এবার কেমন হচ্ছে ইউরোপের বড়দিন

জার্মানির হ্যানোভার শহরে আলোমালায় সজ্জিত শূন্য রাজপথ
ছবি: সরাফ আহমেদ


বড়দিন উৎসবকে ঘিরে আনন্দ উৎসাহ উদ্দীপনা আর আপন স্বজনদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার রেওয়াজ ইউরোপের প্রাচীন ঐতিহ্য। উৎসবকে ঘিরে ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিন থেকেই ইউরোপের ছোট-বড় শহরগুলোর অপরূপ সাজে ঝলমল করে। এত সব আয়োজনের কেন্দ্র হচ্ছে ২৫ ডিসেম্বর, যিশুখ্রিষ্টের জন্মদিন। প্রাচীন এই উৎসব এবার থমকে গেছে করোনাভাইরাসের প্রবল প্রতাপে।
যিশুখ্রিষ্টের জন্মদিন ২৫ ডিসেম্বর হলেও কয়েকশ বছর আগে থেকেই আগের দিন ২৪ ডিসেম্বরের সন্ধ্যাটিকে বলা হয়ে থাকে পবিত্র সন্ধ্যা। ওই দিন ক্রিসমাস ট্রীর নীচে সাজিয়ে রাখা উপহার সামগ্রী আপনদের মাঝে বিনিময় আর বিতাড়ন হয়। পরিবারের নবীন প্রবীণ সবাই ভালোবাসার বন্ধনে মিলিত হন, গির্জায় প্রার্থনা হয়। শুধু ইউরোপ নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বীরা ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে দিনটি পালন করে ৷ বড়দিনের শুভেচ্ছাকার্ড বিনিময়, আপনজন বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে উপহার সামগ্রী দেওয়া-নেওয়া, বড়দিনের বিশেষ বিস্কুট বানানো। নানা আয়োজন আচার অনুষ্ঠান বড়দিনের আনন্দকে, বহুলাংশে বাড়িয়ে দেয়। মানুষ বাড়তি বড়দিন বোনাস পায়। এই সময়ের বাম্পার ব্যবসা বাণিজ্যের কারণে অর্থনীতির চাকা হয়ে উঠে গতিময়। বড়দিনকে ঘিরে জীবন হয় কিছুদিনের জন্য আনন্দময়।

এই সময়টির জন্য সারা বছর অপেক্ষায় থাকে মানুষ। পরিবারের নবীন প্রবীণ সবাই বড়দিনকে ঘিরে মিলিত হন। পুরো মাস জুড়েই তুষারপাত ও প্রচণ্ড ঠান্ডাকে উপেক্ষা করে ছোট-বড় সব বয়সী মানুষর মাঝে বড়দিনের উৎসব ঘিরে ব্যস্ততা লক্ষ্য করা যায়। ইউরোপীয় আবহাওয়াই বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে দুপুর না গড়াতেই যখন সন্ধ্যা নেমে আসে। তখন বাড়িতে বাড়িতে, রাজপথ, দোকানপাট, শহরের কেন্দ্রগুলো বা ক্রিসমাস মেলাগুলি আলোর সজ্জায় ঝলমল করে উঠে। শহর নগর সর্বত্র ক্রিসমাস মেলায় পাওয়া যায় হাতে তৈরি শীত বস্ত্র, কাঠের তৈরি নানা সামগ্রী, রঙিন সব মোমবাতি, মিষ্টান্নজাতীয় খাবার, বাহারি পানীয়সহ থাকে ছোটদের খেলাধুলার নানা ব্যবস্থা।
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে এই বছরের ক্রিসমাসের সব আয়োজন লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। বিভিন্ন দেশে কড়া লকডাউনের বিধি ও নিষেধাজ্ঞাগুলোর বেড়াজালে থমকে গেছে সব আয়োজন। শুধু বাইরে নয়, মানুষজন যাতে করে বড়দিন উৎসবে ঘরে ঘরে মিলিত না হতে পারে সেই বিষয়ে সুস্পষ্ট করে বলা হয়েছে। খাদ্যসামগ্রী আর ঔষধালয়ের দোকান, অফিস, ব্যাংক ব্যতিরেকে স্কুল, কলেজ, থিয়েটার, রেস্টুরেন্ট, পানশালা সবকিছুই লকডাউনের কারণে বন্ধ রয়েছে। শহরের রাজপথগুলো অল্প কিছু মানুষ আর গাড়ি ট্রাম বাস ছাড়া জনশূন্য। সন্ধ্যা নামতেই ঠান্ডা আবহাওয়াই সর্বত্র কেমন থমথমে ভুতুড়ে পরিবেশ।

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে এই বছরের ক্রিসমাসের সব আয়োজন লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। বিভিন্ন দেশে কড়া লকডাউনের বিধি ও নিষেধাজ্ঞাগুলোর বেড়াজালে থমকে গেছে সব আয়োজন। শুধু বাইরে নয়, মানুষজন যাতে করে বড়দিন উৎসবে ঘরে ঘরে মিলিত না হতে পারে সেই বিষয়ে সুস্পষ্ট করে বলা হয়েছে।

