গুলশান হামলা

এটাই বাংলাদেশের একমাত্র বাস্তবতা নয়

এটা অত্যন্ত বিয়োগান্ত ঘটনা এবং আমাদের জন্য খুবই দুর্ভাগ্যজনক। ঈদ সামনে রেখে মানুষের অনেক ধরনের আশা-উদ্দীপনা ছিল। সে সময় এ ঘটনা আমাদের মনস্তাত্ত্বিকভাবে খুবই নাড়া দেয়। এতগুলো প্রাণের অপচয় খুবই কষ্টের ব্যাপার। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ভালোভাবেই তাদের দায়িত্ব পালন করেছে। দুজন পুলিশ অফিসার জীবন দিয়ে কর্তব্যনিষ্ঠা দেখিয়ে গেছেন। তাঁদের রুহের মাগফিরাত কামনা করি। যাঁরা জিম্মি ছিলেন, তাঁরাও ঘটনার শিকার। তাঁদের পরিবারের প্রতিও সমবেদনা জানাই।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে এর প্রতিক্রিয়া তিনভাবে আসবে বলে আমি মনে করি। এক. নীতিগত বা রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া, দুই. কূটনৈতিক প্রতিক্রিয়া এবং তিন. বাংলাদেশের ভাবমূর্তির ক্ষতিজনিত প্রতিক্রিয়া। এই তিন আঙ্গিক থেকে পর্যালোচনা করে কোনটা করলে ভালো হবে, সেটা আমরা ঠিক করতে পারি।
এ রকম একটা ঘটনার ইঙ্গিত বিভিন্ন দেশের পক্ষ থেকে সরকারকে বারবার দেওয়াও হয়েছে। আমাদের নিরাপত্তা বাহিনীও নিশ্চয়ই বিষয়টা মূল্যায়ন করেছে। এখন সে অনুযায়ী ঘটনা ঘটেছে বলে আমরা বলছি আশঙ্কাগুলো সঠিক ছিল। কথা হলো, আমাদের সব সময়ই প্রস্তুত থাকতে হবে। সন্ত্রাসবাদের বিপক্ষে বাংলাদেশের শূন্য সহনশীলতা বা জিরো টলারেন্স ছিল এবং আছে। সম্প্রতি আমাদের নিরাপত্তাব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা হয়েছে। কিছুদিন আগেই সারা দেশে প্রায় ১৪ হাজার লোককে আটক করা হয়েছিল। তার মধ্যে প্রায় ২০০ জন জঙ্গি বলে সরকার জানিয়েছে। এর মধ্যেই এই ঘটনা ঘটল। তার অর্থ, আমাদের নিরাপত্তা-কৌশল পুনর্বিবেচনা করা দরকার। সমাজের সব স্তরের মানুষকে জড়িত করে আমাদের যেসব সামাজিক ইতিবাচক মূল্যবোধ আছে, সেগুলো জাগ্রত করে কীভাবে ঝুঁকি কমানো যায়, তা দেখতে হবে। এই প্রেক্ষাপটে নতুন করে ভাবা দরকার। সবাইকে নিয়েই এ কাজ করতে হবে। সন্ত্রাসবাদের গুরুত্ব উপলব্ধি করে একে প্রতিরোধে মনোযোগ দেওয়া প্রধান বিবেচনা হওয়া দরকার। এই দিকটাতে সবার অংশগ্রহণ এখন বাস্তবের প্রয়োজন। এর মধ্যে অন্য বিষয় আনার দরকার নেই।
দ্বিতীয়ত, ঘটনা যেখানে ঘটল, সেটা বাংলাদেশের কূটনৈতিক পাড়া। এখানে হামলা হওয়ার কারণে যাঁরা বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক ও নাগরিক আছেন, তাঁদের মধ্যে নিরাপত্তা-সংশয় তৈরি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। স্থানীয়ভাবে বিদেশি কূটনীতিকদের নিরাপত্তাবোধকে
কীভাবে শক্তিশালী করা যায়, সেটা আমাদের অগ্রাধিকারে রাখতে হবে।
