এক ‘মৃতপ্রায়’ শহরে দাঁড়িয়ে

রাজধানীর কিছু এলাকা দেখলে মনে হবে এ এক ধুলোর শহর
ছবি: প্রথম আলো

আশির দশকে একটা কথা খুব জনপ্রিয় ছিল—‘রাতে মশা, দিনে মাছি/এই নিয়ে ঢাকায় থাকি।’ এখন মাছি অত দেখা না গেলেও মশার কমতি নেই, এ কথা আমরা বলতেই পারি। কিন্তু ‘জাদুর শহর’ এ ঢাকা আসলেই আমাদের অনেক তেলেসমাতি দেখিয়ে একে একে সবকিছুতেই শীর্ষে চলে যাচ্ছে। মানে, যত রকম শীর্ষ তালিকা আছে, সবকিছুতে শীর্ষ স্থান দখল করে বীরদর্পে আমাদের সুনাম বাড়িয়েই যাচ্ছে।
আসুন দেখে নিই, কোথায় কোথায় আমরা ‘এগিয়ে’। কী দিয়ে শুরু করা যায়?

ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) (৯ জুন ২০২১) বিশ্বের বসবাসযোগ্য শহরের র‍্যাঙ্কিংয়ে ১৪০টি শহরের তালিকায় ১৩৭তম অবস্থানে রয়েছে ঢাকা। ইআইইউর র‍্যাঙ্কিংয়ে নিচের দিকে সবচেয়ে তলানিতে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক, নাইজেরিয়ার শহর লাগোস, পাপুয়া নিউগিনির পোর্ট মোরেসেবি। স্থিতিশীলতায় ঢাকা পেয়েছে ৫৫ নম্বর, স্বাস্থ্যসেবায় ১৬ দশমিক ৭, সংস্কৃতি ও পরিবেশে ৩০ দশমিক ৮, শিক্ষায় ৩৩ দশমিক ৩ নম্বর ও অবকাঠামোয় ২৬ দশমিক ৮ নম্বর। ৪০০ বছরের ঢাকা অবশ্যই স্থিতিশীল। স্বাস্থ্যসেবায় ভিআইপিদের বিদেশ যাওয়া দেখলেই বোঝা যায় কী অবস্থা! ঢাকাতে যদি সম্ভব না হয়, অন্যদের কী অবস্থা বোধগম্য।

পরিবেশ নিয়ে পরে আসব, দেশের প্রধানতম উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্ব র‍্যাঙ্কিংয়ে অবস্থান ১৭৯৪তম। অথচ পাকিস্তানেরও কিছু বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের ওপরে আছে। আর অবকাঠামো? উড়োজাহাজ দিয়ে কেউ যখন ঢাকায় ল্যান্ড করেন, ইটপাথরের জঞ্জাল ছাড়া আর কিছু কি দেখতে পাওয়া যায়? এখন গাছ লাগানোর জন্য মাটিও কিনে আনতে হয়। সব থেকে বেশি খারাপ লাগে শিশুদের জন্য, তারা পায় না মাঠ, সবুজ; ওদের শৈশব আমরাই নষ্ট করে দিচ্ছি।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা জিপজেটের তালিকা অনুযায়ী, ঢাকা বিশ্বের সবচেয়ে মানসিক চাপের শহর। মনোবিদদের কাছে সিরিয়াল নেওয়া দেখলেই বোঝা যায়। আজ থেকে ছয় বছর আগেও যা চিন্তা করা যেত না। স্প্রিংজার নেচার প্রকাশনার বায়োমেড সেন্ট্রাল (বিএমসি) সিরিজের জার্নাল অব হেলথ, পপুলেশন অ্যান্ড নিউট্রিশনের গবেষণা নিবন্ধ অনুসারে, দেশের শহর এলাকার ৬১ দশমিক ৫ শতাংশ কিশোর-কিশোরী মাঝারি থেকে চরমমাত্রার মানসিক চাপে ভুগছে বলে এক গবেষণায় উঠে এসেছে। কবি সুকান্ত, আমরা আপনার কাছে ক্ষমা চাই, ওদের জন্য বাসযোগ্য শহর আমরা দিতে পারিনি।

এরপর আসি পরিবেশের কথায়। বায়ুদূষণের চ্যাম্পিয়ন শহর ঢাকা। মাঝেমধ্যে নয়াদিল্লি পজিশন সরিয়ে দিলেও প্রথম তিন থেকে আমরা কখনোই বাদ যাই না। ভাগ্যিস দেশে সিএনজিতে বেশির ভাগ গাড়ি চলে, না হলে নব্বইয়ের দশকের কালো ধোঁয়ার ঢাকা এখন অন্ধকার থাকত। জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির (ইউএনএপি) ‘ফ্রন্টিয়ারস ২০২২: নয়েজ, ব্লেজেস অ্যান্ড মিসম্যাচেস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে দেখা যায়, শব্দদূষণের তালিকায় বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার অবস্থান প্রথম।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনার কথা উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, আবাসিক এলাকার জন্য অনুমতিযোগ্য শব্দের মাত্রা ৫৫ ডিবি (ডেসিবেল) এবং বাণিজ্যিক এলাকার জন্য ৭০ ডিবি, সেখানে ঢাকায় শব্দের মাত্রা ১১৯ ডিবি। জ্যামে বসে অযথা হর্ন—আর কত? পানিদূষণের কোনো তুলনামূলক ডেটা না থাকলেও যেকোনো ঢাকাবাসীই জানেন, ঢাকার আশপাশের চার নদীর কী অবস্থা। ভূগর্ভ থেকে পানি নেওয়ার কারণে স্তর দিনদিন নেমে যাচ্ছে, আর ভূমিকম্পের ঝুঁকিও বাড়ছে। এ বছর পানিতে কলেরার জীবাণু পাওয়া যাচ্ছে, এমনকি দেশের সবচেয়ে বেশি বেতনে কর্মরত ওয়াসার এমডির বাসার পানিতেও দুর্গন্ধ পাওয়া গেছে।

বিশ্বব্যাংক ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) হিসাবে যানবাহনের গড় গতিবেগ ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার (৫ এপ্রিল ২০২২)। বহুজাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান নামবিওর ‘ট্রাফিক ইনডেক্স-২০১৮-এর তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার গণপরিবহন ব্যবস্থা পৃথিবীতে সবচেয়ে দুর্বল। পৃথিবীর ২০৩টি শহরের মধ্যে দ্বিতীয় যানজটপূর্ণ নগর বাংলাদেশের রাজধানী। এখন যানজটের কারণে ঢাকায় দৈনিক ৮২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়, যার আর্থিক মূল্য দাঁড়ায় প্রায় ১৩৯ কোটি টাকা। এ হিসাবে বছর শেষে যানজটে ক্ষতির পরিমাণ ৫০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। এ বছর আমরা আশা করি, এখানেও প্রথম হতে পারব।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক জরিপকারী প্রতিষ্ঠান ‘মার্সার’ ২০২১ সালের এক জরিপে ব্যয়বহুল হিসাবে ২০৯টি শহরের মধ্যে ঢাকার অবস্থান ৪০তম। ব্যয়বহুল শহরের তালিকায় ঢাকার নিচে রয়েছে বিশ্বের আরও বেশ কয়েকটি বড় শহর। তার মধ্যে দুবাই, ব্যাংকক, রোম, ওয়াশিংটন, মুম্বাই, ম্যানিলা, টরন্টো, নয়াদিল্লি, মিউনিখ, ব্রাসেলস, বার্লিন ও মস্কো অন্যতম। এই বছর কি আমরা আর একটু এগোব না?

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) গবেষণা থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীতে আশঙ্কাজনক হারে শোষণক্ষম ভূমি কমছে। ১৯৯৯ সালে ঢাকায় কংক্রিট আচ্ছাদিত ভূমির পরিমাণ ছিল প্রায় ৬৫ শতাংশ। ২০১৯ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮২ শতাংশে। অর্থাৎ ২০ বছরের ব্যবধানে শোষণক্ষম ভূমি কমেছে ২৬ শতাংশ। একই সঙ্গে রাজধানীতে কমেছে খোলা জায়গাও।

১৯৯৯ সালে রাজধানীতে খোলা জায়গা ছিল ১৪ শতাংশ। বর্তমানে তার পরিমাণ মাত্র ৪ দশমিক ৬১ শতাংশ। রাজধানীতে সবুজ আচ্ছাদিত এলাকার পরিমাণ বর্তমানে ৯ দশমিক ২ শতাংশ। ২০ বছরে সবুজ আচ্ছাদিত এলাকা কমেছে প্রায় ৩৮ শতাংশ।
সবশেষে আসি আসল কারণে। জনঘনত্ব। ২০২০ সালের ডেটা (উইকিপিডিয়া) অনুযায়ী, ঢাকার জনসংখ্যা এখন ২ কোটি ১০ লাখের বেশি। ঢাকা বিশ্বের সবচেয়ে জনঘনত্বপূর্ণ শহর, যেখানে ২০১৩ সালের ফোর্বসের ডেটা অনুসারে প্রতি বর্গমাইলে বাস করে ১ লাখ ১৫ হাজার দুই শ মানুষ, যা এখন দেড় লাখের কাছাকাছি।

কিছুদিন আগে এডিবির এক সেমিনারে পূর্বাচলে নিউ ঢাকা করার কথা হয়েছিল। ছোট্ট একটা উদাহরণ দিই। পূর্বাচলে শুধু সরকারি আবাসিক প্লটই ৫০ হাজার (বাকিগুলো বাদই দিলাম)। সবার যদি পাঁচতলা করে বাড়ি হয়, তাতে দুটি করে ফ্যামিলি থাকে, আর সব ফ্যামিলির একটা করে গাড়ি থাকলে এর সংখ্যা হবে পাঁচ লাখের কাছাকাছি। নগর-পরিকল্পনাতে কি এই সংখ্যা নিয়ে হিসাব করা হয়েছে?


সুবাইল বিন আলম, একটি বিদেশি কোম্পানির কান্ট্রি ডিরেক্টর, বিজনেস ডেভেলপমেন্ট কনসালট্যান্ট এবং সাবেক রিসার্চ ফেলো।
ইমেইল: subail001@gmail.com