প্রাস্তাবিত বাজেট ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। এককথায় বাজেটটি গতানুগতিক এবং আগের বছরগুলোর ন্যায় সব খাতকে একটি নির্দিষ্ট হারে বৃদ্ধি করা হয়েছে।
করোনা–উত্তর অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার ও ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক মন্দা, জ্বালানি তেলসহ অধিকাংশ পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ইত্যাদি বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক উচ্চ লক্ষ্যমাত্রা প্রত্যাশার কারণে বাজেটকে ‘উচ্চাভিলাষী’ও বলা যায়।
উন্নয়ন বাজেট বাস্তবায়ন, রাজস্ব আয় আহরণ, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, প্রবৃদ্ধি অর্জন ইত্যাদিতে যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, তা অর্জন করা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। এ জন্যই এ বাজেটকে উচ্চাভিলাষী বলেছি।
বাজেটের সামগ্রিক ঘাটতি ২ লাখ ৪৫ হাজার ৬৪ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৫ দশমিক ৫ শতাংশ ও বাজেটের ৩৬ দশমিক ১৪ শতাংশ। এ ঘাটতি পূরণ করতে ঋণ নেওয়া হবে মোট ২ লাখ ৫৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা, যা বাজেটের ৩৮ দশমিক ১৭ শতাংশ। (বৈদেশিক ঋণ নেওয়া হবে ১ লাখ ১২ হাজার ৪৫৮ কোটি টাকা, যা বাজেটের ১৪ দশমিক ১ শতাংশ। অভ্যন্তরীণ ঋণ ১ লাখ ৪৬ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা, যা বাজেটের ২১ দশমিক ৬ শতাংশ)।
বাজেট প্রস্তাবিত প্রাপ্তি ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা সরকারের আয় এবং পরিচালন ব্যয় ৪ লাখ ১১ হাজার ৪০৬ কোটি টাকা। এ ব্যয়ের এককভাবে বড় একটি অংশ সুদ হিসেবে ৮০ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা বা এক লাখ কোটি টাকার মতো গৃহীত ঋণের ওপর পরিশোধ করতে হবে। (পূর্বে গৃহীত ঋণের সুদ যেটা আবর্তক ৭৩ হাজার ১৭৫ কোটি টাকা প্রতিবছর থাকবে। বৈদেশিক ঋণের ওপর সুদ যেটা আবর্তক ৭ হাজার ২০০ কোটি টাকা প্রতিবছর থাকবে।) সামনের বছরগুলোতে এটা বাড়তে থাকবে। অর্থাৎ এককথায় সরকার যা আয় করবে বলে প্রাক্কলন করেছে, তার প্রায় সবটুকুই খরচ হবে শুধু সরকার পরিচালনার ব্যয় ও পূর্বে নেওয়া ঋণের সুদ পরিশোধ করতে।
বাজেট বাস্তবায়ন ও নানাবিধ কারণে বর্ধিত কর আদায় প্রয়োজন হবে। তবে বর্ধিত কর আদায়ের যে প্রস্তাব করা হয়েছে, তা বাস্তবসম্মত মনে হয় না। গত অর্থবছরে যেখানে রাজস্ব থেকে প্রাপ্তির সংশোধিত বাজটটি ছিল ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা (মূল বাজেটেও একই টাকা ছিল)। বাস্তবে ২০২২ সালের মে পর্যন্ত আদায় হয়েছে ২ লাখ ৫২ হাজার ৯১০ দশমিক ৭৬ কোটি টাকা। যদি একই হারে রাজস্ব আদায় অব্যাহত থাকে, তবে (অর্থবছর শেষে মোট রাজস্ব আদায় হবে ২ লাখ ৭৫ হাজার ৯০২ দশমিক ৬৫ কোটি টাকা) এরপরও ঘাটতি থাকবে ৫৪ হাজার ৯৭ দশমিক ৩৫ কোটি টাকা। সেখানে আগামী অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের রাজস্ব প্রাপ্তি ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটের চেয়ে ৪০ হাজার কোটি টাকা (১২ শতাংশ বেশি)। বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে অবাস্তব বলে মনে করি।
সরকারের আয় না বাড়াতে পারলে অথবা পরিচালন ব্যয় কমাতে না পারলে আগামীতে ঋণ নিয়ে হয়তো পরিচালন ব্যয়ও নির্বাহ করতে হবে। আয় বাড়ানো বাস্তবসম্মত মনে হয় না। সে পরিপ্রেক্ষিতে পরিচালন ব্যয় কমানোর সর্বাত্মক প্রচেষ্টা নেওয়া বাঞ্ছনীয়।
উন্নয়ন ব্যয় ২ লাখ ৫৯ হাজার ৬১৭ কোটি টাকা, যার পুরোটাই দেশি–বিদেশি ঋণের টাকার ওপর নির্ভর। আগেই বলা হয়েছে, ঋণ নেওয়া হবে মোট ২ লাখ ৫৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। (বৈদেশিক ঋণ ১ লাখ ১২ হাজার ৪৫৮ কোটি এবং অভ্যন্তরীণ ঋণ ১ লাখ ৪৬ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা।) উন্নয়নের জন্য যে ঋণ নেওয়া হবে, তার কারণে সুদ ও আসল পরিশোধের অঙ্ক ভবিষ্যতে ব্যাপক হারে বাড়তে থাকবে। সে কারণে পরিচালন ব্যয় বাড়বে।
চলতি অর্থবছরের বাজেটে সংশোধিত এডিপি ছিল ২ লাখ ২১ হাজার ৯৪৮ কোটি টাকা। এর বিপরিতে জুলাই থেকে এপ্রিল—এই ১০ মাসে এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে ১ লাখ ১৯ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা বা ৫৪ শতাংশ। একই হারে যদি বাস্তবায়নের ধারা অব্যাহত থাকে, তবে অর্থবছর শেষে এডিপি বাস্তবায়ন হবে ১ লাখ ৪৩ হাজার ৭৯৫ কোটি টাকা বা ৬৪.৭৯ শতাংশ।
অর্থাৎ চলতি অর্থবছরের বাজেটেও উন্নয়ন ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। আগামী প্রস্তাবিত বাজেটে এডিপি বর্ধিত করে নির্ধারণ করা হয়েছে ২ লাখ ৫৯ হাজার ৬১৭ কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের তুলনায় ১৭ শতাংশ বেশি। বিদ্যমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে ও অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যায়, এডিপি বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না।
অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে বেশি ঋণ গ্রহণের কারণে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে তারল্যসংকট হবে। বেসরকারি বিনিয়োগকারীরা ঋণসুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি করবে। এতে কর্মসংস্থানের সুযোগ সংকুচিত হবে। বেকারত্বের এ দেশে বিষয়টি গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা বাঞ্ছনীয়।
বিদেশি ঋণের ঝুঁকি আরও মারাত্মক। কেননা, অর্থমন্ত্রীর কথায় বোঝা যায়, বাংলাদেশের বৈদেশিক রিজার্ভ দিনকে দিন কমছে। কারণ, আমদানি ব্যয় বাড়ছে, রপ্তানি আয় তেমন বাড়ছে না। প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো অর্থের পরিমাণও দেখা যাচ্ছে অস্থিতিশীল ও নিম্নগামী। সে পরিপ্রেক্ষিতে বৈদেশিক ঋণ নেওয়ার বিষয়ে আরও সাবধানতা অবলম্বন করা বাঞ্ছনীয়। বৈদেশিক ঋণ যত কম নেওয়া যায়, ততই ভালো মনে করি।
