এবার বাজারদর সামলাতেও রোল মডেল হোন

তেলের দাম বেড়ে গেলে রম্যলেখকেরা সেটাকে মওকা হিসেবে নেন। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর ‘তৈল’ রচনা থেকে উদ্ধৃতি দেওয়া যায়: ‘তৈলের মহিমা অতি অপরূপ। তৈল নহিলে জগতের কোনো কাজ সিদ্ধ হয় না। তৈল নহিলে কল চলে না, প্রদীপ জ্বলে না, ব্যঞ্জন সুস্বাদু হয় না, চেহেরা খোলে না, হাজার গুণ থাকুক, তাহার পরিচয় পাওয়া যায় না, তৈল থাকিলে তাহার কিছুরই অভাব থাকে না।’

কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি বেশ কঠিন। রসিকতা করার জন্য মোটেও উপযুক্ত নয়।

বাংলাদেশে ভোজ্যতেলের বাজার অস্থির। ১০ মার্চ ২০২২-এর প্রথম পাতায় প্রথম আলো খবর করেছে, ফোঁটা ফোঁটা তেলে পরোটা ভাজা চলে। ঠাকুরগাঁওয়ের রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ী আবদুল হামিদ মাথার ওপর সয়াবিন তেলের বোতল ঝুলিয়ে ফোঁটা ফোঁটা করে তেল ঝরানোর ব্যবস্থা করে পরোটা ভাজছেন। শুধু তেলের দাম নয়, আরও নানা ধরনের নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে গেছে। টিসিবির ট্রাকের পেছনে হ্রাসকৃত মূল্যে চাল, ডাল, তেল, চিনি কিনতে মধ্যবিত্ত লাইন দিচ্ছে, এ দৃশ্য অনেক দিন ধরেই দেখছি এবং এ কথা কয়েকবার লিখেছি। প্রথম আলোর ১০ মার্চ ২০২২-এ আরেকটি প্রতিবেদন ‘সঞ্চয় ভুলে ধারে চলছে সংসার’ থেকে জানা যাচ্ছে, ২০২০-এর ফেব্রুয়ারির তুলনায় ২০২২-এর ফেব্রুয়ারিতে চাল, তেল, মুরগি, এলপি গ্যাসের দাম ১৮ থেকে ৮২ শতাংশ বেড়েছে। বাসভাড়া, লঞ্চভাড়া বেড়েছে ২৭ থেকে ৪০ শতাংশ। দুই বছর আগে পাঁচ লিটার ভোজ্য তেলের দাম ছিল ৫০০ টাকা, গত মাসে তা দাঁড়ায় ৮০০-য়। মর্মান্তিক একটা সংলাপ ছাপা হয়েছে গতকালকের প্রথম আলোয়, ‘আগের চেয়ে এখন কম খাই।’ ইকারুন্নেসা দুই মেয়ে নিয়ে মোহাম্মদপুরে থাকেন, বড় মেয়ে আর তিনি মাসে আয় করেন ১৫ হাজার টাকা। ‘আগের চেয়ে কম খাই। ইনকাম তো আর বাড়ে নাই। এখন সপ্তাহে একদিন মাছ-মাংস খাই।’

এই হিসাব সহজ। যাঁরা চাকরি করেন, গৃহকর্মী, দোকানের কর্মচারী, সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, মিলকারখানার শ্রমিক-কর্মচারী অর্থাৎ যাঁরা মাসের শেষে মাহিনা পান, তাঁদের বেতন প্রতি মাসে বাড়ে না। দুই বছর আগে যিনি ২০ হাজার টাকা বেতন পেতেন, এখন তিনি ২১ হাজার টাকা পেতে পারেন। অর্থাৎ তাঁর আয় বাড়তে পারে ৫ শতাংশ। কিন্তু ক্যাবের হিসাবে শুধু ২০২০-২১ অর্থবছরে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ৬ দশমিক ৮৮ শতাংশ। এ বছরে আরও ৭ শতাংশ বাড়লে প্রায় ১৪–১৫ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় ৫ শতাংশ আয় বাড়লে খাওয়া কমাতে হবে, কাপড়চোপড় কম কিনতে হবে। রিকশাওয়ালারা রিকশাভাড়া বাড়িয়ে দিয়ে তাঁর সংসারের ব্যয় সামলানোর চেষ্টা করতে পারেন, কিন্তু চাকুরে পরিবারের সদস্যরা রিকশায় উঠতে বেশি ভাড়া দিতে গিয়ে হিমশিম খাবেন।