এই ঘটনা সরাসরি বিবিসি, সিএনএন, আল-জাজিরা, এনডিটিভিতে দীর্ঘ সময়জুড়ে প্রচারিত হয়েছে। সারা পৃথিবীর মানুষ ঘটনাটা দেখে উৎকণ্ঠিত হয়েছে। বাকি পৃথিবীর সামনে কীভাবে আমরা একে ব্যাখ্যা করব, যা আমাদের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তির অনুকূল, সেটা খুঁজে বের করতে হবে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এখনই আমাদের দূতাবাসগুলোর মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের নীতিনির্ধারক মহল, গণমাধ্যম, চিন্তাশালার মানুষের কাছে সরকার কী করেছে, কীভাবে করেছে, তা তুলে ধরে আস্থা সৃষ্টির কাজ করতে পারে। আমাদের জানানো দরকার যে, এই ঘটনা দিয়েই বাংলাদেশকে পুরোপুরি ব্যাখ্যা করা যাবে না। এটাই আমাদের একমাত্র বাস্তবতা নয়। আমাদের কূটনৈতিক ভাবমূর্তি রক্ষায় দ্রুতই এ কাজ করা দরকার।
যেসব দেশের নাগরিক নিহত হয়েছেন, সেসব দেশে নাগরিক পর্যায়ে বাংলাদেশের অবস্থান চাপের মুখে পড়বে। এঁদের লাশগুলো যখন সেখানে পৌঁছাবে, তখন মিডিয়ার মাধ্যমে ওখানকার সমাজে নেতিবাচক ধারণা জন্মাবে। এবং সেটা পর্যায়ক্রমে ওইসব দেশের সরকারের ওপরও চাপ বাড়াবে। এতে করে বাংলাদেশ নিরাপদ দেশ কি না, এখানে ব্যবসা করা নিরাপদ কি না, এসব প্রশ্ন ঘনীভূত হবে। কাজেই কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক স্বার্থে আমাদের মিশনগুলোকে এখনই নেমে পড়া দরকার।
বিদেশে বাংলাদেশ মিশনগুলোর উচিত দীর্ঘ দিনে গড়ে ওঠা বাংলাদেশের ভাবমূর্তি যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, তার জন্য কাজে নেমে পড়া। সবাইকে বোঝানো যে, আমরা সহনশীল, আমরা সবাইকে নিয়ে চলি। কিছুকাল ধরে কিছু ঘটনা ঘটলেও আমাদের সহনশীলতা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, নারীর ক্ষমতায়ন, তরুণদের উদ্যমই বাংলাদেশের স্থায়ী বৈশিষ্ট্য। সবাইকে নিয়ে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে একযোগে কাজ করতে প্রস্তুত বাংলাদেশ। আমাদের যে বন্ধুরা আছেন, যাঁরা আমাদের আগেও সতর্ক করেছেন, তাঁদের নিয়ে আমাদের এই ভাবমূর্তি রক্ষার সংগ্রাম করতে হবে।
গুলশানের ঘটনার অভিঘাতে সবাই যে ঐক্যবদ্ধভাবে দাঁড়িয়েছে, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তাকে স্থায়ী করার বিকল্প নেই। আমরা যে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সত্যিকারভাবেই সোচ্চার ও সক্রিয় সেটা প্রতিষ্ঠা করার জন্যই এটা করতে হবে। যারা হামলা করেছে, তারা একটা সংকীর্ণ দৃষ্টিকোণ থেকেই করেছে। তারা তাদের চোখ দিয়েই পৃথিবীটাকে দেখতে চাইছে। কিন্তু এখনকার পৃথিবী বহুমাত্রিক। এই বহুমাত্রিকতাকেই তারা চ্যালেঞ্জ করতে চায়। এত ক্ষুদ্র ধারণা দিয়ে তারা সাময়িক ঝাঁকুনি সৃষ্টি করতে পারে, প্রাণহানি ঘটাতে পারে, বেকায়দায় ফেলতে পারে, কিন্তু বাংলাদেশের জনগণের বৃহৎ জীবনপ্রবাহকে থামিয়ে দিতে পারবে না। তাদের সম্ভাবনা বেশি নয় বলেই আমি মনে করি।
হুমায়ুন কবীর: যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত।