খেলাপি ঋণ

এটা খেলাপি ঋণ স্ফীতি নয়, মহাবিপদ সংকেত

.

জোয়ার-ভাটার খেলায় জোয়ারের সময় নদীতে সামান্য জলস্ফীতি হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের আবর্তে সাগর স্ফীত হয়ে আট-দশ ফুট উচ্চতায় ঢেউ যখন ধ্বংসনৃত্য করতে থাকে, তখন আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে সম্পদহানির আশঙ্কায়। তেমনি ঋণ-ব্যবসা করতে গিয়ে শতকরা এক বা দেড় ভাগ ঋণখেলাপি হলে তা স্বাভাবিক বলেই ধরা হয়। শতকরা ২ ভাগ অতিক্রম করলেই আশঙ্কার জন্ম দেয়। ৫ ভাগ অতিক্রম করলে আশঙ্কা থেকে আতঙ্কে উত্তরণ ঘটে। ১০ ভাগ খেলাপি ঋণের সাদামাটা অর্থ হচ্ছে ঘূর্ণিঝড়ের ‘মহাবিপদ সংকেত ১০’। অবহেলা আর দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হয়ে আমরা ১০ ভাগ অতিক্রম করেছি।
বাংলাদেশে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ এখন ৬০ হাজার কোটি টাকার ওপর। সেই সঙ্গে অবলোপনকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৪০ হাজার কোটি টাকার বেশি। অর্থাৎ মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। জনগণের গচ্ছিত এক লাখ কোটি টাকা ব্যাংকগুলো নষ্ট করে ফেলেছে। মাত্র দুই বছর আগে স্মিত হাসিতে অর্থমন্ত্রী জাতীয় বাজেট লাখো কোটি টাকা অতিক্রমের আনন্দ-ঘোষণা দিয়েছিলেন। আজ সমপরিমাণ অর্থ লোপাটের ঘটনায় কর্তৃপক্ষ বিচলিত নয়। এ কারণেই আমরা বিচলিত বোধ করছি।
এটি দেশের ব্যাংকব্যবস্থার সামগ্রিক চিত্র। সব ব্যাংকের অবস্থা এক রকম নয়। দেশের অর্ধশতাধিক ব্যাংকের প্রতিটিকে নিয়ে পর্যালোচনার সুযোগ এখানে নেই। সমস্যা অনুধাবনের সুবিধার্থে ব্যাংকগুলোকে মোটা দাগে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। রাষ্ট্রমালিকানাধীন খাত ও বেসরকারি খাত। দুই খাতের সমস্যা ভিন্ন, সমাধানও ভিন্ন। তাই পৃথকভাবেই খাত দুটি নিয়ে আলোচনা করা যাক। রাষ্ট্রীয় খাতের মূল সমস্যা দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা। বেসরকারি খাতের মূল সমস্যা হলো আগ্রাসী ব্যাংকিং, ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা, কিছু ব্যাংকে মালিকপক্ষের বাড়াবাড়ি ও দুর্নীতি।
বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের গতিধারা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ১৯৭৮ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত সময়কাল ছিল ব্যাংকব্যবস্থার প্রথম ও সবচেয়ে বড় সংকটকাল। এ সময় কোনো কোনো ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী মোট ঋণের ৫০ শতাংশ অতিক্রম করেছিল। তখন সরকারি ব্যাংকগুলোরই প্রাধান্য ছিল এবং খেলাপি ঋণের হিসাবে তারাই ছিল প্রথম সারিতে। সংকট সামাল দেওয়ার জন্য বিশ্বব্যাংকের সরাসরি উপস্থিতি ও পরিচালনায় ‘ফিন্যান্সিয়াল সেক্টর রিফর্ম প্রজেক্ট (এফএসআরপি)’ নামে পাঁচ বছর মেয়াদি সংস্কার প্রকল্প পরিচালিত হয় এবং ১৯৯৬ সালে ব্যাংকগুলো গ্রহণযোগ্য অবস্থায় ফিরে আসে। সুখ বুঝি কপালে সয় না। ২০০১ সাল থেকে আবার অধঃপতন শুরু হয়। ২০০৭ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত অধোগতি কিছুটা থমকে থাকার পর আবার শুরু হয় চরম বিশৃঙ্খলা। এ সময় সংঘটিত হল-মার্ক, বেসিক ব্যাংকসহ ক্ষমতাবানদের ব্যাংক লুটপাটের ঘটনা বহুল আলোচিত। খেলাপি ঋণ বেড়েই চলেছে। উন্নতির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকের লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না বলে অধুনা অনেকেই এগুলোকে বিরাষ্ট্রীয়করণের সুপারিশ রাখছেন। তাঁদের যুক্তি, সরকার ব্যাংক চালাতে পারে না। আমাদের দেশে সরকারি ব্যাংকগুলোর মার্কেট শেয়ার ৪০ শতাংশের কাছাকাছি নেমে এসেছে। অথচ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে এখনো সরকারি ব্যাংকের মার্কেট শেয়ার ৭৫ শতাংশ। ভারতে কোনো সরকারি ব্যাংক লোকসান দেয় না, বরং বিশাল অঙ্কের মুনাফা সরকারকে প্রদান করে।
বাংলাদেশে এর উল্টোটা ঘটছে। সরকারি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি পূরণের জন্য সরকার বাজেট থেকে জনগণের ট্যাক্সের টাকা নিয়মিতই দিয়ে যাচ্ছে, যা নেহাত অনৈতিক। ভারতে সরকার ব্যাংক ব্যবসায় লাভ করছে। বাংলাদেশ লোকসানে যাচ্ছে। কাজেই সরকার ব্যাংক চালাতে পারে না, কথাটা ঠিক নয়। বাংলাদেশ সরকার কেন পারছে না, সেটাই বিবেচ্য।
বাংলাদেশে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংক খাতে চলছে লাগামহীন দুর্নীতি ও অব্যবস্থা। এর কারণ প্রথমত, সাংঘর্ষিক আইন দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্ব পালনে বাধা সৃষ্টি। দ্বিতীয়ত, ব্যাংকের শীর্ষ পদগুলোয় দুর্নীতিগ্রস্ত অথবা অযোগ্য ব্যক্তির পদায়ন। তৃতীয়ত, অর্থ মন্ত্রণালয়ে ব্যাংকিং বিভাগ সৃষ্টি করে ব্যাংক পরিচালনায় দ্বৈতশাসন তথা প্রুডেনশিয়াল বিধানবহির্ভূত পদচারণ। তিনটি বিষয় আলোচনা করে সম্ভাব্য সমাধান খোঁজার চেষ্টা করা যাক।
রেগুলেটর হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক ‘ব্যাংকিং কোম্পানি আইন’-এর বিধানাবলি প্রয়োগ করে থাকে। কোনো বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালনা আশঙ্কাজনক হলে এ আইনের অধীনে ওই ব্যাংকের চেয়ারম্যান, পরিচালক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালককে অপসারণ করতে পারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এমনকি পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়ে ‘অ্যাডমিনিস্ট্রেটর’ নিয়োগও দিতে পারে। এমন বিধান পৃথিবীর সর্বত্রই রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের ব্যাংকিং কোম্পানি আইনে যোগ করা হয়েছে যে চেয়ারম্যান, পরিচালক বা পর্ষদ সরকার কর্তৃক নিয়োজিত হলে বাংলাদেশ ব্যাংক এ আইন প্রয়োগ করতে পারবে না। এক দেশে দুই আইন। রাষ্ট্রমালিকানাধীন ও বেসরকারি ব্যাংক সর্বাংশে একই কাজ করে এবং একই সেবা প্রদান করে থাকে। তথাপি রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকে ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষমতা কেন্দ্রীয় ব্যাংককে দেওয়া হয়নি। সে অর্থে এটি একটি কালো আইন। এ কারণেই বেসরকারি ব্যাংকের তুলনায় রাষ্ট্রীয় ব্যাংকে খেলাপি ঋণ দ্বিগুণ ও দুর্নীতি অপ্রতিরোধ্য।
এ বিষয়টির আরও একটি কাঠামোগত দিক রয়েছে। রাষ্ট্র পরিচালনায় যেমন আইন বিভাগ, প্রশাসন বিভাগ, বিচার বিভাগ রয়েছে, তেমনি ব্যাংক পরিচালনায় রয়েছে মালিকপক্ষ, ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ও রেগুলেটর বা কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তিন পক্ষেরই সীমা নির্ধারিত রয়েছে আইন ও প্রুডেনশিয়াল বিধানে। সরকারের কাজ রাষ্ট্র পরিচালনা করা, ব্যাংক-ব্যবসা পরিচালনা নয়। তবে সরকার যখন ব্যাংকের মালিকানা গ্রহণ করে, তখন তার পরিচয় মালিক হিসেবে, সরকার হিসেবে নয়। তাই বেসরকারি ব্যাংকের মালিকের যতটুকু ভূমিকা, রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকের মালিক হিসেবে সরকারের ভূমিকা ততটুকু। সরকার হয়তো ভাবছে, তার নিয়োগ দেওয়া চেয়ারম্যানকে যদি কেন্দ্রীয় ব্যাংক অপসারণ করে, তাহলে সরকার ছোট হয়ে যায়। এটি বাস্তব অবস্থা নয়, হীনম্মন্যতা। মালিকের ভূমিকায় সরকারকে অবশ্যই রেগুলেটরের ভূমিকা মেনে নিতে হবে। মালিক ও সরকার দুই সত্তা। বিষয়টি মৌলিক ও গুরুতর।
অতএব ব্যাংকিং কোম্পানি আইনের স্ববিরোধী ধারাটি সংশোধন করে সরকারি ও বেসরকারি সব ব্যাংকের জন্য একই আইন প্রণয়ন করতে হবে। এই মৌলিক আইনি সংস্কার না করা হলে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংক রাহুমুক্ত হবে না। একটি নজির উল্লেখ করার মতো। সরকার নিয়োজিত চেয়ারম্যান, বোর্ড ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক যখন একসময়ের সেরা ব্যাংক বেসিক ব্যাংকের অর্থ লোপাট করে ধ্বংসের শেষ প্রান্তে নিয়ে এসেছেন, তখন রেগুলেটর অসহায়ের মতো শুধু পত্র লিখে যাচ্ছিল অর্থ মন্ত্রণালয়ে। একপর্যায়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ওই ব্যাংকের চেয়ারম্যানকে অপসারণের সুপারিশ করেছিল সরকারের কাছে। সুপারিশ পত্রখানি চেপে রেখে অর্থ মন্ত্রণালয় ওই চেয়ারম্যানকে তাঁর কর্মকাল উত্তীর্ণ হওয়ার এক দিন আগে সসম্মানে পদত্যাগ করার সুযোগ করে দিয়েছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যথাযথ আইনি ক্ষমতা থাকলে এমন অঘটন ঘটত না।
রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের দ্বিতীয় সমস্যা হলো শীর্ষ পদগুলোয় অনেক ক্ষেত্রে দুর্নীতিগ্রস্ত অথবা অযোগ্য ব্যক্তিদের নিয়োগ। কারণ সরকার মালিকের ভূমিকা না নিয়ে ‘সরকারের’ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। স্বল্পোন্নত লাগামছাড়া পুঁজিবাদী অর্থনীতির দেশে রাজনৈতিক সরকারের কাছে দুর্নীতি আর রাজনীতির মধ্যে পার্থক্য থাকে না। হুকুম তামিল করতে পারঙ্গম ব্যক্তিই সরকারের প্রিয়, তা সে যত দুর্নীতিবাজ বা অদক্ষই হোক না কেন। সুপারিশ করা যেতে পারে, চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগের ক্ষেত্রে সরকার (মালিকপক্ষ) গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে একটি ‘স্বাধীন সার্চ কমিটি’ গঠন করতে পারে, যেমনটা করা হয়েছিল ডেপুটি গভর্নর নিয়োগের ক্ষেত্রে।