আমরা কারণগুলো জানি। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে গেলে সব পণ্যের দাম বাড়বে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কুফল এরই মধ্যে বিশ্বের দেশে দেশে পড়তে শুরু করেছে। সামনে রমজান। আরব দেশগুলোয় নাকি রমজানে জিনিসপত্রের দাম কমিয়ে দেওয়া হয়। (সূত্র: যুগান্তর, ১৩ মে ২০১৯)। ক্রিসমাসের আগে পশ্চিমে চাল, ডাল, আটা ধরনের গ্রোসারি পণ্যের দাম কমে। কারণ, লোকে বেশি করে কেনে, ফলে দাম কম রেখেও দোকানিরা তাঁদের মুনাফা পুষিয়ে নিতে পারেন। (পড়তে পারেন ভক্স ইউ, লরা বার্গ ও আনা গোয়েডেকের লেখা: ক্রিসমাস ইকোনমিকস: চ্যালেঞ্জিং সাম পপুলার বিলিফস, ২৪ ডিসেম্বর ২০১৪)। বাংলাদেশে হয় উল্টোটা। অনেক ব্যবসায়ী রমজান মাসকে মওকা হিসেবে ব্যবহার করেন। চাহিদা বেশি, কাজেই দাও দাম বাড়িয়ে।

সামনের দিনগুলোয় কী হবে, ভেবে খুবই দুশ্চিন্তা হয়। ইউক্রেন–রাশিয়া যুদ্ধ কি থেমে যাবে অচিরেই? জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে আবার কিছুটা কমেছে। এখনই বাংলাদেশে ভোজ্যতেল বা পেঁয়াজের বাজার অস্থির। কাঁচা মরিচের দাম বেড়ে গেছে। গতকাল দুটো লেবু কিনেছি ২০ টাকা দিয়ে। একবার ধনেপাতার দাম রোজার মধ্যে আকাশ ছুঁয়েছিল।

এর মধ্যে আছে মন্ত্রী-নেতাদের সুধাবর্ষণ। পেটে খেলে পিঠে সয়। কিন্তু পেটে কম খেয়ে সুবচন শুনতে ভালো লাগে না। পুরোনো তত্ত্বের নতুন প্রয়োগ শুনছি: বিএনপির ব্যবসায়ীরা কৃত্রিমভাবে জিনিসপাতির দাম বাড়াচ্ছে। বিএনপি ভোট করতে পারে না, রাস্তায় মিছিল করতে পারে না, আর বিএনপি-ব্যবসায়ীরা কৃত্রিমভাবে দাম বাড়িয়ে যাচ্ছে, সে ক্ষেত্রে সরকার করছেটা কী? যা কিছু হারায় গিন্নি বলেন, কেষ্টা বেটাই চোর। তো কেষ্টাকে হয় কাজ থেকে বাদ দিন, না হলে হাতেনাতে ধরে ফেললেই তো হয়!

দুটো কথা এখানে বলব। একটা আছে আকবর আলি খানের পরার্থপরতার অর্থনীতি বইয়ে। ‘পদ্ধতিগত দিক থেকে আধুনিক রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, আজকের রাজনীতিবিদগণ অর্থনৈতিক সমস্যার অর্থনৈতিক সমাধান না করে রাজনৈতিক সমাধান দিতে চান আর রাজনৈতিক সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান না করে আর্থিক সমাধান দিতে করতে চান।’ তিনি উদাহরণ দিয়েছেন। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের সময় দুধে ভেজাল দেওয়ার বিরুদ্ধে জরিমানা বাড়ানো হয়। এতে ভেজাল না কমে বেড়ে যায়। কারণ, চাহিদার তুলনায় দুধের উৎপাদন ছিল কম, আর জরিমানার টাকা উশুল করতে পানি বাড়িয়ে দেওয়া ছাড়া বিক্রেতাদের সামনে উপায় ছিল না।

