কারও আঙুল ফুলে কলাগাছ হয় আর কেউ আঙুল চোষে। চিকিৎসকেরা বলেন, নখসুদ্ধ আঙুল পরিষ্কার থাকলে ওটা চোষা যেতেই পারে। শিশুর বেলায় ওটা বদভ্যাস হলেও বড়দের জন্য অসহায়ত্ব। যখন কারও করার কিছু থাকে না, তখন আঙুল চোষায় লজ্জা থাকলেও অপরাধ হয় না।
৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের সময় আঙুলের নখে কালির দাগ না লাগাতে পারায় অনেকে আঙুল চুষেছিলেন। এ জন্য কেউ কোটি কোটি ভোটারকে দোষারোপ করেননি। একটু বদনাম হয় আরকি। যাঁরা আগের রাতে ব্যালট বাক্স টানাটানি করে হাতে দাগ লাগিয়েছিলেন, তাঁদের অন্তত আঙুল চোষার বদনাম দেওয়া যায় না। চুষলে বরং ঝামেলাই হতো। ময়লা আঙুল চোষা বারণ। সেটা তাঁরা করবেনই–বা কেন? চিকিৎসকেরা বলে থাকেন, আঙুল চোষে কিংকর্তব্যবিমূঢ়েরা। যে শিশু ভয় পায়, নিরানন্দ লাগে যার, সে আঙুল চোষে। আবার উত্তেজিত হলে আঙুল চুষলে মন শান্ত হয়। আঙুল চোষার ফজিলত বাংলাদেশিদের চেয়ে আর কে বেশি জানে?
প্রকাশ্যে নারীকে গণপিটুনিতে যখন মেরে ফেলা হলো, তখন দর্শকেরা আঙুল চুষেছিল। যখন বরগুনায় রিফাত শরীফকে কোপানো হচ্ছিল, তখনো চারপাশে আঙুল চোষায় সিদ্ধহস্তদের আমরা ভিডিওতে দেখেছি। তাদের মধ্যে আমার–আপনার মতো মানুষও ছিল। যখন সব আমরা আমরাই করে থাকি, তখন আর লজ্জার কী থাকতে পারে! যখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনের এক কর্মীর মাজায় হাতুড়িনৃত্য চলছিল, দর্শকদের কারও হাত তখন এগিয়ে এসে তাঁকে বাঁচাতে পারেনি। কারণ, হাতের একটি আঙুল মুখে পোরা ছিল। একটি আঙুল, কেবল একটি আঙুল মুখে পুরে রেখে দেখুন আর কিছু করতে পারেন কি না?
যেমন আমরা পারিনি, আমাদের তৎকালীন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আতিউর রহমান সাহেবও পারেননি। তাঁর এবং তাঁর মতো অনেক দায়িত্বশীলের চোখের সামনে ব্যাংকের নিরাপত্তাব্যবস্থা হ্যাক করে প্রায় হাজার কোটি টাকা লুটে নিয়ে গেল; তাঁরা কিছু করতে পারেননি। সম্ভবত তাঁরা তখন আঙুল চুষছিলেন। সেই চোষা এমনই চোষা যে ঘটনাটির ২৮ দিন পরও তিনি মুখ খুলতে পারেননি। কারণ, মুখে আঙুল পোরা ছিল। ফলে কেউ কিছু জানতেও পারেনি।
এক গৃহস্থ ঘুমের মধ্যে মুখে আঙুল পুরে রাখতেন। ছোটবেলার অভ্যাস। এক রাতে যখন তাঁর ঘরে চুরি হচ্ছে, তখন ঘুম ভাঙলেও তিনি আওয়াজ করতে পারেননি। আওয়াজ করতে হলে মুখ থেকে আঙুল বের করতে হয় যে! মুখে ঠেসে ধরা আঙুল চুপ করানোর প্রতীক। আর আঙুল চোষা হলো স্বেচ্ছা নীরবতার প্রতীক।
ডেঙ্গু মহামারিতে সারা দেশে দুই শর বেশি মানুষের মৃত্যু হলো, আরও হচ্ছে। আগেভাগে খবরও ছিল। তবু আঙুল চোষাজনিত বিকলতায় সংশ্লিষ্টরা কোনো প্রতিরোধ গড়তে পারেননি। খেলাপি ঋণে ব্যাংক–আর্থিক প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হওয়ার মুখে, লাখো কোটি টাকা বিদেশে পাচার, কারও আঙুল উঁচু হয়ে বলল না, ‘খবরদার!’
আমরা দেখেছি, সঠিক মানুষের সঠিক তর্জনী সঠিক সময় উঁচু হলে কী হয়? ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বিশ্ব দেখেছে, একটি স্বাধীন ও সাহসী আঙুলের নির্দেশ কত শক্তিশালী হতে পারে। মিয়ানমার এক মিলিয়ন রোহিঙ্গা শরণার্থী পাঠিয়ে দিল, গণহত্যা চালাল সীমান্ত ঘেঁষে। মানবতার ভয়াবহ ধ্বংসের রিয়েলিটি শো দেখেও কেউ বলল না, ‘আমাদের দেশ তোমাদের নিষ্ঠুরতার শিকারদের ফেলার জায়গা না, খবরদার!’
