আজ–কাল–পরশু

এনজিওর কণ্ঠরোধের নতুন আইন

.

জাতীয় সংসদে সম্প্রতি পাস হাওয়া বেসরকারি সংগঠনের (এনজিও) বৈদেশিক অনুদানসম্পর্কিত আইনের একটি ধারা (১৪ ধারা) সম্পর্কে ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে। আইনের এই ধারায় বলা হয়েছে, ‘সংবিধান ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে বিদ্বেষমূলক ও অশালীন মন্তব্য করলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এ কারণে এনজিও ব্যুরো সংশ্লিষ্ট বেসরকারি সংগঠনের (এনজিও) নিবন্ধন বাতিল করতে পারবে।’
কয়েক দিন আগে কয়েকটি বেসরকারি সংগঠন, এফএনবি ও অ্যাডাব (এডিএবি) এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে আইনের এই ধারার কঠোর সমালোচনা করে বলেছে, ‘বৈদেশিক অনুদান আইন সংবিধানের মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী। এই আইনের অপব্যাখ্যা ও অপব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। এটি একটি নিয়ন্ত্রণমূলক আইন। এই আইনে “বিদ্বেষমূলক” ও “অশালীন” শব্দের ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। কাজেই এর অপব্যবহার হতে পারে।’
বাংলাদেশে ও অন্যান্য দেশে দেশি-বিদেশি অনুদান নিয়ে বিভিন্ন রকম এনজিও কাজ করে থাকে। সব এনজিও মাঠে-ময়দানে কাজ করে না। কোনো কোনো এনজিও গবেষণামূলক কাজ করে। গবেষণার বিষয় হতে পারে গণতন্ত্র, নির্বাচন, মানবাধিকার, জাতীয় সংসদ, দুর্নীতি, সুশাসন ইত্যাদি। কোনো বিশেষ সরকারকে লক্ষ্য করে এসব গবেষণা হয় না। গবেষণা হয় বাস্তব পরিস্থিতির ভিত্তিতে। বাস্তব পরিস্থিতি যদি সরকারের পক্ষে না থাকে, তাহলে গবেষণার ফলও সরকারের পক্ষে থাকে না। আবার এর উল্টোও হতে পারে। প্রতিটি গবেষণায় পরিস্থিতির মান উন্নয়নের জন্য কিছু সুপারিশ থাকে, যাতে সরকার তা বাস্তবায়ন করে পরিস্থিতির উন্নয়ন করতে পারে। এসব এনজিও যে প্রকৃতপক্ষে সরকারের সুহৃদ, এই সুপারিশমালায় তা প্রমাণিত হয়। অনেক সময় সরকার এসব গবেষণায় সন্তুষ্ট হয় না। কখনো কখনো ক্ষুব্ধ হয়। কারণ, এসব এনজিও সরকারের, জাতীয় সংসদের কিংবা অন্য কোনো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের দুর্বলতা জনসমক্ষে উন্মোচন করে। সরকার তা মানতে পারে না।
দেশের কয়েকটি বিরোধী দলও সরকারের নানা প্রতিষ্ঠান ও কার্যক্রমের সমালোচনা করে থাকে। কিন্তু সরকার সেই সমালোচনাকে তত গুরুত্বপূর্ণ মনে করে না। কারণ, বিরোধী দলের সমালোচনায় তেমন তথ্য থাকে না, গবেষণাও থাকে না। থাকে শুধু বক্তৃতা। সরকার মনে করে, শুধু বক্তৃতার ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা নেই। তাই বিরোধী দলের সব সমালোচনা সরকার গায়ে মাখে না। কখনো ব্যতিক্রমও হয়। কিন্তু গবেষণামূলক সমালোচনাকে সরকার ভয় পায়। কারণ, এখানে নিছক বক্তৃতা থাকে না। থাকে তথ্য, মতামত ও প্রমাণ। সরকার বা জাতীয় সংসদ এ রকম গবেষণাকে উড়িয়ে দিতে পারে না।
বৈদেশিক অনুদানে পরিচালিত কয়েকটি এনজিও সরকারের কিছু কার্যক্রম নিয়ে সমালোচনা করে। তবে তারা ঠুনকো রাজনৈতিক ইস্যু নিয়ে কথা বলে না। তাদের আলোচ্য বিষয় গণতন্ত্র, নির্বাচন, জাতীয় সংসদ, মানবাধিকার, দুর্নীতি, সুশাসন ইত্যাদি। তাদের অনেক গবেষণামূলক তথ্য সরকার খোলা মনে গ্রহণ করতে পারছে না। আবার পাল্টা তথ্যপ্রমাণ দিয়ে বিরোধিতাও করতে পারছে না। কিছু মন্ত্রী ও নেতা শুধু বক্তৃতা দিয়ে বিরোধিতা করছেন। রাজনীতিবিদদের বক্তৃতা ছাড়া কোনো অস্ত্র নেই। কিন্তু এনজিওগুলো গবেষণার মাধ্যমে সমালোচনা করে।
সরকারের কিছু ব্যক্তি হয়তো ভেবেছেন, তাঁরা বিএনপির মতো এত বড় দলকে কাবু করে ফেলেছেন, এনজিওগুলো কোন ছার? কিন্তু রাজনৈতিক দল ও বৈদেশিক অনুদানে পরিচালিত এনজিও এক জিনিস নয়। সরকার এখানে একটু চালে ভুল করে ফেলেছে। সরকার বিএনপিকে পেট্রলবোমা সন্ত্রাস, জামায়াত-সঙ্গ, দুর্নীতি ইত্যাদি নানা অভিযোগে দুর্বল করতে পারে, কিন্তু কোনো এনজিওকে এগুলো বলার সুযোগ নেই। এই আইন করতে গিয়ে এনজিওর সঙ্গে জঙ্গিসম্পৃক্ততার প্রশ্ন উঠেছে। ‘জঙ্গিসম্পৃক্ততা’ সরকারের একটি সাম্প্রতিক প্রিয় বিষয়। এটা হলুদের মতো। যেকোনো তরকারিতে দেওয়া যায়। এনজিওগুলোর তথাকথিত ‘জঙ্গিসংশ্লিষ্টতা’র ভয় নেই। তারা সংবাদ সম্মেলনে সরকারকে বলেছে, ‘জঙ্গি তৎপরতা সম্পর্কে আমাদের চেয়ে সরকারের কাছে বেশি তথ্য আছে, সেটা তারা প্রকাশ করুক। আমরা দেখতে চাই, কতটা এনজিও বা এনজিও-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি জড়িত আছে।’
সবাই জানেন, বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ কার্যকর নয়। সাংসদদের যে কাজ, তা অনেকে ঠিকমতো পালন করেন না। আইন প্রণয়নের সঙ্গে খুব কম সাংসদই যুক্ত থাকেন। সংসদীয় কমিটিগুলো ঠিকমতো কাজ করে না, কয়েকটি কমিটি বছরের পর বছর কোনো মিটিংই করে না। অনেক সংসদীয় কমিটির সদস্য মন্ত্রণালয়ের কাছে তাঁদের বিদেশে পাঠানোর জন্য আবদার করেন—এসব তথ্য সংবাদপত্রে প্রায়ই প্রকাশিত হয়। কোনো এনজিও যদি এগুলো গবেষণা আকারে প্রকাশ করে থাকে, তাহলে বলব, তারা নতুন কিছু করেনি। এসব তথ্য উদ্ঘাটনের কৃতিত্ব দিতে হবে সাংবাদিকদের, কোনো এনজিওকে নয়। তবে কোনো এনজিও হয়তো আরও বেশি তথ্যসহ তাদের রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। সরকার কি এ ধরনের রিপোর্টকে ‘বিদ্বেষমূলক’ বা ‘মানহানিকর’ বলছে? তা বলবে কেন? এখন সাংসদদের অন্যায়-অনিয়ম যদি তথ্যপ্রমাণসহ প্রকাশিত হয় এবং তথ্যগুলো যদি মানহানিকর হয়, তাহলে এনজিও কী করতে পারে? সরকার বা পার্লামেন্ট তথ্যগুলোকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে। পাল্টা তথ্য দিয়ে রিপোর্টের ভুলভ্রান্তি তুলে ধরতে পারে। এনজিও এনজিওর কাজ করেছে, সেটা তার অ্যাজেন্ডা। সরকার তার কাজ করবে। সাধারণ মানুষ দুই পক্ষের বক্তব্য শুনে নিজেদের মতামত নির্ধারণ করবে। কোনো এনজিও যদি সরকারি প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে সব সময় ভুল তথ্য বা মনগড়া তথ্য পরিবেশন করে, তাহলে জনগণ কখনো সেই তথ্য গ্রহণ করবে না। এনজিওগুলো তাদের গবেষণামূলক রিপোর্ট প্রকাশ করার আগে সংবাদপত্রেই এ ধরনের তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। কাজেই কারও ‘মানহানি’ হয়ে থাকলে তা আগেই হয়েছে।
প্রতিটা দেশেই পার্লামেন্ট, নির্বাচন, দুর্নীতি, মানবাধিকার, বিচারব্যবস্থা ইত্যাদি যথাযথ দায়িত্ব পালন করছে কি না, জনগণের অর্থ ঠিকমতো ব্যয় করছে কি না, তা দেখার জন্য বেসরকারি সংগঠন রয়েছে। এগুলো নতুন কিছু নয়। বিশ্বব্যাপী একযোগে কাজ করছে এমন প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। তাদের কাজই মনিটরিং করা। প্রতিটা সভ্য ও গণতান্ত্রিক দেশ এ ধরনের সংগঠনকে কাজ করার অনুমতি দেয় ও সহযোগিতা করে। বিভিন্ন সময় বাংলাদেশ সরকারও সহযোগিতা করে। কিন্তু এখন সরকার কোনো সমালোচনা শুনতে রাজি নয়। তাই বৈদেশিক অনুদান আইনের (১৪ ধারা) মাধ্যমে কিছু এনজিওকে শায়েস্তা করতে চায়। যেসব এনজিও সরকারের নানা প্রতিষ্ঠানের দুর্বলতা জনসমক্ষে তুলে ধরে।
বাংলাদেশের উন্নয়নে অনেক উন্নত রাষ্ট্র সহায়তা দিয়ে থাকে। তারা বিভিন্ন এনজিওকে সহায়তা দিয়ে থাকে। এসব উন্নত রাষ্ট্র চায়, যেসব দেশকে তারা উন্নয়নের জন্য সহায়তা দিচ্ছে, সেখানে যেন প্রকৃত গণতন্ত্রের চর্চা হয়, সঠিক পদ্ধতিতে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হয়, পার্লামেন্ট কাজ করে, পার্লামেন্ট সদস্যরা যেন তাঁদের কর্তব্য ও দায়িত্ব পালন করেন, যেন মানবাধিকার বজায় থাকে, নারীরা যেন নিগৃহীত না হন, দুর্নীতি যেন হ্রাস পায়, দুর্নীতিবাজ ব্যক্তিদের যেন বিচার হয়, সরকারি প্রতিষ্ঠান যেন টাকার শ্রাদ্ধ না করে ইত্যাদি। এসব ব্যাপারে মনিটরিং করার জন্য বিভিন্ন দেশ নানা সংগঠনকে অর্থ সহায়তা দিতে থাকে। সেই অর্থ প্রকৃত কাজে ও ঠিকভাবে ব্যয় হচ্ছে কি না, তা আবার দেখে সরকারের এনজিও ব্যুরো। সরকারের নাগালের বাইরে গিয়ে কোনো এনজিও বিদেশের টাকা ব্যয় করতে পারে না। সবখানে সরকারের নজরদারি রয়েছে। কাজেই এ কথা বলার কোনো সুযোগ নেই, কোনো এনজিও বৈদেশিক সহায়তা নিয়ে যা খুশি তা করছে। প্রতিটি প্রকল্পের দেশি ও বিদেশি ফার্ম দিয়ে অডিট হয়ে থাকে। এসব কাজে কোনো দুর্বলতা বা ফাঁক সরকার আবিষ্কার করেছে বলে শোনা যায়নি।
সংবিধান ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ঠিকমতো চলছে কি না, তা দেখার জন্যই কিছু এনজিও বৈদেশিক অনুদান পেয়ে থাকে। তাদের কাজে সরকার বাধা দিলে যারা অনুদান দিচ্ছে, তারা ক্ষুণ্ন হবে। তারা ক্ষুণ্ন হলে সরকারের জন্য ভালো হবে িক মন্দ হবে, তা বোঝার ক্ষমতা সরকারের নিশ্চয় রয়েছে। তবে সরকারের বা সাংবিধানিক কোনো প্রতিষ্ঠানের অশালীন সমালোচনা করা ঠিক নয়। সবাইকে গঠনমূলক সমালোচনা করতে হবে। কোনো রিপোর্ট বা মন্তব্যকে সরকার ‘অশালীন’ মনে করলে তা দলনিরপেক্ষ কোনো কমিটির মাধ্যমে যাচাই করতে হবে। সরকার বা সরকারদলীয় কোনো কমিটি এককভাবে তা যাচাই করতে পারবে না। তাতে নিরপেক্ষতা বজায় থাকবে না। তবে সবচেয়ে ভালো হয়, এই ১৪ ধারাটি বাদ দেওয়া। এই ধারা থাকলে তার অপব্যাখ্যা ও অপব্যবহারের সুযোগ থেকে যাবে।
কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। সুষ্ঠু ও গঠনমূলক সমালোচনা গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত। আমরা মধ্যম আয়ের দেশ হতে চাইব কিন্তু গণতান্ত্রিক হতে চাইব না, তা হতে পারে না। সরকার কোনো অজুহাতেই সংবিধানে প্রদত্ত নাগরিকের মৌলিক অধিকার খর্ব করতে পারে না। সংসদে যত সংখ্যাগরিষ্ঠতাই সরকারি দলের থাকুক না কেন।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: মিডিয়া ও উন্নয়নকর্মী।