আমাদের দেশে নির্বাচনকে অনেকে ‘ভোট উৎসব’ বলতে পছন্দ করেন। এটা শুধু এক দিনের উৎসব নয়। ভোটের দিন মানুষ ভোট দেয়, কিন্তু উৎসব শুরু হয় এর অনেক আগে থেকেই। আর নির্বাচন মানেই তো প্রতিদ্বন্দ্বিতা আর পক্ষ-বিপক্ষ। তাই দুই পক্ষের অংশগ্রহণ ভোট উৎসবকে জমিয়ে তোলে। আমাদের দেশে নির্বাচন মানেই তো প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলোর সরগরম নির্বাচনী প্রচার ক্যাম্প, মিছিল-মিটিং, চায়ের দোকানে আড্ডা আর তর্ক-বিতর্ক। এবার এক পক্ষ সেই উৎসবে ছিল না, তাই এই উৎসব জমেনি। তারা নামতে পারেনি বা তাদের নামতে দেওয়া হয়নি। তারা ভোটের দিনের ওপরই আস্থা রাখতে চেয়েছে। কিন্তু কাল তো তাদের মাঠেই দেখা গেল না! ‘ভোট উৎসবে’ কালও এক পক্ষকেই দেখা গেল। ভোটের দিনের বা এক দিনের উৎসবটিও তাই জমল না।
সময় সকাল ১০টা। নির্বাচনী এলাকা ঢাকা-৯। খিলগাঁও সরকারি উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রের সামনের রাস্তায় লোকজন ঘোরাঘুরি ও গল্পগুজব করছে। আশপাশের চা-পুরির দোকানগুলোও বেশ ভালো জমেছে। এক ব্যাংক কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা কথা হলো। ভোট দিয়ে মহল্লার বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছেন। এখানে পাশাপাশি তিনটি কেন্দ্র, ফলে এলাকাটি বেশ জমজমাট। সাধারণ ভোটার ছাড়া ব্যাজ লাগিয়ে যাঁরা দল বেধে ঘুরছেন তাঁরা সবাই নৌকার লোক। কৌতূহল নিয়ে বেশ কিছু সময় ধরে আঁতিপাঁতি খুঁজে ধানের শীষের একটি লোকেরও দেখা মিলল না। ভোটাররা আসছেন, তাঁদের অনেকের কাছেই স্লিপ বা ভোটের নম্বর নেই। কোথায় বা কার কাছে এই নম্বর পাওয়া যাবে সে জন্য তাঁরা হন্য হয়ে ঘুরছেন। কেউ কিছু বলতে পারছেন না। এমনকি নৌকার ব্যাজ পরে যাঁরা ঘুরছেন, তাঁরাও না।
খিলগাঁও সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে ঢোকার পথে এক দম্পতি আনসার সদস্যের কাছ থেকে জানতে চান স্মার্ট কার্ড দেখিয়ে ভোট দেওয়া যাবে কি না? তিনি জানালেন, ভোটার নম্বর ছাড়া হবে না। কোথায় তা মিলবে এর কোনো জবাব আনসার সদস্যের কাছে নেই। অনেকে মোবাইলে এসএমএস পাঠিয়েছেন ভোটার নম্বরের জন্য, কিন্তু জবাব মিলছে না। একজন বললেন, আগে ভোটারদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রার্থীদের লোকজন ভোটার নম্বরের স্লিপ দিত। এবার কেউ দেয়নি। অনেক খোঁজাখুঁজির পর পাশের খিলগাঁও গার্লস স্কুলে গিয়ে একটি বুথ মিলল, যেখানে ভোটাররা তঁাদের আইডি কার্ড দেখিয়ে ভোটের নম্বর ও স্লিপ সংগ্রহের চেষ্টা করছেন। ভিড় দেখে বিরক্ত হয়ে দু–একজন চলেও গেলেন।
খিলগাঁও গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজ। ভোটকেন্দ্রে যখন গেলাম, তখন বেলা সাড়ে ১১টা। বুথ নম্বর ১–এ ততক্ষণে ১৪৫টি ভোট পড়েছে। নির্বাচনী কর্মকর্তা বললেন, তঁার বুথে ভোট ৫০০–এর কাছাকাছি। দুজন এজেন্ট পাওয়া গেল। পরিচয় জানতে চাইলে বললেন, নৌকা ও গোলাপ ফুল। ধানের শীষের প্রার্থীর এজেন্ট কই? তাঁরা জানলেন আসেনি। সেই কেন্দ্রের আরও তিনটি বুথে গেলাম। ওই দুজন করেই এজেন্ট, নৌকা আর গোলাপ ফুল। আর কোনো এজেন্ট নেই।
ভোটকেন্দ্রের বাইরে শিক্ষা বিভাগের একজন সরকারি কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হলো। তিনি একসময় প্রিসাইডিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেছেন। তঁাকে বললাম, ভোটকেন্দ্রে বিএনপির তো কোনো পোলিং এজেন্ট নেই। তিনি বললেন নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী যেকোনো দলের জন্যই পোলিং এজেন্টের বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ। শুধু তাই নয়, প্রশিক্ষিত পোলিং এজেন্ট দরকার। তা না হলে তাঁদের পক্ষে প্রার্থীর স্বার্থ রক্ষা করা সম্ভব হয় না।
পোলিং এজেন্ট ছাড়া বিএনপির প্রার্থীর স্বার্থ রক্ষা করবে কে!
