উচ্চমাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষার সদ্য প্রকাশিত ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, কোনো শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়নি। এটা চলমান কোভিড-১৯ মহামারির এক অনিবার্য পরিণতি। মাধ্যমিক পর্যায়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ সব শিক্ষার্থীই উচ্চমাধ্যমিকেও উত্তীর্ণ হয়েছে। এ বছর তাদের মোট সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৩ লাখ ৬৭ হাজার, গত বছরের চেয়ে ৩ লাখ ৭৯ হাজার বেশি।
এবার জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ লাখ ৬১ হাজার শিক্ষার্থী—গত বছরের তুলনায় তিন গুণের বেশি। স্বাভাবিকভাবেই এসব শিক্ষার্থী ও তাদের স্বজনদের মনে এমন আশা জেগে থাকবে যে তারা বুয়েট, মেডিকেল কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো বিষয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাবে। এবারের ফলাফলের এটাই সবচেয়ে বড় সমস্যার দিক। কারণ, তাদের ভর্তি পরীক্ষা হবে প্রচণ্ড প্রতিযোগিতাপূর্ণ এবং প্রাণান্তকর প্রতিযোগিতার শেষে তাদের একটা অংশকে হতাশ হতে হবে। কারণ, তাদের সংখ্যা যত, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ততগুলো আসন নেই।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের হিসাবে সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট আসন আছে প্রায় ৬০ হাজার। আর সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজগুলোর মোট আসনসংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। এই মোট প্রায় ৭০ হাজার আসনের জন্য ভর্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হবে জিপিএ-৫ পাওয়া ১ লাখ ৬১ হাজার শিক্ষার্থী। জিপিএ-৪ থেকে জিপিএ-৫ পর্যন্ত স্কোর পেয়েছে এমন প্রায় ৫ লাখ শিক্ষার্থীও অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবে। অর্থাৎ, এবারের ভর্তিযুদ্ধের প্রতিযোগিতা হবে নজিরবিহীন; কিন্তু নিজেদের পছন্দমতো বিষয়ে পড়ার সুযোগ পাবে গত বছরের মতোই নির্ধারিত সংখ্যক শিক্ষার্থী।
লাখ লাখ শিক্ষার্থী আরও পড়তে চাইবে কিন্তু সবাই সুযোগ পাবে না—এটা নিশ্চয়ই দুঃখের বিষয়। আবার, যারা সুযোগ পাবে, তাদের বড় অংশকেও শিক্ষাজীবনের শেষে দুঃখ পেতে হবে, যখন তারা স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রির সনদ নিয়ে বেরিয়ে দেখবে চাকরি নেই। চাকরির সন্ধানে ঘুরতে ঘুরতে তারা নিজেদের নতুন পরিচয় আবিষ্কার করবে, ‘উচ্চশিক্ষিত বেকার’।
২০১৭ সালের শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীদের মধ্যে বেকারত্বের হার সবচেয়ে বেশি—১০ দশমিক ৭ শতাংশ। অর্থাৎ, এই দেশে যে ব্যক্তি যত বড় ডিগ্রির অধিকারী, তার বেকার থাকার আশঙ্কা তত বেশি। তারাই সবচেয়ে বেশি দুর্ভাগা, কারণ তাদের শিক্ষাজীবন সবচেয়ে দীর্ঘ, তাদের স্বপ্ন সবচেয়ে বড়, তাদের কাছে মা-বাবার প্রত্যাশা সবচেয়ে বেশি।
এই দুঃখজনক বাস্তবতায় ১৩ লাখ ৬৭ হাজার তরুণ-তরুণীর জীবনে যে নতুন পর্যায়ের সূচনা ঘটতে চলেছে, সেখানে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সম্ভাবনার উল্টো পিঠেই রয়েছে হতাশাময় পরিণতির ঝুঁকি। যথেষ্ট মেধাবী ও পরিশ্রমী হওয়া সত্ত্বেও অনেক শিক্ষার্থী নিজের পছন্দের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পছন্দের বিষয়ে ভর্তি হতে পারবে না; নিজেদের সীমাবদ্ধতার কারণে নয়, জাতীয় সাধ্যের সীমাবদ্ধতার কারণে।