রাষ্ট্রীয় ব্যাংক পরিচালনায় তৃতীয় সমস্যা হচ্ছে অর্থ মন্ত্রণালয়ে সুপরিসর ‘ব্যাংকিং বিভাগ’ প্রতিষ্ঠা। ব্যাংকের মালিকপক্ষ বা শেয়ারহোল্ডারদের দায়িত্ব হলো ব্যাংকের জন্য একটি পরিচালনা বোর্ড গঠন করে দেওয়া। এরপর শেয়ারহোল্ডারদের আর ক্ষমতা থাকে না। রাষ্ট্রীয় ব্যাংকে শেয়ারহোল্ডার হলো সরকার। এ ক্ষেত্রে সরকারের কাজ হলো একটি উপযুক্ত ‘বোর্ড অব ডিরেক্টর’ গঠন করে সরে পড়া। কিন্তু সরকার বোর্ড গঠন করার পর আবার ব্যাংকিং বিভাগ গঠনের মাধ্যমে খবরদারি করে থাকে। এ কারণেই ‘বোর্ড ডিসকাউন্টেড’ হয়ে পড়ে এবং দ্বৈত শাসনের জন্ম নেয়। ব্যাংকিং বিভাগ ‘সুপার বোর্ড’ হয়ে যায়। ব্যাংকিং বিভাগ স্থাপনের পর রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকের দুর্নীতি বেড়ে গেছে, খেলাপি ঋণের হারও বৃদ্ধি পেয়েছে। জনশ্রুতি রয়েছে যে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ ও পুনর্নিয়োগে ব্যাংকিং বিভাগে অস্বচ্ছতা রয়েছে এবং অস্বচ্ছতার আড়ালে দুর্নীতির অভিযোগও শোনা যায়। সরকারি চাকরিতে তিন বছর পর বদলির বিধান থাকলেও এই বিভাগে উচ্চপদে কর্মরত কেউ কেউ নাকি বদলির বিধানমুক্ত। রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকে সুশাসন কিছুটা হলেও ফিরিয়ে আনতে হলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ‘ব্যাংকিং বিভাগ’ অবলুপ্ত হওয়া প্রয়োজন। আগের মতো অর্থ মন্ত্রণালয়ই সরকারি ব্যাংকের মালিকানার দায়দায়িত্ব পালন করতে পারবে।
বেসরকারি ব্যাংকগুলোর অবস্থা অবশ্য সরকারি ব্যাংকের মতো নাজুক নয়। বেসরকারি ব্যাংকের দুর্বলতা হলো আগ্রাসী ব্যাংকিং করা। বাংলাদেশের মতো সীমিত অর্থনীতির দেশে প্রায় অর্ধশত বেসরকারি ব্যাংকের লাইসেন্স প্রদানের কারণে আগ্রাসী ব্যাংকিংয়ের জন্ম হয়েছে। এ ছাড়া কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকের মালিকপক্ষ অসংযত আচরণ করে থাকে, এমন অভিযোগ রয়েছে। সার্বিক ব্যবস্থাপনায় পেশাদারি বৃদ্ধি ও সংহতকরণের ওপর জোর দিতে হবে। মালিকপক্ষের অসংযত আচরণের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোরতা প্রয়োজন। এ জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পেশাগত মানোন্নয়ন ও নৈতিক মানদণ্ড প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম হাতে নিতে হবে। শুধু আইনই কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ক্ষমতায়ন করতে পারবে না, সেই সঙ্গে প্রয়োজন যোগ্যতা ও নৈতিকতা।
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ: ব্যাংকার, সাবেক ডেপুটি গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক।