেশগুলোর অর্থসহায়তায় বিভিন্ন এনজিও বাংলাদেশে কাজ করতে শুরু করে। বিষয়টিকে তখন আদৌ গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। ঢাকার রাস্তায় বাংলাদেশকে আফগানিস্তান বানানোর স্লোগান প্রকাশ্যে ধ্বনিত হয়েছিল।

বিগত প্রায় তিন দশকের অভিজ্ঞতায় বলা যায়, কেবল ২১ আগস্ট নয়, নব্বইয়ের শেষের পুরো দশক ও একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দুই দশক বোমা ও গ্রেনেড হামলা এবং ২০১৬ সালের ১ জুলাই হোলি আর্টিজানে ভয়ংকর হামলা পর্যন্ত—কোনোটিই বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না।

সে সময়গুলোতে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন জঙ্গি মৌলবাদী সংগঠনের সঙ্গে বাংলাদেশে আল-কায়েদার ঘনিষ্ঠ একাধিক আন্তর্জাতিক সংগঠনও সক্রিয় ছিল। বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত আল-কায়েদার প্রধান ওসামা বিন লাদেনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী মার্কিন নাগরিক এনাম আরনট এবং তাঁর প্রতিষ্ঠান বেনেভোলেন্স ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশনের নামে একটি সংগঠন বাংলাদেশে ১০ বছর সক্রিয় ছিল। রাজধানীর উত্তরায় ছিল তাদের অফিস। প্রথম আলোর অনুসন্ধানে তখন জানা গিয়েছিল, বেনেভোলেন্স ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন নামের প্রতিষ্ঠানটি ১৯৯২ সালে এনজিও বিষয়ক ব্যুরোর রেজিস্ট্রেশন নিয়েছিল। ঢাকায় তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ছিল। ওই অ্যাকাউন্টের অন্যতম পরিচালক হিসেবে এনাম আরনটেরও নাম ছিল (প্রথম আলো, ২৩ জুন ২০০৩)। ২০০২ সালে শিকাগোতে মার্কিন আদালতে বিচারে এনাম আরনটের আট বছরের কারাদণ্ড হয়েছিল।

সৌদি আরবের উদ্যোগে গঠিত আল-কায়েদার আরেক সহযোগী সংস্থা আল-হারামাইনও এনজিও বিষয়ক ব্যুরোর রেজিস্ট্রেশন নিয়ে বাংলাদেশে ১০ বছর কাজ করেছিল। এ সংস্থার কার্যালয়ও ছিল উত্তরায়। ২০০২ সালের সেপ্টেম্বরে পুলিশ আল-হারামাইনের সাতজন বিদেশি নাগরিককে আটক ও জিজ্ঞাসাবাদ করে। কিন্তু সে সময় সৌদি দূতাবাসের হস্তক্ষেপে তাদের দ্রুত দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। পরে মার্কিন চাপ এবং সৌদি সরকারের উদ্যোগে ২০০৪ সালের জুলাইতে ঢাকা ও অন্য কয়েকটি দেশে তাদের কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়। তখন ওই সংগঠনে কর্মরত ১৪ জন বিদেশি নাগরিক ঢাকা ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়।

 আরও জানা যায়, সারা দেশে তখন কুয়েতভিত্তিক এনজিও রিভাইভাল অব ইসলামিক হেরিটেজ সোসাইটি (আরআইএইচএস) নামে একটি সংস্থা কাজ করেছে, যাদের বিরুদ্ধে ইসলামি জঙ্গি তৎপরতায় অর্থায়ন ও উদ্বুদ্ধকরণের অভিযোগ ছিল।

আমরা জানি, আফগানিস্তান যুদ্ধে প্রায় তিন হাজার বাংলাদেশি অংশ নেন, এ তথ্য জানিয়েছেন হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশ শাখার ভারপ্রাপ্ত আমির মুফতি শফিকুর রহমান। যুদ্ধ শেষে আফগানিস্তান থেকে প্রায় আড়াই হাজার জিহাদি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জঙ্গি বাংলাদেশে ফিরে এসেছিল। তাদের মধ্যে অনেকেই দেশে এসে হরকাতুল জিহাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল। আফগান যুদ্ধে মারা যান ২৪ জন বাংলাদেশি। আফগানিস্তানে তালেবান সরকার গঠনের পরের সপ্তাহে ১৯৯২ সালের ৩০ এপ্রিল জাতীয় প্রেসক্লাবে বাংলাদেশি মুজাহিদরা এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন। এতে হরকাতুল জিহাদের নেতারা অংশ নেয়। (এসব তথ্য পাওয়া গেছে মাওলানা উবায়দুর রহমান খানের লেখা আফগানিস্তানে আমি আল্লাহকে দেখেছি গ্রন্থে। প্রকাশক কিতাব কেন্দ্র, ৫০ বাংলাবাজার, ঢাকা।)

পাঁচ.
আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত ও নিষিদ্ধ হরকাতুল জিহাদের জঙ্গিরাই ১৯৯৯ সাল থেকে দেশে একের পর এক বোমা ও গ্রেনেড হামলা চালায়। এর মধ্যেই তারা ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে গ্রেনেড হামলা চালিয়েছিল। ১৯৯৯ সালের ৬ মার্চ যশোরে উদীচীর অনুষ্ঠানে বোমা হামলার পর থেকে প্রথম দশকের মধ্যে মোট ২৩টি বড়োধরনের বোমা ও গ্রেনড হামলার ঘটনা ঘটেছে। এসব হামলায় নিহত হয়েছিলেন ১৮১ জন ও আহত ১ হাজার ৩৯৯ জন।

সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসে একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলাটির তদন্ত শুরু করে ২০০৭ সালের ২৮ আগস্ট। মুফতি হান্নানসহ ২২ জনের বিরুদ্ধে ২০০৮ সালের জুনে অভিযোগপত্র দিয়ে বিচারও শুরু করেছিল। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে মামলার অধিকতর তদন্ত করে এবং ২০১১ সালে সম্পূরক অভিযোগপত্র দিয়ে আরও ৩২ জনকে আসামি করা হয়। আদালত বিচারকাজ শেষ করে গত বছরের ১০ অক্টোবর রায় দেন। তাতে ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ড, ১৯ জনের যাবজ্জীবন এবং ১১ জনের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড দেওয়া হয়।

হরকাতুল জিহাদের জঙ্গিদের গ্রেপ্তার ও সাজার আওতায় আনা হলেও দেশে জঙ্গিবাদ শেষ হয়ে গেছে, সেটা বলা যাবে না। বিভিন্ন সময়ে আরও নতুন নতুন গোষ্ঠী সংগঠিত হয়েছে। দেশে তারা নানা অঘটন ঘটিয়েছে। এর মধ্যে ২০১৬ সালের হোলি আর্টিজান বেকারিতে আইএস সমথ৴ক জঙ্গিগোষ্ঠী নব্য জেএমবির ভয়ংকর হামলা পুরো দেশবাসীকে স্তম্ভিত করেছিল। পরবর্তী সময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বলিষ্ঠ ভূমিকায় এসব জঙ্গিকে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হলেও তারা নির্মূল হয়ে যায়নি। সাম্প্রতিক সময়ে এর কিছু আলামতও পাওয়া গেছে।

আমরা আশা করব, উগ্রপন্থী সব জঙ্গিগোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণ এবং আইনের আওতায় আনতে সরকার সব ধরনের ব্যবস্থা নেবে। যারা ইতিমধ্যে উগ্র মতবাদে আকৃষ্ট হয়েছে, তাদের সেখান থেকে ফিরিয়ে আনা এবং নতুন করে কেউ যাতে সে দিকে না ঝোঁকে, সে জন্য বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যবস্থা নেবেন এবং একটা জাতীয় কর্মকৌশল সরকার নেবে বলে আমরা আশা করছি।

মতিউর রহমান: প্রথম আলোর সম্পাদক­