বাংলাদেশের কর সংগ্রহের প্রক্রিয়া কাঠামোগতভাবে অন্যায্য ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে আছে, এখানে বেশি আয় করলে বেশি কর দেওয়ার বাধ্যবাধকতা কম।
বাংলাদেশের কর সংগ্রহের প্রক্রিয়া কাঠামোগতভাবে অন্যায্য ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে আছে, এখানে বেশি আয় করলে বেশি কর দেওয়ার বাধ্যবাধকতা কম।

এত কম কর–জিডিপি অনুপাতের আসল রহস্য কী

অর্থ মন্ত্রণালয়ের মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতিতে ২০১৬-২০ পাঁচ বছরের কর-জিডিপির অনুপাত গড়ে ৯ দশমিক ৯০ শতাংশ দেখানো হয়। পূর্বের হিসাবে যা ১০ দশমিক ২ শতাংশ ছিল। এই হার সার্ক দেশগুলোর মধ্যে তলানিতে, নেপালের অর্ধেকের চেয়ে কম। এমনকি যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানের কর-জিডিপি অনুপাতও বাংলাদেশের চেয়ে ভালো।

ক্রমাগত কমতে থাকা কর-জিডিপি অনুপাত দেশে একটি প্রধানতম আলোচ্য বিষয়। যেটি আলোচিত নয়, তা হচ্ছে, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, প্রশাসনিক জবাবদিহি এবং চাঁদাবাজির প্রশ্ন। বেতনের উৎসে কর সংগ্রহ ব্যবস্থার সংস্কারে আমাদের সাফল্য আছে। কিন্তু এডিবির ঋণে রাজস্ব বিভাগের আধুনিকায়ন প্রকল্পের ত্রুটি ও দুর্নীতি, করদাতা তথ্যশালা অযোগ্য বিদেশি কোম্পানির হস্তগত হওয়া এবং পেমেন্ট সিস্টেমে জোর না দিয়ে ভ্যাট সংগ্রহে খরচে ইএফডি মেশিন কেনার অদূরদর্শী প্রকল্পগুলোর বিষয় আলোচিত নয়। চাঁদাবাজির কারণে ব্যবসায়ীদের আয়কর না দিতে চাওয়ার গুরুতর প্রশ্নও অনালোচিত।

বাংলাদেশে কর সংগ্রহের অতি নিম্নহার আমাদের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক দুর্বৃত্তায়নের প্রত্যক্ষ সংযোগ আছে। মূলত সরকারের বা ক্ষমতার বা প্রশাসনের জানার মধ্যে থেকেই রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা কর ফাঁকি দেন। ক্ষমতাসীন কিংবা প্রভাবশালীদের কাছে কর পরিদর্শকেরা অসহায়। বাংলাদেশে ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি নিজ নিজ ব্যবসাসহ অপরাপর লাভজনক পদে থেকেই চেয়ারম্যান-মেয়র-এমপি-মন্ত্রী হতে পারেন বলে আয়কর প্রদানের প্রক্রিয়াকে থোড়াই কেয়ার করেন। পাশাপাশি রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক প্রভাবশালীদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদ কিংবা ট্রাস্টিতে রাখা হয় বলে কর সংগ্রহে ‘স্বার্থের দ্বন্দ্ব’ তৈরি হয়। সহজ কথা, প্রভাবশালীদের প্রতিষ্ঠানের পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত করে বাংলাদেশের বেসরকারি খাত আয়কর ফাঁকি চালিয়ে যায় বছরের পর বছর। নামীদামি কোম্পানি থেকে শুরু করে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান—কেউই এই অপচর্চার বাইরে নয়।

আরেকটি সমস্যা এনজিও মডেলের পরিচালনা ব্যয়। কোম্পানির লভ্যাংশকে বেতন, ভাতা, উন্নয়ন, বিনোদন, প্রশিক্ষণ, যাতায়াত, সামাজিক ব্যয়সহ বিভিন্ন পরিচালনা খাতে পুরোপুরি ব্যয়িত দেখিয়ে উল্টো কোম্পানিকে ঋণগ্রস্ত দেখিয়ে শতভাগ আয়কর ফাঁকির জালিয়াতি বাংলাদেশে খুব প্রচলিত। এখানে ক্ষমতাবান হলে আয়কর না দিয়েই থাকা যায়। বিশেষ ক্ষমতাবানদের অঞ্চলে এমনকি আয়কর কর্মকর্তাদের পরিদর্শনে যাওয়াও ঝুঁকিপূর্ণ, দৈহিক নিরাপত্তা এবং চাকরি উভয়ই হুমকিতে পড়ে। ক্ষমতাবানদের বিরক্ত করার ফলে বাজে বদলি এবং প্রমোশন বন্ধের ঘটনাও আছে।

বাংলাদেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা যে আয়কর দিতে চান না,​ তার একটা যুক্তিও কিন্তু আছে। তাঁরা ব্যাপক হারে এবং বহু স্তরে রাজনৈতিক, প্রশাসনিক এবং পুলিশি চাঁদা দিতে বাধ্য। এই চাঁদার টাকা কর হিসেবে সরকারের রাজস্ব খাতে যাওয়ার কথা ছিল। চাঁদাবাজি হচ্ছে দেশের সবচেয়ে বড় পরোক্ষ কর। ব্যবসায়ী, দোকানি, রাস্তার গাড়ি, মালবাহী পণ্যের ট্রাক এমনকি হকার সবাই বাধ্য হয়ে যে চাঁদা দেয়, এটা আসলে কর। প্রতিটা ক্ষেত্রেই চাঁদার বিনিময়ে ক্ষমতাসীনের অধীনে ব্যবসা করা লাগে। ফলে যে লোক চাঁদার পাশাপাশি কর দেবে, সে আসলে দ্বৈত করারোপে পড়ে যায়।

বৃহৎ ও মাঝারি ব্যবসা থেকে প্রাপ্ত প্রত্যক্ষ আয়কর কম হলেও সরকার কৌশলে কর উঠিয়ে নেয়। পরোক্ষভাবে ভ্যাট শুল্ক থেকে, যা পরোক্ষ কর। চাল-ডাল-সবজির মতো কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য ছাড়া সবকিছুতেই ভ্যাট দিতে হয়। উপরন্তু সরকার নিম্ন ব্যাংক স্থিতি থেকে আবগারি শুল্ক কাটে। বাণিজ্যিক ব্যাংকে অনেক লুকায়িত খরচ থাকে। মাত্র এক লাখের বেশি টাকা ব্যাংকে থাকলেই সরকার তা থেকে বছর শেষে কর কাটে, যেটা বিশ্বে বিরল। নেদারল্যান্ডসে ব্যক্তি হিসেবে ২৫ লাখ এবং যৌথ হিসেবে ৫০ লাখের বেশি থাকলে বছর শেষে ব্যাংক স্থিতিতে এক থেকে সোয়া এক শতাংশ কর কাটা হয়। দুই অঙ্কের অতি উচ্চ মূল্যস্ফীতির দেশে করমুক্ত আয়ের সীমা মাত্র তিন লাখ টাকা। অথচ ভারতেও বহু আগে থেকেই এটা পাঁচ লাখ রুপি। ২০২২ সালে যখন দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতিতে মানুষ দিশেহারা, ঠিক তখনই বর্ধিত আন্তর্জাতিক বাজার মূল্যের ওপর সরকার আমদানি পর্যায়ে শুল্ক-কর আদায় বাড়িয়ে বেশি আয় করেছে।

তবে প্রতিটি অর্থনীতিকে একই পাল্লায় মাপার মধ্যে ভ্রান্তিও থাকতে পারে। প্রত্যক্ষ আয়কর কম হলেও বাংলাদেশের শুল্ক এবং ভ্যাটের হার এই অঞ্চলে প্রায় সর্বোচ্চ। সেখানেও দুর্বৃত্তায়ন এবং সংগ্রহ পদ্ধতির সমস্যা প্রকট। বাংলাদেশের এমনকি গরিবদেরও সবাই ভ্যাট দেয়। কিন্তু সরকার ও প্রশাসনের লোকদের সহযোগিতায় ব্যবসায়ী ও ধনীরা সেই ভ্যাট চুরি করে। অর্থাৎ উৎস থেকেই প্রদত্ত ভ্যাটের প্রকৃত পরিমাণ জানতে পেমেন্ট সিস্টেম ডেভেলপ করেনি সরকার। প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার যোগসাজশে ঘুষ লেনদেনে সংগ্রহকৃত ভ্যাটের উল্লেখযোগ্য অংশই মেরে দেওয়া যায়। নেই লেনদেনকে অধিক হারে ক্যাশলেস করার দেশীয় উদ্যোগ। ঘুষ লেনদেন শেষে গড়পড়তা পরিমাণ সরকারি রাজস্বে জমা পড়ে। যেখানে পেমেন্ট সিস্টেম ঠিক করে ট্রানজেকশন সোর্স থেকেই ভ্যাট সংগ্রহ করার কথা, সেখানে সরকার দুর্নীতি জিইয়ে রাখতে ইএফডি মেশিন কেনায় শত কোটি ব্যয় করেছে এবং এটা করার পরও ভ্যাট বাড়েনি। বিশ্বে যে ধারা চলছে, তার উল্টো ধারায় গিয়ে, ঘুষের ব্যবস্থা জারি রাখার যে পথে সরকার হেঁটেছে, তাতে মূসক খুব বাড়বে না। বরং সৎ ব্যবসায়ীদের ওপর জোরাজুরির কারণে কর্মসংস্থান কমছে, তাঁরা প্রতিযোগিতায় না টিকে ব্যবসা ছেড়ে দিচ্ছেন।

বাংলাদেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা যে আয়কর দিতে চান না,​ তার একটা যুক্তিও কিন্তু আছে। তাঁরা ব্যাপক হারে এবং বহু স্তরে রাজনৈতিক, প্রশাসনিক এবং পুলিশি চাঁদা দিতে বাধ্য। এই চাঁদার টাকা কর হিসেবে সরকারের রাজস্ব খাতে যাওয়ার কথা ছিল। চাঁদাবাজি হচ্ছে দেশের সবচেয়ে বড় পরোক্ষ কর। ব্যবসায়ী, দোকানি, রাস্তার গাড়ি, মালবাহী পণ্যের ট্রাক এমনকি হকার সবাই বাধ্য হয়ে যে চাঁদা দেয়, এটা আসলে কর। প্রতিটা ক্ষেত্রেই চাঁদার বিনিময়ে ক্ষমতাসীনের অধীনে ব্যবসা করা লাগে। ফলে যে লোক চাঁদার পাশাপাশি কর দেবে, সে আসলে দ্বৈত করারোপে পড়ে যায়। চাঁদাবাজির জন্য আমাদের দ্রব্যমূল্য এবং পণ্য তৈরির খরচ বেশি, অভ্যন্তরীণ উৎপাদন চীন-ভারতের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে না। শুধু চাঁদাবাজি বন্ধ হলেই দ্বৈত কর হয়ে রাজস্ব আদায় তরতর করে বাড়তে পারে।

বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত যেমন ১০ শতাংশ তেমনি আনুষ্ঠানিক অর্থনীতিও মাত্র ১১ শতাংশ। ফলে কর-জিডিপি অনুপাত আসলে অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতির আকারের সঙ্গে ধারাবাহিক। কর-জিডিপি অনুপাত বাড়াতে হলে দেশের আনুষ্ঠানিক খাত বড় করতে হবে। মাসিক ছুটি, স্বাস্থ্য ভাতা, প্রভিডেন্ট ফান্ড, পেনশন ইত্যাদি স্থায়ী কিংবা অস্থায়ী চুক্তিপত্রসহ নিয়োগ দিলে, যখন-তখন ছাঁটাইয়ের অমানবিক প্রথা বন্ধ হলে কর্ম সুরক্ষার ধারণা বাড়বে, তখন কর প্রদানও বাড়বে। নিম্ন বেতনের চাকরিটাই যেখানে প্রতিদিন ঝুঁকিতে থাকে, সেখানে মানুষ কর দেবে কীভাবে? সরকার অভিযোগ করে আয়কর রিটার্ন বাড়ছে না। উত্তর হচ্ছে, প্রাতিষ্ঠানিক খাতে চাকরিই বাড়ছে না। বাংলাদেশের সরকার মোট শ্রমশক্তির মাত্র ৩ দশমিক ৪ শতাংশকে নিয়োগ দেয়, যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো মধ্যেই সর্বনিম্ন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে দেশের সরকারি-বেসরকারি মোট বৈদেশিক ঋণ ৯০ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন ডলার হলেও বলা হচ্ছে আমাদের ঋণ-জিডিপি অনুপাত নগণ্য। কম দেখানো দুটি অনুপাতের একটিতে ব্যাপক সন্তোষ, কিন্তু আরেকটিতে চরম অসন্তোষের অর্থ হচ্ছে তাদের মধ্যকার কমন বিষয়টির গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। অর্থাৎ জিডিপির তথ্যই ভ্রান্তির উৎস হতে পারে। সব মিলে আনুষ্ঠানিক খাত সম্প্রসারণ, ধনীদের বেশি হারে করসীমায় আনা, উৎসে কর-ভ্যাট-শুল্ক সংগ্রহের স্বচ্ছ ও দুর্নীতিমুক্ত অবকাঠামো তৈরির পাশাপাশি তথ্য জালিয়াতির মধ্যেই নিম্ন কর-জিডিপি অনুপাতের রহস্য খুঁজতে হবে।