প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের হিসাব অনুযায়ী, বিভিন্ন দেশ থেকে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১১ জন শ্রমিকের লাশ আসছে। এ বছরের প্রথম আট মাসে এসেছে ২ হাজার ৬১১টি লাশ। যেসব নারীর ঘর হইতে আঙিনা বাহির ছিল, তাঁরাও আশায় বুক বেঁধে মধ্যপ্রাচ্যে যান। রক্তাক্ত–নির্যাতিত হয়ে তাঁরা ফিরে আসছেন। আমাদের যুবকেরা ইউরোপে যেতে সমুদ্রে ডুবে মরছেন। মুখে আঙুল পুরে আমরা টেলিভিশনে দেখে গিয়েছি; কিচ্ছু করতে পারিনি।
যুবলীগের নেতা ক্যাসিনো ব্যবসায় জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার হলে সংগঠনের চেয়ারম্যান গোসসা করেছেন। বলছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং সরকারের লোকেরা কি এত দিন আঙুল চুষেছেন? তাঁরা কি এসব জানতেন না? কথা সত্য, যাঁদের করার কিছু থাকে, তাঁরা সাধারণত আঙুল চোষেন না। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা নিশ্চয় অন্য কাজে ভীষণ ব্যস্ত ছিলেন। তাই আঙুল চোষার অভিযোগ অন্তত তাঁদের বিরুদ্ধে করা যায় না। স্বয়ং চেয়ারম্যানও সময় পাননি তাঁর অনুসারীদের খোঁজ রাখতে। টেলিভিশনে যেভাবে তাঁদের ব্যস্ততা, সফর, বক্তৃতা ইত্যাদির সচিত্র বিবরণ দেখে মনে হয় না আঙুল চোষার সময় তাঁরা পান। সেই সময় আমাদের আছে, আমরা যারা আমজনতা।
এখন যখন ক্ষমতার এক আঙুল আরেক আঙুলকে দোষারোপ করছে, তখন জনগণ হিসেবে আমরা বিভ্রান্ত হই। বেদিশা লাগে। ফকিরাপুলের ইয়ংমেনস ক্লাবে সাংবাদিকদের ক্যামেরার হঠাৎ আলোর ঝলকানি দেখে চমকে আমাদের মুখ হাঁ হয়ে যায়। এই অবসরে চোষণলিপ্ত মুখ থেকে ছাড়া পায় আঙুল। সেই আঙুলে মাথা চুলকাই। বুঝতে পারি না কলির কোন কালে এসে পড়লাম রে বাবা! সবাই হঠাৎ ফ্রুটিকা খেল নাকি? এত সত্য সত্য কথা বলছে কেন সবাই? আমরা উত্তেজিত হই। উত্তেজনাবশত আবার মুখে আঙুল পুরে দিই এবং চুষতে চুষতে দেখি, বড় মাছ ছোট ছোট মাছকে ধাওয়া করছে। এক উপাচার্য চিরকুট দিয়ে ছাত্র ভর্তি করছেন, আরেকজন কোটি টাকার সেলামি দিচ্ছেন, আরেকজন আবার ৩৪০ দিনের চাকরিতে ২৫০ দিন ক্যাম্পাসেই যাননি।
একটা গল্প মনে পড়ে যায়।
প্রথম শ্রেণির ছাত্র ভোলারামের আঙুল চোষার রোগ। মা–বাবা হোমিও, অ্যালো, টোটকা, কবিরাজি সব সেরে হয়রান। কিছুতেই ভোলার মুখ থেকে আঙুল বেশিক্ষণ বাইরে রাখা যায় না। ভোলার এক মামা ছিলেন। সব দেখে তিনি সহজ বুদ্ধি দিলেন। বললেন, ‘দাও ওর প্যান্টগুলো আচ্ছা ঢিলা করে।’
এরপর হলো কী। পরলেই প্যান্ট কোমর থেকে যে–ই না খসে পড়ে, অমনি ভোলা দুই হাত দিয়ে প্যান্ট ধরে রাখে তুলে। এমনি করেই বেচারা দৌড়াদৌড়ি করে, খেলাধুলা করে, স্কুলে যায়। বাবা–মা, স্কুলের শিক্ষক, বন্ধুবান্ধব—সবাই বেজায় খুশি। সবাই শিখল, প্যান্ট খসে গিয়ে নাঙ্গা হওয়ার ভয় না পেলে কেউ আঙুল চোষা বন্ধ করে না।
যে জাতি আঙুল চোষার নেশায় আসক্ত, তাদের ভোলারামের মতো পরনের কাপড় খসে পড়লেও আঙুল চোষা আর বন্ধ হবে না। সমস্যা হলো, খেলারামরা মাঠের দখল নিয়ে নিলে ভোলারামরা আঙুল না চুষে আর কী করতে পারে? আমাদের অবস্থা হয়েছে, এক হাতে কাপড় সামলাই তো আরেক হাতের আঙুল চুষি।
ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
faruk.wasif@prothomalo.com