‘দুধ-চা খেয়ে তোকে গুলি করে দেব’ তরুণ কবি ও শিল্পী রাজীব দত্তের এই গ্রাফিতিটি ফেসবুকে খুব চাউর হলো।’ জনপ্রিয় ভিলেন ডিপজলের সিনেমাটিক হুংকারটা অদ্ভুত হলেও অবাস্তব না। তবে এটা পুরোনো সংলাপ। নতুন সংলাপ এসে গেছে, ‘গুলি করে জন্মের মতো খোঁড়া করে দিব।’ সিনেমার মতোই মদ খেতে খেতে নাকি হুমকিটা দেওয়া হয়েছে। যে দুজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ তাঁরা ধনাঢ্য ব্যবসায়ী গোষ্ঠী সিকদার গ্রুপের দুই মালিক রন হক সিকদার এবং দিপু হক সিকদার। এই গল্পে এখনো নায়কের আবির্ভাব হয়নি, এক্সিম ব্যাংকের নির্যাতিত এমডি ও অতিরিক্ত এমডি তো ভিকটিম, ভিলেনেরা নাকি পলাতক, নায়করূপী সরকার কখন অ্যাকশনে নামে, কী অ্যাকশন নেয়, তা এখনো দেখতে বাকি।
সিকদার গ্রুপের এমডি রন হক সিকদার গাড়ির কালো কাচ নামিয়ে গুলি করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু সেটা এক্সিম ব্যাংকের এমডির কানে বাতাস লাগিয়ে হারিয়ে যায়। না হারালে তাঁর পরিণতি গাজীপুর সিটি করপোরেশনের প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেনের মতো হতে পারত। প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন দুর্নীতিতে সায় দেননি বলে নির্মমভাবে হত্যার শিকার হয়েছেন ঈদের মাত্র কয়েক দিন আগে । আর এক্সিম ব্যাংকের দুই এমডি হত্যাচেষ্টা এবং গুলির মুখে অপহরণ ও নির্যাতনের কবলে পড়েছেন অবৈধভাবে সিকদার গ্রুপকে ৫০০ কোটি টাকার ঋণের ব্যবস্থা করেননি বলে।
বিদেশি ‘শিল্পীদের’ অংশগ্রহণে সিনেমাটি, থুক্কু ঘটনাটি আরও জমজমাট হয়ে ওঠে। দুই এমডিকে যাঁরা পিস্তল ঠেকিয়ে অপহরণ করে ধনীপাড়া বনানীর সিকদার হাউসে নিয়ে গিয়ে তোলেন, তাঁরা ‘বিদেশি’ নিরাপত্তারক্ষী। জানি না বিদেশি দেহরক্ষী রাখার আইন আছে কি না। এই বিদেশি নিরাপত্তারক্ষীদের দিয়ে আরও নির্যাতন করার হুমকিতে কাবু হয়ে যান অপহরণের শিকার দুই এমডি। তাঁদের হুমকিতে সাদা কাগজে সই দিয়ে এই যাত্রা তাঁরা রক্ষা পান।
সবই এক্সিম ব্যাংকের এমডিদ্বয়ের পক্ষে এক্সিম ব্যাংকের কর্তৃপক্ষের করা মামলার বিবরণে প্রকাশ। ঘটনা ৭ মে তারিখের। প্রকাশিত হলো ২৭ মে। মাঝখানের ২০ দিনের কাহিনি পাঠকের মতো এই লেখকেরও অজানা। এই সময়ে সিকদার গোষ্ঠী বিষয়টা চাপা দিতে, কাঙ্ক্ষিত ঋণটি পেতে আর কী কী করেছিল, তা নিশ্চয়ই তদন্তকারীরা খুঁজে দেখবেন। আমরা শুধু জানলাম, সাধারণ মানুষ থেকে রাজনৈতিক কর্মী; রাজনৈতিক কর্মী থেকে বুদ্ধিজীবী; বুদ্ধিজীবী থেকে দেশের শীর্ষ ব্যাংকার পর্যন্ত বলপ্রয়োগ ও অপহরণ-নির্যাতনের আওতায় পড়ে গেছেন। ব্যাংকারদের মধ্যে ভীতি ছড়িয়ে গেছে। প্রথম আলোয় প্রকাশিত খবরে তাঁদের মনোভাব প্রকাশিত হয়েছে এভাবে: বিষয়টি নিয়ে একাধিক ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। করোনাভাইরাসের মহামারির মধ্যে এমন নির্যাতনের ঘটনায় হতবাক হয়ে পড়েছেন তাঁরা। কেউ প্রকাশ্যে বা নাম প্রকাশ করে কথা বলতে চাননি। তবে তাঁরা বলেছেন, ব্যাংকের ঋণ কীভাবে দেওয়া হয় আর কেন আদায় হয় না, এর চেয়ে বড় প্রমাণ আর কী হতে পারে। একজন এমডি বলেন, এভাবে নির্যাতিত হলে ব্যাংকগুলো কীভাবে চলবে। এর যথাযথ বিচার না হলে কেউ নিরাপদ নন।