খিলগাঁও সরকারি উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে দুপুর ১২টায় এক নম্বর বুথে ৫৭৩ ভোটের মধ্যে ২৫২টি পড়েছে। ভিড় তেমন নেই। ৫ নম্বর বুথটি তখন একদম ফাঁকা। কোনো ভোটারই নেই। এখানেও প্রতি বুথে দুজন করে এজেন্ট। নৌকা আর গোলাপ ফুল।
নির্বাচনী এলাকা ঢাকা–১১। সময় বেলা ১.১৫। তালতলার দারুল উলুম (নুরবাগ) মাদ্রাসাটি নারীদের ভোটকেন্দ্র। প্রবেশপথের মসজিদে তখন মুসল্লিদের ভিড়। খাওয়ার সময়ও হয়ে গেছে। বিরিয়ানির প্যাকেট বিতরণ চলছে। ভোট নেওয়াও চলছে। এক নম্বর বুথে ৫১০ ভোটের মধ্যে তখন ১২১ ভোট পড়েছে। দুজন এজেন্ট। পরিচয় নৌকা ও ধানের শীষ। শেষ পর্যন্ত ধানের শীষ বলে কাউকে পাওয়া গেল! এই কেন্দ্রের বাকি বুথগুলোতে অবশ্য আর ধানের শীষ মিলল না। দুটি বুথে একজন করেই এজেন্ট পাওয়া গেল, নৌকার।
এখানেও একই সমস্যা। অনেক ভোটারেরই ভোটার নম্বর নেই। তবে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের স্থানীয় ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিল অফিসে গেলে তা মিলছে। সেখানে গিয়ে দেখা গেল দীর্ঘ লাইন। লাইনে দাঁড়ানো একজন ভোটার বললেন, এবার বাসায় স্লিপ না যাওয়ায় এই সমস্যা হয়েছে।
সময় বেলা ১.৪০। তালতলার ঢাকা মিশন স্কুল। বুথ ১–এ তখন ভোট পড়েছে ১৬২টি। নির্বাচন কর্মকর্তার তথ্য; বুথের মোট ভোট শ পাঁচেক। এই বুথে এজেন্ট সংখ্যা তিনজন। নৌকা, কাঁঠাল ও হাতপাখা। বসা দেখলাম দুজনকে। জানতে চাইলাম আরেকজন কই। বুথেই জায়নামাজ পেতে নামাজ পড়ছিলেন একজন। তঁাকে দেখিয়ে নৌকার এজেন্ট বললেন, ওই যে হাতপাখার এজেন্ট, নামাজ পড়ছেন।
ঢাকার দুটি আসনের চারটি ভোটকেন্দ্রের ১৫ বুথ ঘুরে একজন ধানের শীষের এজেন্টের দেখা মিলছে। নির্বাচনের চিত্রটি এর মধ্য দিয়ে কিছুটা হলেও হয়তো টের পাওয়া যায়। এই নির্বাচনের আগের নির্বাচনী উৎসবে আমরা বিরোধী দলকে দেখিনি। ভোটের দিনও তাদের দেখা মিলল না। ভোটের ফলাফল যা–ই হোক, নির্বাচনের উৎসবটি থেকে জনগণ এবার বঞ্চিত হলো। গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি হচ্ছে, সরকারি দলের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে যারা ভোটে অংশ নিল, সেই বিএনপি যদি পোলিং এজেন্ট না দেওয়ার মতো অবস্থায় থাকে, তবে তারা ভোটে বিজয়ের আশা করে কীভাবে? অবশ্য বিএনপি আগে থেকেই অভিযোগ করে আসছিল যে মামলা ও ধরপাকড়ের ভয়ে তারা এজেন্ট খুঁজে পাচ্ছে না। পরিস্থিতি যদি তাই হয়ে থাকে তবে তো এটা মানতে হয় যে সরকারি দলের শক্তি প্রয়োগ ও কৌশল—সবকিছুর কাছেই বিএনপি বিপর্যস্ত ও বিধ্বস্ত।
এ কে এম জাকারিয়া প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক
akmzakaria@gmail.com