সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ক্রমশই বাড়ছে বিসিএস পরীক্ষায় আবেদনকারীর সংখ্যা
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ক্রমশই বাড়ছে বিসিএস পরীক্ষায় আবেদনকারীর সংখ্যা

এত বিসিএস পরীক্ষার্থী লইয়া দেশ কী করিবে!

সম্প্রতি বগুড়ার একটি বিসিএস কোচিং সেন্টারের ভিডিও ফেসবুকে ভাইরাল হয়। ভিডিওতে দেখা যায়, শতাধিক শিক্ষার্থী একটি কক্ষে গাদাগাদি করে বসে বিসিএস পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতিমূলক ক্লাস করছে। পাঠের বিষয়বস্তু সাবজেক্ট-ভার্ব-অ্যাগ্রিমেন্ট, যা সাধারণত স্কুল জীবনেই শিক্ষার্থীরা সমাপ্ত করে। আমার অভিজ্ঞতায় এত জনাকীর্ণ একটি কক্ষে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর সম্মিলিত গভীর মনোযোগ এর আগে লক্ষ করিনি। পাঠদান কৌশলটি যে আনন্দদায়ক ছিল, সেটিও বলার কোনো সুযোগ নেই। তাই শিক্ষার্থীদের একাগ্রতার পেছনের কারণটি যে বিসিএস চাকরি নামের সোনার হরিণের দেখা পাওয়া, সেটি বুঝতে দেরি হয়নি।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ক্রমশই বাড়ছে বিসিএস পরীক্ষায় আবেদনকারীর সংখ্যা। বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি) সূত্রে জানা গেছে, এ বছর ৪৪তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় মোট ১ হাজার ৭১০টি শূন্য আসনের বিপরীতে ৩ লাখ ৫০ হাজার ৭১৬ পরীক্ষার্থী আবেদন করেছেন। তাঁদের মধ্যে প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে লিখিত পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন ১৫ হাজার ৭০৮ জন। ওয়ার্ল্ডোমিটারসের তথ্য অনুযায়ী, তীব্র প্রতিযোগিতামূলক এই নিয়োগ পরীক্ষায় এবারের মোট আবেদনকারীর সংখ্যা বিশ্বের ৫৪টি দেশ ও দ্বীপের মোট জনসংখ্যার চেয়ে বেশি। ৪৩তম বিসিএসে ৪ লাখ ৩৫ হাজার ১৯০টি আবেদনপত্র জমা পড়েছিল, যা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। শুনেছি ব্রুনেই, বাহামা, আইসল্যান্ড, বার্বাডোজ, সেন্ট লুসিয়া, গ্রেনাডাসহ কয়েকটি দেশের জনসংখ্যাও এত নয়, যত পরীক্ষার্থী ৪৩তম বিসিএসে আবেদন করেছিলেন। তবে পিএসসি সূত্রে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি আবেদনপত্র জমা পড়েছিল ৪১তম বিসিএসে। সেই বিসিএসে ৪ লাখ ৭৫ হাজারের বেশি প্রার্থী আবেদন করেছিলেন এবং একটি আসনের বিপরীতে ২২০ জন পরীক্ষার্থী অংশ নিয়েছিলেন।

বিসিএস চাকরিনির্ভর চিন্তাভাবনায় নিজেকে আটকে ফেলা তরুণ প্রজন্মের এই মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে না পারলে স্বপ্নহীন ও মেধাবিহীন একটি জাতিই হবে আমাদের ভবিষ্যৎ। এই মানসিকতা কিন্তু এক দিনে সৃষ্টি হয়নি। প্রশ্ন হলো, কেন ব্যক্তি উদ্যোগে ও বেসরকারি খাতে নিয়োজিত সফল পেশাদারদের রোল মডেল হিসেবে তরুণ প্রজন্মের সামনে চিত্রায়িত করতে ব্যর্থ হচ্ছে রাষ্ট্র?

কিছুদিন আগে একটি বিতর্ক প্রতিযোগিতার বিচারকাজ করতে গিয়ে দেখা হয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের একজন মেধাবী শিক্ষার্থীর সঙ্গে। আলাপের একপর্যায়ে জানতে চাইলাম, তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী? ছেলেটি উত্তর, ‘হয় বিসিএস চাকরি করব, নয় তো দেশ ছাড়ব।’ ছেলেটির চোখেমুখে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা দেখে আর কোনো প্রশ্ন করলাম না আমি। মনে পড়ে গেল, চাকরিজীবনে দেখা পাওয়া আরেকজন তরুণের কথা, যিনি যুক্ত ছিলেন দেশের প্রথম সারির একটি উন্নয়ন সংস্থায়। বেশ ভালো করছিলেন তাঁর পেশাগত জীবনে। কিন্তু তাঁর স্বপ্ন—সরকারি কর্মকর্তা হবেন। স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যে তিনি তাঁর সম্ভাবনাময় উজ্জ্বল কর্মজীবনের ইতি টেনেছিলেন বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে। কারণ, সেটিই ছিল পরীক্ষায় আবেদনের বয়সসীমা পেরিয়ে যাওয়ার আগে তাঁর শেষ বিসিএস। নন–ক্যাডার হিসেবে তিনি এখন সরকারি চাকরি করছেন।