কিন্তু অমর্ত্য সেনের এই কথাও আমরা আবার বলব। দ্য আইডিয়া অব জাস্টিস বইয়ে তিনি আবারও বলেছেন, ‘আমরা দেখেছি, যেসব দেশে কার্যকর গণতন্ত্র, নিয়মিত নির্বাচন, বিরোধী দল, মৌলিক বাক্‌স্বাধীনতা, তুলনামূলক মুক্ত গণমাধ্যম আছে, এমন দেশ, তা যদি বেশ গরিবও হয়, সেখানে খাদ্য পরিস্থিতি যদি বেশ কঠিনও হয়ে থাকে, তবুও সেখানে বড় দুর্ভিক্ষ হতে পারে না।’ (প্রবন্ধ: ফ্যামিন প্রিভেনশন অ্যান্ড পাবলিক রিজনিং)। অমর্ত্য সেন এক সাক্ষাৎকারে তত্ত্বটা ব্যাখ্যা করেছিলেন, গণমাধ্যম স্বাধীন হলে খাদ্যাভাবের কথা লিখবে, আর গণতন্ত্র থাকলে সামনের নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে সরকার দ্রুত ব্যবস্থা নেবে।

আমাদের দেশে গণমাধ্যমের এতটুকু স্বাধীনতা এখনো আছে যে টিসিবির ট্রাকের দীর্ঘ লাইনের ছবি আর ভুক্তভোগীদের আর্তি প্রকাশিত হচ্ছে, তেল-পেঁয়াজের দাম বেড়ে গেছে, এ বিষয়ে সবাই উচ্চরব। সামনে নির্বাচন আছে। সেই নির্বাচনী বৈতরণি পাড়ি দিতে হলে এ বছরে জিনিসপত্রের দাম মানুষের সহ্যসীমার মধ্যে রাখতেই হবে। সেই নির্বাচন যেমন নির্বাচনই হোক না কেন, নির্বাচনের আগের বছরগুলোয় নাগরিকদের অন্তত নাকটা ভাসিয়ে রাখার ব্যবস্থা না করে সরকার পারবেই না।

কিন্তু ব্যবস্থাটা কী হবে? বিএনপির ব্যবসায়ীদের ধরে ধরে জেলে পোরা? মুনাফালোভীদের হিতোপদেশ দেওয়া? আকবর আলি খানের কথা আবারও বলি, অর্থনৈতিক সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান নেই। প্রশাসনিক সমাধানও নেই। তবে সুশাসন, আইনের শাসন, চুরি বন্ধ, বিদেশে অর্থ পাচার বন্ধের মতো প্রাথমিক (প্রাইমারি) কাজগুলো তো যেকোনো সরকারকে করতেই হবে। প্রাথমিক কাজের পর এবার মাধ্যমিক (সেকেন্ডারি) কাজও করতে হবে বাজার-পরিস্থিতি নিয়ে।

আমরা যদি এই করোনার মধ্যে পৃথিবীতে উন্নয়নের ‌‘রোল মডেল’ হয়ে থাকি, বাংলাদেশ যদি সত্যি সত্যি উন্নয়নের প্যারাডক্স হয়ে থাকে, তাহলে করোনা-যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যে মানুষের আয় অনুযায়ী ব্যয়ের মতো বাজার বজায় রাখার কাজটাও আমাদেরই করে দেখাতে হবে। শুধু উপদেশে কাজ হবে না। শুধু বিএনপিকে দায়ী করলেও কাজ হবে না। চাহিদা, মজুত, উৎপাদন, সরবরাহ, দাম—হিসাব বা পরিসংখ্যান সরকারের কাছেই সবচেয়ে ভালোভাবে আছে, সময় থাকতে ব্যবস্থা নিতে হবে। ভোজ্যতেল, চিনি, ছোলাসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর আরোপিত শুল্ক প্রত্যাহার করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। দরকার পড়লে টিসিবির ক্ষমতা, পরিধি, তৎপরতা বাড়িয়ে দেওয়া যায়। আমি অর্থনীতিবিদ নই, কাজেই ঠিক কী করতে হবে, তা নিয়ে পরামর্শ দেওয়া আমার উচিত হবে না। কিন্তু যাঁরা এই সব নিয়ে আসলেই বিশেষজ্ঞ কিংবা আসলেই মাঠেঘাটে কাজ করেন, তাদের কথা শুনে এখনই ব্যবস্থা নিন। সময়ের এক ফোঁড়, অসময়ের নয় ফোঁড় বাঁচাবে। বাংলাদেশ তো উন্নয়নের রোল মডেল, এবার বাজারদর নিয়ন্ত্রণেও যদি আমরা রোল মডেল হই, সবচেয়ে খুশি হবে জনগণ। বিএনপির ব্যবসায়ীরা দেশের মানুষকে নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে কষ্ট দিক, এটা কেন সরকার মেনে নেবে! দাম মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে এনে দেখিয়ে দিন, রোল মডেল কাকে বলে।

আনিসুল হক প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক