এক সকালে বাসনালয়ে

.

ধামরাই বাসনালয়। এটা ধামরাইয়ের কোনো সুপারমার্কেট বা সুপারশপের নাম হতে পারত। অথবা কোনো যৌনপল্লির। যেখানে মানুষের বাসনার পসরা সাজানো থাকে। যে বাসনা পয়সা ফেলে মেটানো যায়। কিংবা যায় না। মনের বাসনা কি আর কখনো মেটে?
এই দোকানটা অবশ্য ধামরাইয়ে নয়, পুরান ঢাকার শাঁখারীবাজারে। সময়টা গত মাসের শেষাশেষি। তবে হতে পারত গতকালও।
ভোররাত পর্যন্ত উঠতি ঢাকার আর্মি স্টেডিয়ামে উচ্চাঙ্গ বাসনার তালে তাল দিয়ে ঘুমের বাসনা অপূর্ণ রেখে পড়তি ঢাকার জজকোর্টে তড়িঘড়ি ছুটেছিলাম জটিল আরেক বাসনার ফেরে। পৌঁছে দেখি অনেকটা সময় অপেক্ষা করতে হবে। জজকোর্টের পেছন দিকের রাস্তায় শাঁখারীবাজারে ঢোকার মুখে গাড়ি রেখে ঢুকি বিক্রমপুর মিষ্টান্ন ভান্ডারে। তেলছাড়া সেঁকা পরোটা আর ডালভাজি দিয়ে উদরের বাসনা তৃপ্ত করে অতঃপর সময় কাটানোর জন্য শাঁখারীবাজারের গলিতে ঢুকে পড়ি।
মন্দিরে মন্দিরে সকালের পূজা চলছে। ধূপের সুবাস এসে মেশে করপোরেশনের নর্দমার বদ গন্ধের সঙ্গে। কপালে-মলিন-সিঁদুর মধ্যবয়সী এক নারীর সামনে টুকরিতে কয়েক ছড়া আকন্দ ফুলের মালা। গত দিন শনিপূজার্থীদের কাছে বিক্রির পর পড়ে থাকা পসরা। দুই পা হাঁটতেই বন্ধ দরজার ওপরে ‘ধামরাই বাসনালয়’-এর সাইনবোর্ডে চোখ আটকে যায়। মনের মধ্যে বাসনাবিলাসী চিন্তারা একটু ছোটাছুটি করে। তারপরই সাইনবোর্ডে ঘটি-বাটির ছবিটা নজরে আসে। একে বলা যায়, বাসনে বাসনার ছন্দপতন!
সরু রাস্তার দুই ধারে দোকান, শাঁখের কারখানা, মন্দির আর বসতবাড়ির ঠাসবুনট। ভগ্নদশা মলিন পুরোনো বাড়িগুলোর নিচু নিচু খোলা দরজা দিয়ে ভেতরে চোখ চালালে কিছু ঠাওর হয় না। সেখানে যুগ-যুগান্তের স্যাঁতসেঁতে অন্ধকার থাবা গেড়ে বসে আছে। ব্রিটিশ আমলের দালানের ঐতিহ্য অবশ্য তলানিতে ঠেকেছে। ইতস্তত বটের চারা ওঠা আর বিচিত্র জোড়াতালি মারা অবশিষ্ট প্রাচীন বাড়িগুলোর গায়ে গায়ে গোত্তা মেরে মাথা তুলছে ঝকঝকে রং করা কয়েক তলা উঁচু উঁচু সব নতুন বাড়ি। স্থাপত্যের নিদারুণ এই জগাখিচুড়ির মধ্যে জীবনের হাটবাজার ঘুম ভেঙে আড়মোড়া দিচ্ছে।
নর্দমার পাশে অ্যালুমিনিয়ামের থালে কিলবিল করে বাচ্চা বাচ্চা কালো কালো শিং মাছ। তড়পাচ্ছে ছোট ছোট কইয়ের ঝাঁক। মাছওয়ালা হাঁকছেন, ‘দেশি কই!’ বাসি কাপড়ে ঘুমভাঙা শিথিলতায় দু-চারজন ক্রেতা মাছ আর দুবলা–পাতলা ফুলকপির দর করছেন। ভ্যানগাড়িতে ঝড়তিপড়তি পেঁয়াজের রাশি বেছে মেপে মেপে পোঁটলা করছেন এক দোকানি আর তাঁর বালক সহকারী।
রাস্তায় তখনো ঝাঁট পড়েনি। ধুলায় পাক খাচ্ছে রংচঙে পলিপ্যাকের মোড়ক, ছেঁড়া কাগজ আর থুতু, কফের দলা।
ছোট্ট এক দোকান মাত্র খুলেছে। ঘর পোঁছাপুঁছিতে ব্যস্ত দোকানি সতর্ক সন্দেহের চোখে আমাকে মাপেন। তিন কৌটা সিঁদুর কিনে ফেলা গেল। তারপর ঘুপচি একটা শাখা গলির ভেতরে কেটলির টোপর দেখতে পেয়ে মনে চায়ের বাসনা জাগল।
পুরোনো এক বাড়ির তলায় ফোকরের মতো একটা ঘরে বেঞ্চি ফেলে তাক তুলে চলছে টুকটাক চায়ের দোকান। বেঞ্চিতে উদাস চালে বসে আছেন একজন। দোকানি কই? তিনি বলেন, ‘চা খাবেন, তা আমাকে বলবেন তো?’ আদা ছেঁচে তার মধ্যে ধোঁয়া-ওঠা চনমনে সুগন্ধি লাল পানি ঢেলে ঝকঝকে ছোট্ট কাচের মগটা এগিয়ে দেন তিনি।
দুই পর্বে চাসহ সকালের নাশতা সারা গেল এক শ টাকার মধ্যেই। জজকোর্টের দিকে ফিরতে থাকি। আমার আইনি বাসনার কান্ডারি উকিল ভাইবোনেরা তখনো আসেননি। গাড়ির পেছনের আসনে পা মেলে বসে আদালতের ভেতরের উঠানে মানুষের চলাচল দেখি। লোহার রেলিংয়ের ওপারে সেখানে বিচারকদের গাড়ি রাখার জায়গা। আমার দিকে পিঠ ফিরিয়ে আছে যে দালান, তার এই কোনাটা অর্ধগোলাকার—লাল রং করা ইটের দেয়াল নিরেট খাঁড়া উঠে গেছে। সেই দেয়ালের গায়ে চন্দ্রহারের মতো ঝুলছে একটা দড়ি।
পাশের খোলা ফটক দিয়ে চত্বরে ঢুকলেন ঘোমটা টানা এক নারী। তাঁর হাতে কাচা কাপড়ের বালতি। একটা একটা করে ঝাড়া দিয়ে রেলিংয়ে আর দড়িতে তিনি মেলতে লাগলেন ছোট শিশুর জামা-জাঙ্গিয়া-কাঁথা, বালিশের ওয়ার, একটা শাড়ি। শাঁখারীবাজারের যে বাড়িতে তাঁর বাস, সেখানে কাপড় শুকানোর উপায় নেই। আদালতে কত মানুষ কত বাসনা নিয়ে আসে। তিনি আসেন নিতান্তই গেরস্থালির ছাপোষা তাগিদে, আদালতের অন্দরের উঠানের একটুখানি সুবিধা নিতে।
আজব এই শহরের নিরুপায় এক গৃহিণী তিনি, যাঁকে বুদ্ধি করে সংসারের রোজকার কাজগুলো সারতে হয়। কে জানে তাঁর বাসনালয়ের ঠিকানা কোথায়।
নিপুণ হাতে কাপড় মেলে তিনি চলে গেলেন। নামটা জানা হলো না। সবার নাম যে জানতেই হবে, তার তো কোনো মানে নেই।
কুর্‌রাতুল–আইন–তাহ্‌মিনা : সাংবাদিক।