বিসিএস চাকরির সিনড্রোমে আক্রান্ত এক তরুণ প্রজন্ম নিয়ে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। গড়ে ২০০ পরীক্ষার্থীর মধ্যে ১৯৯ তরুণ স্বপ্নভঙ্গের বেদনা নিয়ে এখানে প্রতিবছর কর্মবাজারে হাজির হচ্ছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি অংশ বছরের পর বছর ধরে এই সোনার হরিণের পেছনে ছুটতে ছুটতে অবশেষে একবুক হতাশা নিয়ে বিকল্প পথের সন্ধান করছেন। শুধু বিসিএসের স্বপ্নজালে হারিয়ে যাচ্ছে তাঁদেরও যৌবনের উৎকৃষ্ট সময়। কবি হেলাল হাফিজ লিখেছিলেন, ‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়/এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।’ এখন আমাদের তরুণদের কাছে হয়তো সেই যুদ্ধের নাম বিসিএস–যুদ্ধ। প্রতিবছর সেই যুদ্ধে অংশ নেওয়া মিছিল কেবলই দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে।

আমার পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম সম্প্রতি এক বক্তৃতায় সরকারি চাকরির প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের অতিমাত্রায় ঝুঁকে পড়ার কড়া সমালোচনা করে বলেছেন, ‘আমরা পড়াশোনা বাদ দিয়ে এখন বিসিএস চর্চায় আছি।’ আক্ষেপের সঙ্গে তিনি বলেন, ‘বিসিএস বিশ্ববিদ্যালয় নামের একটি বিশ্ববিদ্যালয় খোলা হোক। সেখানে “প্রিলিমিনারি পরীক্ষা”, “ভাইভা” ইত্যাদি নামে বিভাগ থাকবে।’ এ প্রস্তাবের পেছনে তাঁর হতাশার জায়গাটি বুঝতে অসুবিধা হয় না মোটেই। তবে বগুড়ার সাম্প্রতিক বিসিএস কোচিং সেন্টারের ভিডিও দেখার পর আমার মনে হয়েছে, এই বিশাল বিসিএস–প্রত্যাশী তরুণ প্রজন্মের জন্য কেবল একটি ‘বিসিএস বিশ্ববিদ্যালয়’ পর্যাপ্ত হবে না। প্রতিটি বিভাগীয় শহরেই এ ধরনের বিসিএস বিশ্ববিদ্যালয় চালু করা প্রয়োজন।

বিসিএস নিয়ে স্বপ্নবিলাসী একটি প্রজন্মই কিন্তু এখনকার বাস্তবতা। বিসিএস স্বপ্নের এই বীজ তরুণ প্রজন্মের মনে অঙ্কুরিত হয়ে শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে তাঁদের আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। বিসিএস চাকরির বিকল্প হিসেবে আর কিছুই ভাবতে পারছেন না তাঁরা। আর ভাববেনই–বা কীভাবে? চোখের সামনে আমলাদের আকাশছোঁয়া ক্ষমতার চোখধাঁধানো উৎসব তরুণ মনকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। সরকারি আর বেসরকারি চাকরির বৈষম্য দিন দিন প্রকটতর হচ্ছে। আমলাতান্ত্রিকতা, যোগ্য-অযোগ্য–নির্বিশেষে সর্বত্র মুকুটের আসনে সরকারি পদধারীদের অবস্থান, ক্ষমতার বলে সৃষ্ট উচ্চ সামাজিক অবস্থান ও মর্যাদা কিংবা এ ধরনের অভিজ্ঞতাগুলো বেসরকারি চাকরিতে আগ্রহীদেরও দিন দিন হতাশাগ্রস্ত করে ফেলছে। ফলে স্পষ্টত দুটি পথের সৃষ্টি হচ্ছে—একটি সরকারি চাকরির পথ, আর অন্যটি হলো দেশের বাইরে ভবিষ্যৎ গড়ার পথ। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ) তরুণদের নিয়ে যে জরিপ প্রকাশ করে, তাতে দেখা যায়, ভালো জীবনযাপন ও পেশার উন্নতির জন্য বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার ৮২ শতাংশ তরুণ নিজের দেশ ছেড়ে চলে যেতে চান। প্রথম আলোর উদ্যোগে ওআরজি-কোয়েস্ট সারা বাংলাদেশে তরুণদের ওপর যে জরিপ পরিচালনা করেছে, তাতেও দেখা যায়, বাংলাদেশের ৮২ শতাংশ তরুণই উদ্বিগ্ন তাঁদের ভবিষ্যৎ নিয়ে।

বিসিএস চাকরিনির্ভর চিন্তাভাবনায় নিজেকে আটকে ফেলা তরুণ প্রজন্মের এই মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে না পারলে স্বপ্নহীন ও মেধাবিহীন একটি জাতিই হবে আমাদের ভবিষ্যৎ। এই মানসিকতা কিন্তু এক দিনে সৃষ্টি হয়নি। প্রশ্ন হলো, কেন ব্যক্তি উদ্যোগে ও বেসরকারি খাতে নিয়োজিত সফল পেশাদারদের রোল মডেল হিসেবে তরুণ প্রজন্মের সামনে চিত্রায়িত করতে ব্যর্থ হচ্ছে রাষ্ট্র? কেন বেসরকারি খাতের অর্জন যথার্থ স্বীকৃতি ও সম্মান পাচ্ছে না? সরকারি যন্ত্রে থাকা ক্ষমতাসীনরা কী কৌশলে দিন দিন আরও ক্ষমতায়িত হচ্ছেন? কেন আমলারা জনগণের ধরাছোঁয়ার বাইরে যেন দূর আকাশের তারা? কেন শুধুই প্রশাসকে ভরে যাচ্ছে দেশ?

এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জানা আজ খুব প্রয়োজন। কারণ, এসব প্রশ্নের উত্তরের মধ্যেই লুকিয়ে আছে একটি প্রজন্মের বিসিএস চাকরিপ্রাপ্তির উন্মাদনার ইতিহাস।

নিশাত সুলতানা লেখক ও উন্নয়নকর্মী