আজ–কাল–পরশু

এফবিসিসিআইয়ের নির্বাচনও প্রশ্নবিদ্ধ

এফবিসিসিআইয়ের নির্বাচনে ভোটারদের একাংশ
এফবিসিসিআইয়ের নির্বাচনে ভোটারদের একাংশ

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ ফোরাম ‘বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন’ (এফবিসিসিআই)-এর দ্বিবার্ষিক নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে সম্প্রতি। এফবিসিসিআই নেতারা (একাংশ) কেন এ রকম একটি পাতানো খেলায় অংশ নিলেন জানি না।

গত কয়েক টার্মে এফবিসিসিআই নির্বাচন মোটামুটি প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলকভাবেই হয়েছে। অন্য দশটা পেশাজীবী সংগঠনের নির্বাচন যেভাবে হয়ে থাকে। যদিও বিভিন্ন সরকারের সময়ে দেশের সরকারপ্রধান কাকে সভাপতি পদে সবুজ সংকেত দেন তা টের পাওয়া যায় ও গেছে। সেটা ওপেন সিক্রেট হলেও নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা কম হতো না। এবার সরকারঘেঁষা ব্যবসায়ীরা আর কোনো ঝুঁকি নিতে চাননি। তাঁরা তাঁদের প্যানেলকে জয়ী করার জন্য নির্বাচনে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতাই হতে দেননি। যেটুকু হয়েছে তা নামমাত্র। অনেকটা লোক দেখানো।

সংবাদপত্র লিখেছে, ‘মূলত এফবিসিসিআইয়ের এই নির্বাচনে এক অংশের ব্যবসায়ীরা উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট দিয়েছেন। একই সংগঠনের আরেকটি অংশের ভোটাররা নিজেদের নেতা নির্বাচনে ভোট দেওয়ার সুযোগই পাননি। বিপরীতমুখী এ চিত্রের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হয় এফবিসিসিআইয়ের ২০১৭-১৯ মেয়াদের পরিচালনা পরিষদের নির্বাচন।’ (প্রথম আলো, ১৫ মে)

ঢাকার সব সংবাদপত্র যে এ রকম রিপোর্ট করেছে তা নয়। অনেক সংবাদপত্রের রিপোর্ট পড়ে পাঠকের মনে হতে পারে, একটি সুন্দর ও স্বাভাবিক নির্বাচনই অনুষ্ঠিত হয়েছে। এবার এফবিসিসিআই নির্বাচনের প্রায় দুই মাস আগে থেকে এমন একটা পরিবেশ তৈরি করা হয়েছিল যে এই নির্বাচনে সরকার সমর্থক প্যানেলই জয়ী হবে। অন্য কোনো প্যানেলের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার প্রয়োজন নেই, সুযোগও নেই। বলা বাহুল্য, এসব প্রচারণা ছিল সবই অনানুষ্ঠানিক। কাজেই কোনো ব্যবসায়ীর পক্ষে তা নিয়ে আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ করা, মামলা করা বা বাধা দেওয়ার সুযোগ ছিল না। তবে যাঁরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার কথা বহুদিন ধরে ভেবেছিলেন, তাঁরা সরকারি মহলের বার্তা ঠিকই পেয়ে গেছেন। ফলে তাঁরা গোলমাল করে বা হইচই করে কোনো বাধা সৃষ্টি করতে চাননি। নীরবে এই অপমান হজম করেছেন। সরকারি শক্তির সঙ্গে লড়াই করে কেউ কি টিকতে পারে?

চেম্বারে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না হওয়ার বিষয়টি এফবিসিসিআই ব্যাখ্যা করছে এভাবে, ‘চেম্বারে সমঝোতার মাধ্যমে বিরোধী প্রার্থীরা সরে যাওয়ায় ভোটের প্রয়োজন হয়নি।’ নবনির্বাচিত সভাপতি শফিউল ইসলাম এ প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘ভোট উৎসবমুখর হয়েছে। তাতে আমরা খুশি। চেম্বারে ভোট হলে ভালো হতো। তবে প্রার্থী হওয়া না-হওয়া গণতান্ত্রিক অধিকার।’ (প্রথম আলো)

প্রশ্নবিদ্ধ জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতারা যে ভাষায় কথা বলেছিলেন, শফিউল ইসলামের ভাষা বা মনোভাবও প্রায় সে রকম। সরকারের নানা প্রভাব ও শক্তি ব্যবহার করে বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের নির্বাচনে সরকারপন্থী প্যানেলের বিজয় এখন প্রায় স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এফবিসিসিআইয়ের সাম্প্রতিক নির্বাচন তার একটি উদাহরণ।

এর আরেকটি দিক রয়েছে। শুধু সরকারের সমর্থন বা প্রভাবের জোরে সরকারপন্থী প্যানেল বিভিন্ন পেশাজীবী ফোরামে জয়লাভ করছে, তা নয়। আমাদের দেশে জাতীয় নির্বাচনসহ বিভিন্ন পেশাজীবী ফোরামে আওয়ামী লীগ সমর্থক প্যানেলের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হলো বিএনপি। আওয়ামী লীগ এখন সরকারে থাকলেও বিভিন্ন ফোরামে অনেক সময় বিএনপিপন্থী প্যানেলও জয়লাভ করেছে। বার অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাচন তার একটি বড় প্রমাণ। তবে এ ধরনের বিজয় খুবই ব্যতিক্রমী ঘটনা। স্বাভাবিক ঘটনা হলো: সরকারপন্থী প্যানেলের বিজয়। এ জন্য নির্বাচনে যত কারসাজি করা যায়, সরকারি পক্ষ তা করতে দ্বিধা করে না।

পরপর দুবার সরকার পরিচালনা করার সুযোগ পেয়ে আওয়ামী লীগ এখন দেশে মহাশক্তিধর দলে পরিণত হয়েছে। তাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি নিজেদের কিছু ভুল নীতি, সরকার পরিচালনায় নানা ব্যর্থতা ও ব্যাপক দুর্নীতি, শীর্ষ নেতৃত্বের দুর্বলতা, ঢাকা ও লন্ডনকেন্দ্রিক নীতিনির্ধারণী প্রক্রিয়া, দলের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে রাজনৈতিক মত ও চিন্তার ঐক্যের অভাব, ঊর্ধ্বতন নানা নেতাদের পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস, গুলশান-নয়াপল্টন দূরত্ব ইত্যাদি আরও নানা কারণে বিএনপি একটি দুর্বল দলে পরিণত হয়েছে। তার ওপরে রয়েছে বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে সরকারের নানা সত্য-মিথ্যা মামলা, জেল-জুলুম, আত্মগোপন, মামলা পরিচালনায় হয়রানি ও বিপুল অর্থ ব্যয় ইত্যাদিতে বিএনপি নেতারা প্রায় কোণঠাসা ও হতাশ। তাঁদের পক্ষে সুষ্ঠুভাবে দল পরিচালনা, বিভিন্ন নির্বাচন পরিচালনা, বিভিন্ন ফোরামে দলীয় সমর্থকদের সহযোগিতা করা শুধু কষ্টকরই নয়, কঠিনও বটে। আমাদের ধারণা, এটাই সরকারের লক্ষ্য ছিল। সরকার তাতে সফল হয়েছে। কাজেই এফবিসিসিআইয়ের নির্বাচন এ রকম প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন হবে, এটাই স্বাভাবিক।

দেশে এখন যে নির্বাচনের সংস্কৃতি জেঁকে বসেছে তা হয় আপসের, বা ভোটারহীন অথবা প্রতিদ্বন্দ্বীহীন নির্বাচন। সরকার ভোটে আগ্রহী নয়, আগ্রহী ভোটের ফলাফলের আনুষ্ঠানিক গেজেটে, যা হাতে পেলে সরকারি দল বাকি সব কাজ বিনা বাধায় করতে পারে। এ দেশে ভোটে অনিয়ম, কারচুপি, সন্ত্রাস, ভোটকেন্দ্র জবরদখল ইত্যাদি নিয়ে কোনো সুষ্ঠু বিচার হয় না।গত ৪৫ বছরে এ রকম ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার খুব কমই হয়েছে। ফলে ভোটের ফলাফল প্রকাশের পর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষ আর বিচার চায় না। কারণ, বিচারে কী হবে তা সবার জানা।

বাংলাদেশের রাজনীতি, গণতন্ত্র, নির্বাচন এই দূষিত পরিবেশ থেকে কবে মুক্তি পাবে জানি না। কীভাবে মুক্তি পাবে তাও
জানি না।

জাতীয় নির্বাচন অনেক বড় বিষয়। সামনে জাতীয় নির্বাচন আসছে। জাতীয় নির্বাচন নিয়ে কথা বলার সুযোগ সামনে আরও পাওয়া যাবে। এফবিসিসিআইয়ের মতো ছোট ছোট নির্বাচনও যে কলুষিত হয়ে যাচ্ছে, তা থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় কী?

এবারের এফবিসিসিআইয়ের নির্বাচনে চেম্বারের পরিচালক পদে ভোট না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে উত্তরবঙ্গের একটি চেম্বারের একজন ভোটার নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, ৬০টি পদের মধ্যে ৪২টিতে যদি ভোটারদের ভোট দেওয়ার প্রয়োজন না হয়, তাহলে সেই পরিচালনা পর্ষদের কি ভোটারদের প্রতি দায়বদ্ধতা থাকবে? আরেকজন ভোটার বলেন, প্রার্থীদের বসিয়ে দিতে বিপুল অর্থের লেনদেন হয়েছে। (প্রথম আলো)

এফবিসিসিআইয়ের কমিটিতে স্থান পাওয়া এখন লাভজনক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। নানাভাবে লাভজনক। ব্যবসায়ী মহলে এটা সবাই জানেন। ফলে যেকোনোভাবে নির্বাচিত হওয়াই এখন মূল্য লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমান সরকারের নানা দোষ থাকলেও তাদের গুণও কম নয়। যেমন, কোনো পেশা, গ্রুপ, ফোরাম, ব্যক্তিত্ব, সরকার বা সরকারি দলকে নিঃশর্ত সমর্থন দিলে, নিঃশর্ত আনুগত্য প্রকাশ করলে বাসরকারের প্রতি শর্তহীন অনুগত থাকলে সরকার তাঁদের মূল্যায়ন করে। এটা বর্তমান সরকারের একটা বড় গুণ। কিন্তু আত্মসম্মানসম্পন্ন সুশিক্ষিত ও রুচিমান ব্যক্তিদের পক্ষে কোনো দল বা সরকারের প্রতি নিঃশর্ত অনুগত হওয়া সম্ভব নয়। তাঁরা দলের আদর্শে বিশ্বাসী হয়ে দলের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারেন। কিন্তু সামান্য সুযোগ-সুবিধার জন্য, ক্ষণিকের সম্মানের জন্য তাঁরা প্রকাশ্যে স্তাবকতা করতে পারেন না। যাঁরা রাজনৈতিক দলের সক্রিয় নেতা ও কর্মী, তাঁদের কথা আলাদা। তাঁদের হিসাব–নিকাশ ভিন্ন। কিন্তু পেশাজীবী ফোরাম বা বিভিন্ন পেশার লোকেরা, যাঁদের ভিন্ন ভিন্ন দলের সরকারের সঙ্গে কাজ করতে হয়, তাঁরা যখন নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থে সরকার বা সরকারি দলের কাছে আত্মসমর্পণ করেন, তা মোটেও প্রশংসনীয় বিষয় আর থাকে না। আমাদের সাংবাদিক সমাজেরও কেউ কেউ এখন দুর্ভাগ্যজনকভাবে সরকারি দলের ‘জনসংযোগ কর্মীতে’ পরিণত হয়েছেন।

এফবিসিসিআইয়ের নির্বাচনে যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। তা আর ফিরিয়ে আনা যাবে না। ভোটের ফল আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে। তা ওল্টানোর সুযোগ নেই। ভবিষ্যতে যেন এমনটি না হয়, সরকার যেন এসব পেশাজীবী ফোরামের নির্বাচনে নাক গলাতে না পারে তার জন্য কী কী ব্যবস্থা নেওয়া যায় তা নিয়ে সুষ্ঠু চিন্তাধারার ব্যবসায়ীরা এখন থেকে আলাপ–আলোচনা শুরু করুন। দলবাজ ব্যবসায়ীদের চক্রান্তের কাছে আত্মসমর্পণ করা কিছুতেই ঠিক হবে না। দলবাজ ব্যবসায়ীরা দুর্বল। কারণ, তঁারা সুবিধাবাদী। তাঁরা যা কিছু করছেন নিজেদের স্বার্থের জন্য করছেন। ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর জন্য করছেন না।

আশা করি ভবিষ্যতে এফবিসিসিআইয়ের নির্বাচনে গণতান্ত্রিক চেতনা ও মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠিত হবে। এ জন্য দরকার সমমনা ব্যবসায়ীদের ঐক্য।

মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: মিডিয়া ও উন্নয়নকর্মী।