আইএলওর তথ্যমতে বাংলাদেশের বিভিন্ন অদক্ষ ও স্বল্প দক্ষ শ্রম খাতে মাসিক বেতন গড়ে মাত্র ৪৮ ডলার। তৈরি পোশাকশ্রমিকেরা সর্বোচ্চ ১০০ ডলার মজুরি পান,যা দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন। এত কম আয় নিয়ে মানুষ কর দেবে কীভাবে? প্রশ্ন হচ্ছে, সরকার কি মানসম্পন্ন কর্মসংস্থান তৈরির কোনো সুস্পষ্ট পরিকল্পনা করেছে? যাতে সব চাকরিই প্রত্যক্ষ কর তৈরি করবে এবং সব চাকরির বিপরীতে আয়কর রিটার্ন আসবে! দেশের মোট কর্মসংস্থানের বা মোট শ্রমবাজারের ৮৯ শতাংশ যেখানে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে, সেখানে আপনি উচ্চহারে কর প্রাপ্তির আশা করেন কীভাবে? এটাও স্বাভাবিক যে পেমেন্ট ব্যবস্থার বোধগম্য ডিজিটালাইজেশন না করলে, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন না কমলে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের ধনী মালিক-ব্যবসায়ীদের কর সঠিক হিসাবে আসবে না।

মূল গুরুত্বটা দেওয়া উচিত উচ্চ আয়কারী, অভিজাত শ্রেণি, উচ্চবিত্ত, মধ্য ও বৃহৎ ব্যবসায়ী, শিল্পপতি এবং বিশেষভাবে প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক নেতাদের আয়কর ফাঁকি বন্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। ধনিক ও বণিক শ্রেণি থেকে প্রাপ্ত প্রত্যক্ষ কর কম হওয়ায় সরকার অন্যায়ভাবে পরোক্ষ কর ও ভ্যাট বাড়িয়ে সাধারণ মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত ও প্রান্তিক অর্থনৈতিক শ্রেণির ওপর ভ্যাট-শুল্কের পরোক্ষ করের ভারী বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছে ক্রমাগত। বাংলাদেশের কর সংগ্রহের প্রক্রিয়া কাঠামোগতভাবে অন্যায্য ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে আছে, এখানে বেশি আয় করলে বেশি কর দেওয়ার বাধ্যবাধকতা কম। কর সংগ্রহের প্রক্রিয়ার সঙ্গে অর্থনৈতিক বৈষম্য কমিয়ে আনা এবং সাম্যভিত্তিক সমাজ গড়ার ধারণা ও বিবেকবোধ নেতৃত্বের মধ্যে নেই।

সরকার এমন কোনো উচ্চমান ও হয়রানিমুক্ত নাগরিক সেবা দেয় না যে লোকে লাইন দিয়ে, আয়কর কর্মকর্তাদের ঘুষ দিয়ে আয়কর ও রিটার্ন দিতে যাবে! যে লোক একটা সরকারি সেবা পেতে বহু হয়রানি ও ঘুষের শিকার হন, তিনি কর দিতে স্বপ্রণোদিত হবেন না। মানুষ যে টাকা কর দেয়, তার বিপরীতে প্রদত্ত সেবার মান না বাড়লে বাড়তি কর চাওয়াটাই অবৈধ। করের টাকায় কোটি টাকার পর্দা কিনলে, প্রকল্প ব্যয়ে পুকুর চুরি থেকে সাগর চুরি হলে মানুষের কর দিতে ইচ্ছা করবে না। সরকারের খরচ ও ব্যয়ের মডেল অস্বচ্ছ ও লুটেরা হলে লোকে কর দেবে না। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিত্ব না থাকলে, অর্থাৎ যাঁর ভোটাধিকার নেই, তিনি কর দিতে বাধ্য নন। গণতন্ত্রে একটা বিধিবদ্ধ নিয়ম এমনিতেই আছে যে ‘নো ট্যাক্সেশন উইদাউট রিপ্রেজেন্টেশন’।

কর-জিডিপি অনুপাতের আরেকটা ব্যাখ্যা আছে। যুক্তরাজ্যের সহায়তায় বিএনপি আমলে সূচিত রিফর্মস ইন রেভিনিউ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আরআইআরএ) সংস্কার বাস্তবায়নের পর বাংলাদেশের রাজস্ব আয়ের সক্ষমতা এবং হার বেড়েছে। ২০১০-১১ অর্থবছরে রাজস্ব আদায় ছিল প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু ২০২১-২২ অর্থবছরে রাজস্ব আদায় প্রায় তিন লাখ কোটি টাকার মতো হবে। মাত্র ১০ অর্থবছরে যদি রাজস্ব আদায় প্রায় পৌনে ৪ গুণ বাড়ায় আসলে শুধু নিম্ন কর-জিডিপি অনুপাতকে প্রশ্ন করার সুযোগটা কমে যায়। করোনার পর দেশজ প্রবৃদ্ধির লাফিয়ে বাড়ার সংখ্যাকেই বরং প্রশ্ন করতে হয়।

সরকারের প্রবৃদ্ধির সংখ্যা বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। প্রায় দেড় বছর গড়িমসি করে বিশ্বব্যাংক ও দেশীয় গবেষণা সংস্থাগুলোর আপত্তির মুখে বিবিএস সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে ২০১৯-২০ অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি পূর্বের হিসাব থেকে ১ দশমিক ৭৩ শতাংশ কমিয়েছে। সরকার এরপর অর্থনীতির কোনো সূচকের উন্নতি নয়, নতুন কোনো জরিপ নয়, বরং ভিত্তি বছর পরিবর্তন করেই মাথাপিছু আয় বাড়িয়েছে ৩২৭ ডলার। যে ৯টি নতুন খাত অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলা হয়েছে, সেগুলো আগেই কৃষিশিল্প কিংবা সেবা খাতে অবদান রেখেছে। এ কারণে ভিত্তি বছর পরিবর্তনের সঙ্গে ব্যাপক হারে জিডিপি এবং জাতীয় আয় বাড়ার প্রত্যক্ষ সংযোগ প্রমাণিত হয় না। পরিবর্তনশীল অর্থনীতিতে কিছু খাত বড় হয়, কিছু ছোট হয়। ভিত্তি বছর পরিবর্তনের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, জিডিপির হিসাব সহজ করা, প্রবৃদ্ধি এবং জাতীয় আয় বাড়িয়ে দেখানো নয়।

অর্থনীতিবিদদের মতে, বিবিএস জাতীয় আয়, শ্রম আয়, খানা আয় ইত্যাদির পরিসংখ্যানে মূল্যস্ফীতিকে সঠিকভাবে বিয়োগ করে না, ফলে দেশজ প্রবৃদ্ধি বেশি দেখায়।

০৪ মার্চ ২০২২ নিজস্ব সমীক্ষার তথ্য প্রকাশ করে বিবিএসের মূল্যস্ফীতির তথ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে অর্থনীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেম। সানেম তথ্যপ্রমাণসহ বলেছে, গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের তুলনায় এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে শহরের প্রান্তিক গোষ্ঠীর গড় খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২ দশমিক ৪৭ শতাংশ। সাড়ে ১২ শতাংশ মূল্যস্ফীতিকে মাত্র ৫ দশমিক ২২ শতাংশ দেখানোর বড় ধরনের জালিয়াতি, এর মাধ্যমে জিডিপি তথ্য বর্ধিত। এসব বহু স্তরের তথ্যবিস্ময়ের কারণে কর-জিডিপি অনুপাত কম। আরেকটা প্রমাণ হচ্ছে, বর্ধিত জিডিপির কারণে বাংলাদেশের ঋণ-জিডিপি অনুপাতও কিন্তু কম দেখায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে দেশের সরকারি-বেসরকারি মোট বৈদেশিক ঋণ ৯০ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন ডলার হলেও বলা হচ্ছে আমাদের ঋণ-জিডিপি অনুপাত নগণ্য। কম দেখানো দুটি অনুপাতের একটিতে ব্যাপক সন্তোষ, কিন্তু আরেকটিতে চরম অসন্তোষের অর্থ হচ্ছে তাদের মধ্যকার কমন বিষয়টির গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। অর্থাৎ জিডিপির তথ্যই ভ্রান্তির উৎস হতে পারে। সব মিলে আনুষ্ঠানিক খাত সম্প্রসারণ, ধনীদের বেশি হারে করসীমায় আনা, উৎসে কর-ভ্যাট-শুল্ক সংগ্রহের স্বচ্ছ ও দুর্নীতিমুক্ত অবকাঠামো তৈরির পাশাপাশি তথ্য জালিয়াতির মধ্যেই নিম্ন কর-জিডিপি অনুপাতের রহস্য খুঁজতে হবে।

ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব টেকসই উন্নয়নবিষয়ক লেখক।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও বাংলাদেশ, বাংলাদেশ অর্থনীতির ৫০ বছর, অপ্রতিরোধ্য উন্নয়নয়ের অভাবিত কথামালা, উন্নয়ন প্রশ্নে বাংলাদেশের কিছু সংকট ও সম্ভাবনা বইয়ের লেখক।
faiz.taiyeb@gmail.com