জার্মানিতে বড়দিন উৎসবে যতটা সম্ভব কম ভ্রমণ করতে বলা হয়েছে। শুধু দুটি পরিবারের সর্বমোট পাঁচজনের বাইরে মিলিত হওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। বাইরেও কোনো অনুষ্ঠান বা মিলিত হওয়ার বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
জীবনে প্রথমবারের মতো বড়দিনে স্পেনের সহকারী প্রধানমন্ত্রী কারমেন কালভো, মাদ্রিদ থেকে আন্দুলসিয়াতে তার গ্রামের বাড়ি যাবেন না বলে জানিয়েছেন। তিনি করোনা মহামারির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সাফল্য না আসা পর্যন্ত বড়দিন ও নতুন বছর যাপন করবেন না বলে জানিয়েছেন। করোনাভারাসে পর্যুদস্ত দেশ স্পেনে বড়দিন উৎসবে শুধু ১০ জন নিকট আত্মীয় স্বজনদের মিলিত হওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
বড়দিন উৎসবের ঠিক আগে দিয়ে, যুক্তরাজ্যে করোনাভাইরাসের নতুন ধরন বা আগ্রাসী রূপান্তরের কারণে আকাশ ও সড়ক পথে অন্য দেশগুলির সঙ্গে সীমান্ত বন্ধ করা হয়েছে। এ ছাড়া ডিসেম্বরের শেষ দিন ইউরোপীয় জোট ছেড়ে চলে যাওয়া বা ব্রেক্সিট এসব নিয়ে যুক্তরাজ্য এখন হিমশিম খাচ্ছে। লন্ডনের মেয়র সাদিক খান স্কাই নিউজকে বলেছেন। “এই বছর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে যুক্তরাজ্যর জন্য সবচেয়ে খারাপ ক্রিসমাস"। গত রবিবার সন্ধ্যা থেকে ইউরো টানেলের মধ্য দিয়ে চালিত ফ্রান্সের ক্যালে ও যক্তরাজ্যের ডোভারের মধ্য সবজি ও খাদ্যপণ্য পরিবহনের লরিগুলো বন্দরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বড়দিন ও ব্রেক্সিট কার্যকর হওয়ার আগে এই দৃশ্য প্রত্যাশিত ছিল না। যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস, প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনকে করোনভাইরাস জনিত নতুন পরিস্থিতিতে ব্রেক্সিটের সময় এক মাসে বাড়ানোর জন্য অনুরোধ করেছে।
ফ্রান্সেও বড়দিনে পরিবারগুলোকে কেবলমাত্র ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে অনুষ্ঠান উদ্‌যাপন করতে বলা হয়েছে। ডিসেম্বরের শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী জ্যঁ ক্যাসটেক্স প্রস্তাব করেছেন যে ক্রিসমাস উদ্‌যাপন শুধুমাত্র ছয় প্রাপ্তবয়স্ক ও শিশুদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। এ ছাড়া ক্যাফে, বার, থিয়েটার জাদুঘর ক্রিসমাসের সময় থেকে নতুন বছর পর্যন্ত বন্ধ থাকবে। অগ্নিকাণ্ডের পর প্রথমবারের মতো প্যারিস শহরে বিখ্যাত নটরডেম ক্যাথেড্রাল গির্জায় ক্রিসমাসের প্রাক্কালে শ্রোতা ছাড়াই একটি ধর্মীয় গানের কনসার্ট মধ্যরাতে প্রচার হওয়ার কথা রয়েছে।

অস্ট্রিয়াতে বড়দিনে পরিবারের সর্বোচ্চ ১০ জন সদস্য নিয়ে বড়দিন উৎসব পালনের কথা বলা হয়েছে। সুইজারল্যান্ডে ক্রিসমাসের প্রাক্কালে, কিছু আগে থেকেই শীতকালীন স্কিইংয়ের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। আল্পস পাহাড়র ঢালে বরফমন্ডিত এলাকায় জনপ্রিয় এই শীতকালীন স্পোর্টস করতে ইতিমধ্যে যুক্তরাজ্য থেকে ১০ হাজর মানুষ সুইজারল্যান্ডে এসেছে। যুক্তরাজ্য নতুন ধরনের পরিবর্তিত করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর সুইজারল্যান্ডে কর্তৃপক্ষ এখন যুক্তরাজ্য থেকে আগত পর্যটকদের অবিলম্বে নিকটস্থ কর্তৃপক্ষের কাছে রেজিস্ট্রেশনের আদেশ দিয়েছেন।
মধ্য ও উত্তর ইউরোপের আকাশ নভেম্বর মাস থেকেই কয়েক মাসের জন্য কালো ধোঁয়াশা রূপ ধারণ করে। দুপুর হতেই অন্ধকার আকাশ এবার আরও নিকোশ কালো অন্ধকারে যুক্ত হয়েছে করোনাভাইরাস জনিত আতঙ্ক। বড়দিন উৎসবকে ঘিরে বাড়িতে, দোকানে, শহরর কেন্দ্রে এবারও ‘ক্রিসমাস ট্রি’ আলোকমালায় সজ্জিত হয়েছে বটে তবে পরিবেশটা নিরানন্দময় ভুতুড়ে।
ইতিমধ্যেইই করোনাভারাসজনিত কারণে ইউরোপে ৫ লক্ষেরও বেশি মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। এই বছর ক্রিসমাস উৎসবে ঘিরে সারা ইউরোপে বড়দিন উৎসবের সকল আনন্দ উচ্ছ্বাসের পরিবর্তে থমকে গেছে বড়দিনের উৎসবের সব আয়োজন।

সরাফ আহমেদ প্রথম আলোর জার্মান প্রতিনিধি