এই লেখার শিরোনামে প্রশ্ন রাখা হয়েছে, এত ছাত্রছাত্রী ভর্তি হবে কোথায়। মোট আসনসংখ্যার চেয়ে ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থীর সংখ্যা এত বেশি, তখন প্রশ্নটার উত্তর সোজা: এই বিপুল সংখ্যার ক্ষুদ্রতম অংশটি নিজেদের পছন্দের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পছন্দের বিষয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাবে; একটি বড় অংশ ভর্তি হবে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে সাধারণ অনেক বিষয়ে, নিতান্তই বাধ্য হয়ে (পছন্দের বিষয় না পেয়ে); আর একটি অংশের শিক্ষাজীবনের পরিসমাপ্তি ঘটবে। যদিও জাতীয়ভাবে আমরা চাই, উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়েই যেন ছেলেমেয়েরা শিক্ষাজীবন থেকে ঝরে না পড়ে, তবু বাস্তবে তা নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে এ পর্যন্ত অর্জিত শিক্ষা কোনো কাজে লাগবে না। বরং এ পর্যায়েই দক্ষ ও প্রয়োজনীয় শ্রমশক্তি গড়ে তোলার একটা বড় সুযোগ সৃষ্টি হয়, যদি আমরা কারিগরি ও জীবিকামুখী প্রায়োগিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের প্রতি আরও বেশি গুরুত্ব দিই।
এটা গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে পৃথিবীতে যখন চতুর্থ শিল্পবিপ্লব শুরু হয়ে গেছে, তখন আমাদের দেশে এই নতুন যুগের উপযোগী দক্ষ শ্রমশক্তি গড়ে তোলার উদ্যোগ যথেষ্ট শক্তিশালী নয়। আমাদের অভিবাসী শ্রমিকদের সিংহভাগ অদক্ষ, তাদের আয় কম, কাজের সুযোগও দিন দিন কমে যাচ্ছে, তাদের কাজের জায়গাগুলো চলে যাচ্ছে ভারত, শ্রীলঙ্কা প্রভৃতি দেশের দক্ষ অভিবাসী শ্রমিকদের দখলে। দেশগুলো এই লক্ষ্যেই দক্ষ শ্রমশক্তি বাড়ানোর উদ্যোগ জোরালো করেছে।
অন্যদিকে আমাদের দেশের শ্রমবাজারের কোন খাতে কত উচ্চশিক্ষিত জনবল প্রয়োজন, তা নিরূপণ না করেই অনেক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে খোলা হয়েছে এবং আরও খোলা হচ্ছে। উচ্চশিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত না করেই এখনো বছরে বছরে বেসরকারি খাতে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে এবং হচ্ছে। এগুলো অপরিণামদর্শী পদক্ষেপ। এভাবে আমরা একুশ শতকের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে পারব না। আমাদের ১৫ থেকে ৩৫ বছর বয়সী জনগোষ্ঠী, যাদের শ্রমশক্তির সর্বাধিক উৎপাদনক্ষম অংশ বলা হয়, তাদের বৃহত্তর অংশটির শ্রমের সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য কারিগরি ও পেশামুখী শিক্ষা প্রসারের ওপর বিশেষভাবে গুরুত্ব দিতে হবে।
আমরা শুনতে পাই, সরকারের সে রকম পরিকল্পনা আছে। এমন কথাও বলা হয় যে নতুন প্রজন্মকে আধুনিক কারিগরি প্রযুক্তিতে দক্ষ করে তুলতে না পারলে তারাই দেশের জন্য বোঝা হয়ে উঠবে। সে জন্য কারিগরি শিক্ষাকে শিক্ষার মূলধারায় পরিণত করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। বছর দুয়েক আগের হিসাব অনুযায়ী, দেশের মোট শিক্ষার্থীর ১৪ শতাংশের বেশি এখন কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায়। ২০৩০ সালের মধ্যে ৩০ শতাংশকে কারিগরি শিক্ষার আওতায় আনার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
এ রকম প্রয়োজনীয় ও যুগোপযোগী পরিকল্পনার বিপরীতেই দেখা যাচ্ছে, সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয় খোলার প্রবণতা বাড়ছে। উপরন্তু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালিত প্রায় ৭০০ সরকারি-বেসরকারি কলেজে অনার্স-মাস্টার্স খোলা হয়েছে। এসব কলেজে অনার্স-মাস্টার্সের আসনসংখ্যা বাড়ানো হয়েছে অপরিকল্পিতভাবে। কোনো কোনো বড় সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীর সংখ্যা এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর সংখ্যার চেয়েও বেশি হয়ে গেছে।
একদিকে এ অবস্থা অব্যাহত থাকবে, অন্যদিকে কারিগরি শিক্ষাকে মূলধারায় পরিণত করা হবে, এটা কীভাবে সম্ভব?
আর, ‘মাস্টার্স ডিগ্রি পেতেই হবে, বিষয় একটা হলেই হলো’—এ রকম মানসিকতা নিয়ে হাজার হাজার তরুণ-তরুণী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণরুমে ছয়-সাত বছর মানবেতর জীবন পার করে একটা সনদ নিয়ে বেরিয়ে ‘উচ্চশিক্ষিত বেকার’ নামক দুর্ভাগাদের তালিকায় যুক্ত হবে—এই অবস্থা চলবে আরও কত দিন?
মশিউল আলম: প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক
mashiul.alam@gmail.com