অর্থমন্ত্রী বক্তৃতায় বলেছেন, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলসহ অন্য অনেক নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বাড়ছে। একই সঙ্গে ডলারের বিপরীতে টাকা অবমূল্যায়িত হচ্ছে। ফলে সাধারণ মানুষের জন্য জীবনযাত্রার ব্যয় নির্বাহ করা দিনকে দিন কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১৯ সালের নগর আর্থসামাজিক অবস্থা নিরূপণ জরিপে একজন মানুষের গড় খাবার ব্যয়ের তথ্য প্রকাশ করা হয়। সেই খাদ্যতালিকার মধ্য থেকে সাধারণ ২০টি খাবারের (চাল, খোলা আটা, মোটা মসুর ডাল, খোলা সয়াবিন, দেশি পেঁয়াজ, রসুন, আদা, শুকনা মরিচ, হলুদ, রুই মাছ, গরুর মাংস, খাসির মাংস, ব্রয়লার মুরগি, তরল দুধ, গুড়া দুধ, ডিম, আলু, কলা, চিনি, লবণ) দাম ৩০ মে ২০২২ টিসিবির পণ্যমূল্য বিবেচনায় হিসাব করে সিপিডি একজন ব্যক্তির মাসিক ব্যয় নিরূপণ করেছে ৫ হাজার ৩৩৯ টাকা।
গত বছরের একই সময়ের (৩০মে ২০২১) তুলনায় শুধু খাবার খরচ মাসে বেড়েছে ১১ শতাংশ। যদিও ঘরভাড়া, রান্নার জ্বালানি, বিদ্যুৎ খরচ, চিকিৎসা ব্যয়, স্বাস্থ্য সুরক্ষা পণ্য ক্রয়, সন্তানের পড়াশোনার খরচ, দৈনন্দিন যাতায়াত ইত্যাদি খরচ উল্লিখিত হিসাবের বাইরে।
যদিও এরই মধ্যে অনেক পণ্যের মূল্য ৩০-৪০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। এমন বাস্তবতায় সরকার নির্ধারিত মূল্যস্ফীতির হিসাব ও বাস্তবের মূল্যস্ফীতির সঙ্গে পার্থক্য অনেক বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
ইতিমধ্যে সরকারি সংস্থা বিবিএস সম্প্রতি মে ২০২২–এর সার্বিক মূল্যস্ফীতির হালনাগাদ রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। সেখানে দ্রব্যমূল্যের মূল্যস্ফীতি নির্ধারণ করেছে ৮ দশমিক ৩০ শতাংশ এবং সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৭ দশমিক ৪২ শতাংশ। সে পরিপ্রেক্ষিতে প্রস্তাবিত বাজেটে আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৬ শতাংশ হবে, আশা করা অবাস্তব।
এটা প্রায় নিশ্চিতভাবে বলা যায়, সাধারণ মানুষের জীবন বাঁচাতে ভবিষ্যতে সরকারকে কর লাঘবসহ ভর্তুকি দিতে হবে। ফলে সরকারের প্রাপ্তি কমবে, খরচ বাড়বে, সার্বিক ঘাটতি আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। সে ক্ষেত্রে উন্নয়ন বাজেটগুলো কমাতে হবে। প্রবৃদ্ধির গতি নিম্নমুখী হওয়ার আশঙ্কা আছে। সে পরিপ্রেক্ষিতে ২০২২-২৩ প্রস্তাবিত বাজেটে প্রবৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ৫ শতাংশ নির্ধারণ বাস্তবসম্মত নয় বলে মনে করি।
আমাদের মোট ঋণের পরিমাণ ২০২২ সাল পর্যন্ত ১৩ লাখ ৫১ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ৩৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ। মাথাপিছু মোট ঋণের পরিমাণ ৭৯ হাজার ১০৩ টাকা। (চলতি অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটে জিডিপি দেখানো হয়েছে ৩৯ লাখ ৭৬ হাজার ৪৬২ কোটি টাকা। বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ৫ লাখ ৬০০ কোটি টাকা বা জিডিপির হিসাবে ১২ দশমিক ৫৯ শতাংশ প্রায় এবং দেশীয় উৎস থেকে নেওয়া ঋণের পরিমাণ ৮ লাখ ৫০ হাজার ৪০০ কোটি টাকা বা জিডিপির হিসাবে ২১ দশমিক ৩৯ শতাংশ প্রায়)।
প্রস্তাবিত ২০২২-২৩ অর্থবছরে মোট ঋণের পরিমাণ প্রস্তাব করা হয়েছে ২ লাখ ৫৮ হাজার ৭৯০ কোটি টাকা। (ঋণের পরিমাণ জিডিপির ৫ দশমিক ৮২ শতাংশ প্রায়। প্রস্তাবিত বাজেটে জিডিপি নির্ধারণ করা হয়েছে ৪৪ লাখ ৪৯ হাজার ৯৫৯ কোটি টাকা। বিদেশি ঋণ ১ লাখ ১২ হাজার ৪৫৮ কোটি টাকা বা জিডিপির হিসাবে ২ দশমিক ৫৩ শতাংশ প্রায় এবং অভ্যন্তরীণ ঋণ ১ লাখ ৪৬ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা বা জিডিপির হিসাবে ৩ দশমিক ২৯ শতাংশ প্রায়)।
অর্থাৎ আমাদের মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়াল ১৬ লাখ ৯ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৩৬ দশমিক ১৮ শতাংশ প্রায় (এর মধ্যে বৈদেশিক ঋণ ৬ লাখ ১৩ হাজার ৫৮ কোটি টাকা বা জিডিপির হিসাবে ১৩ দশমিক ৭৮ শতাংশ প্রায় এবং অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ৯ লাখ ৯৬ হাজার ৭৩৫ কোটি টাকা বা জিডিপির হিসাবে ২২ দশমিক ৪০ শতাংশ প্রায়)। মাথাপিছু মোট ঋণের পরিমাণ ৯২ হাজার ৬৬২ টাকা (মাথাপিছু বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ৩৫ হাজার ২৯৪ টাকা ও মাথাপিছু দেশি ঋণের পরিমাণ ৫৭ হাজার ৩৬৮ টাকা)।
আমরা অনেক সক্ষমতা অর্জনের জন্য গর্ব করি। আমাদের বড় প্রকল্পগুলোতে কারিগরি কাজগুলো বিদেশি প্রকৌশলী ও বিশেষজ্ঞদের দ্বারা সম্পন্ন করা হচ্ছে। নিজস্ব বৈজ্ঞানিক, প্রকৌশলী বা কারিগরদের অংশগ্রহণ ন্যূনতম। এ প্রকল্প বাস্তবায়নে আমাদের দেশীয় যে লোকবলের অংশগ্রহণ ছিল বলা হয়, তাদের অধিকাংশ হলো অদক্ষ, স্বল্প দক্ষ ও আধা দক্ষ মানের। অর্থাৎ আমাদের কারিগরি সক্ষমতা তৈরি হয়নি।
এখন দেখা যাক, আমাদের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর অর্থায়ন কীভাবে হয়? বর্তমানে প্রস্তাবিত উন্নয়ন বাজেট সম্পূর্ণ অর্থায়ন প্রস্তাব ঋণের মাধ্যমে। আগেই বলা হয়েছে, এখন পর্যন্ত প্রস্তাবিত বাজেটসহ আমাদের মোট সমষ্টিগত ঋণের পরিমাণ ১৬ লাখ ৯ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। এ কারণে আগেই বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ১৭ কোটি মানুষের ঋণের বোঝা ৯২ হাজার ৬৬২ টাকা। অর্থাৎ অর্থনৈতিকভাবেও আমরা এখনো পরমুখাপেক্ষী। নিজস্ব অর্থে বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের সক্ষমতা অর্জিত হয়নি।
গোলাম মোহাম্মদ কাদের সংসদ সদস্য ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও সংসদের বিরোধীদলীয় উপনেতা