অতীব ক্ষমতাশালী কিংবা ‘আমি সাতে-পাঁচে নেই বাবা’ হলেও রেহাই নেই। হত্যা-নির্যাতনের লটারিতে কখন কার নাম উঠবে, কেউ বলতে পারে না। এমডিতে-এমডিতে যুদ্ধ বলে এড়িয়ে যাওয়ার উপায়ও নেই।
‘তোর কত বড় সাহস যে আমার কথা অমান্য করিস’! এটা বলপ্রয়োগের ভাষা, এই ভাষার মোক্ষম প্রবাদটা আমরা সবাই জানি ও মানি: ‘মাইরের ওপর ওষুধ নাই’। আইন, ন্যায়বিচার, দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন ইত্যাদি যেসব গুরুবাক্য আমরা বলি, সেসব অর্থহীন হয়ে গেলে এ ধরনের সংলাপ ঘনঘন শুনতে হয়। অপহরণের শিকার থাকার সময় সাংবাদিক কাজলকেও নিশ্চয়ই এমন সংলাপ শুনতে হয়েছিল। সিকদার গ্রুপ এ ব্যাপারে একা নয়, আরও অনেক গ্রুপই এ ধরনের চর্চা করে, সবারটা খবর হয় না, হলেও সবার সাজা হয়েছে, এমন দৃষ্টান্ত নেই। বরং বলপ্রয়োগ দিয়ে বিতর্ক ও দ্বন্দ্বের মীমাংসাই যেন চলতি রেওয়াজ বাংলাদেশে। কী রাজনীতিতে, কী ব্যবসায়, কী ভিন্নমত দমানোয় এটাই জাতীয়ভাবে অনুসরিত পদ্ধতি। সিকদার গ্রুপের দুই মালিক মালিক-ভ্রাতা ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতিরই প্রয়োগ করেছেন মাত্র।
এভাবে যদি গায়ের জোরে ব্যাংকের টাকা ঋণের নামে নেওয়ার কাজ হয়, তাহলে ব্যাংকই বা ব্যবসা করবে কীভাবে আর প্রকৃত ব্যবসায়ীরাই বা ঋণ পাবেন কীভাবে? প্রকৌশলী দেলোয়ার যদি সততার কারণে খুন হন, বড় ব্যাংকের এমডি যদি ঋণদানের নিয়ম মানতে গিয়ে হত্যা-অপহরণের মুখে পড়েন, সংরক্ষিত আসনের নারী এমপির ভাইয়েরা যদি সিনেমার কায়দায় ক্ষমতা দেখান, তাহলে আমরা কোথায় যাব। কাকে বলব, ‘আমরা কেমন করে বেঁচে আছি, তুই এসে দেখে যা নিখিলেশ!’
কিছুদিন আগে ‘এক্সট্র্যাকশন’ নামে হলিউডের নেটফ্লিক্সের একটা ছবি নিয়ে বাংলাদেশে খুব শোরগোল হলো। এই ছবিতে বাংলাদেশি মাফিয়া ভিলেন মুম্বাইয়ের মাফিয়ার পুত্রকে অপহরণ করে বাংলাদেশে নিয়ে আসে। মাফিয়া পুত্রকে উদ্ধারে ভাড়া করা হয় অস্ট্রেলীয় এক ভাড়াটে কমান্ডোকে। বাংলাদেশ-নির্ভর গল্পে বিদেশি শিল্পীর নায়কতা দেখার মতো ব্যাপার ছিল। ঢাকার রাস্তায় বন্দুকবাজির রমরমা দেখে, মাফিয়ার পক্ষে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর খেদমত দেখে জাতীয়তাবাদী মন ক্ষিপ্ত হয়েছিল। সেই সিনেমার রিভিউ আলোচনায় এই লেখক একটি প্রশ্ন তুলে উত্তর জানতে চেয়েছিলেন, ‘এক্সট্র্যাকশনে বাস্তবতা বিকৃত করে দেখানো হলেও তার ভেতরের সত্যটা কি অস্বীকার করা যায়? এই সিনেমায় দেখানো বাস্তবতা কি আমাদের ভবিষ্যৎ, নাকি বর্তমান?’
সিকদার গ্রুপের দুই ভাই যেভাবে প্রকাশ্য দিবালোকে গাড়ির কাচ নামিয়ে গুলি করলেন, বিদেশি ‘নিরাপত্তারক্ষী’ দিয়ে অপহরণ করালেন, এরপর আর মনে কোনো দ্বিধা থাকবার কথা নয়। পাঠক, উত্তরটা আমি পেয়ে গেছি।
ধাঁধার উত্তর তো মিলল, ন্যায়বিচার কী মিলবে?
ফারুক ওয়াসিফ: প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক।
faruk.wasif@prothomalo.com