ফেনীর সোনাগাজীতে একটি মাদ্রাসায় আগুনে পুড়িয়ে নুসরাত জাহান রাফিকে হত্যার ঘটনাপ্রবাহ চারটি বিষয় সামনে এনেছে: এক নারীর যৌন নিপীড়ন, মাদ্রাসার ভেতরে অধ্যক্ষের দ্বারা ছাত্রীর যৌন নিপীড়ন, স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশের দায়িত্বহীন ভূমিকা এবং স্থানীয় রাজনীতির কলুষিত বৃত্তচক্র। এর প্রতিটি বিষয় আলাদাভাবে আমাদের মনোযোগ দাবি করে। এগুলো নিয়ে বাংলাদেশের সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে সংগত কারণেই উদ্বেগ ও আশঙ্কা আছে। কিন্তু চারটি বিষয় কি আসলেই বিচ্ছিন্ন, কোথাও কি এসব বিষয় একটি জায়গায় মিলিত হয়? আলাদাভাবে বিবেচনা করে কি এই ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলা করা সম্ভব?
বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে যৌন নির্যাতনের মাত্রা, বিশেষ করে ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে। নারী ও শিশুরা সবচেয়ে বড় শিকারে পরিণত হয়েছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব থেকে দেখা যায়, পাঁচ বছরে ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টার শিকার নারীর সংখ্যা মোট প্রায় চার হাজার। ২০১৮ সালে ধর্ষণের সংখ্যা ৭৩২, তাদের মধ্যে ৬৬ জনকে ধর্ষণের পরে হত্যা করা হয়েছে। প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ‘প্রায় অর্ধেক ক্ষেত্রেই ঘটনার শিকার নারীর বয়স দেওয়া নেই। কিন্তু বাকিদের ৮৬ শতাংশ শিশু-কিশোরী। ধর্ষণজনিত হত্যার শিকার নারীরও প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ এই বয়সী। এদের বড় অংশটিরই বয়স ১২ বছরের মধ্যে। এই বয়সীদের মধ্যে গণধর্ষণের শিকারও আছে’ (কুর্রাতুল–আইন–তাহ্মিনা ও মানসুরা হোসাইন, ‘শিশুরাই বড় শিকার’, প্রথম আলো, ১৯ জানুয়ারি ২০১৯)।
এ বিষয়ে অন্য সূত্রগুলো যেসব তথ্য দেয়, তাতে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ বলেই প্রতীয়মান হয়। ছয়টি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ) জানিয়েছে, সারা দেশে ২ থেকে ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত ১৫ দিনে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে ৪৭টি শিশু। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৩৯টি শিশু (প্রথম আলো, ১৯ এপ্রিল ২০১৯)। এসব পরিসংখ্যান জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে করা। ফলে এতে পুরো মাত্রাটি ধরা পড়ে না। যদিও আমরা প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো ঘটনার খবর সংবাদমাধ্যমে দেখছি তথাপি বাস্তবতা হচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগী পরিবারগুলো পুলিশের শরণাপন্ন হয় না এবং সেগুলো গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয় না। বাংলাদেশে শিশুদের মধ্যে ছেলেরা এই ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়, সেটা জানা থাকলেও তার কোনো আলাদা পরিসংখ্যান নেই।
এই ভয়াবহতার বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ প্রকাশিত হচ্ছে নুসরাতের হত্যাকাণ্ডের পরে। এই প্রথম ঘটল, তা নয়। ২০১৬ সালের মার্চ মাসে কুমিল্লা সেনানিবাসে ধর্ষণের পর সোহাগী জাহান তনুকে হত্যার ঘটনার পরও ব্যাপক সামাজিক প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। কিন্তু অপরাধীদের খুঁজে পাওয়া যায়নি। পুলিশের তদন্ত, ফরেনসিক রিপোর্ট, এমনকি আদালতের আচরণ ও ঘটনাপ্রবাহ ধারণা দেয় যে তনু নামে আদৌ কেউ মারাই যায়নি, ধর্ষণ-হত্যা তো অনেক পরের ব্যাপার। এই ধরনের আরও ঘটনা আছে, যেগুলো জাতীয়ভাবে আলোচিত বলে সবার মনে আছে। কিন্তু প্রত্যন্ত অঞ্চলে বা জাতীয়ভাবে আলোচিত নয় বলে অনেক ধর্ষণের ও হত্যার ঘটনা আমাদের জানাই নেই। নুসরাতের হত্যার পরে আদালতের বক্তব্যে এখন এটা স্পষ্ট, তনু হত্যা মামলা ‘হারিয়ে গেছে’। বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ বলেছেন, ‘আমরা কোনোভাবেই চাই না সাগর-রুনি, মিতু ও তনুর মতো মামলাটা যেন হারিয়ে যায়’ (ইত্তেফাক, ১১ এপ্রিল ২০১৯)।
যৌন নির্যাতন, ধর্ষণ ও হত্যার ব্যাপকতা সত্ত্বেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিচার না হওয়ার কারণেই মানুষের ক্ষোভ-বিক্ষোভ দৃশ্যমান। সে কারণেই এই প্রতিবাদ যে কেবল একজনের হত্যা বা সোনাগাজীর মাদ্রাসার অধ্যক্ষ এবং তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে বিচ্ছিন্ন ক্ষোভ, তা নয়। ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর পক্ষে এ ধরনের ‘মামলা হারিয়ে যাওয়া’ মেনে নেওয়া সম্ভব নয়, জনসাধারণের পক্ষেও নয়। ‘বিচার না হওয়া’ বা ‘অপরাধীদের পার পাওয়ার’ বিষয়গুলো তাদের কাছে সহজে গ্রহণযোগ্য হয় না।
ধর্ষণের শিকার নারী ও তার পরিবারকে যে ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হয়, তাতে পুলিশের মামলা গ্রহণে অস্বীকৃতি, অনেক ক্ষেত্রে অভিযোগকারীকেই কার্যত অপরাধীর মতো করে বিবেচনা করা, অভিযুক্তদের বাঁচানোর লক্ষ্যে এজাহারে না রাখা, পুলিশের দীর্ঘসূত্রতার সুযোগে অভিযুক্তদের পলায়ন, মামলা দায়েরের পরে বাদীর ওপরে চাপ প্রয়োগের সময় পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা এবং মামলার প্রক্রিয়া—এসব থেকে এই ধারণাই হয় যে বিদ্যমান আইন ও বিচারব্যবস্থা ভুক্তভোগীর পক্ষে তো নয়ই, বরং উল্টো। এর সঙ্গে যুক্ত হয় ধর্ষণের দায় ধর্ষণের শিকার নারীর ওপরে চাপানোর একটি অসুস্থ সামাজিক মানসিকতা। এগুলো সাধারণ মানুষের ভেতরে এই ধারণাই দেয় যে রাষ্ট্র ও সমাজে যাঁরা ক্ষমতাশালী, তাঁরা কার্যত অপরাধীর পক্ষেই। গণমাধ্যমে এঁদেরই ‘প্রভাবশালী মহল’ বলে এক অশরীরী ধারণা হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। অথচ এঁরা রক্ত-মাংসের মানুষ এবং অন্যদের চেয়ে বেশি পরিচিত। বিত্ত ও রাজনীতির ক্ষমতা যাঁদের আছে, বিরাজমান আইন ও বিচারব্যবস্থা তাঁদের পক্ষেই থাকে বলে ধারণা সর্বব্যাপ্ত। সেই কারণেই নুসরাতের হত্যার বিচারের দাবি এতটা জোরালো হয়েছে।
মাদ্রাসার ভেতরে মাদ্রাসার শিক্ষকের দ্বারা নারী নির্যাতনের ঘটনা স্পর্শকাতর বিষয় বলে গণ্য হচ্ছে; এটা সামাজিক প্রতিক্রিয়ার মাত্রা বৃদ্ধিতে অবদান রেখেছে। এর কারণ একাধিক। প্রথমত, যাঁরা মাদ্রাসা শিক্ষার বিরুদ্ধে, তাঁরা এই ঘটনাকে তাঁদের দাবির সমর্থনে একটি প্রমাণ হিসেবে দেখছেন। মাদ্রাসাশিক্ষার পাঠ্যক্রমের ব্যাপারেই তাঁদের প্রধান আপত্তি; তবে তাঁরা এই ধরনের আচরণকে ওই পাঠ্যক্রমেরই ফল বলে মনে করেন। দ্বিতীয়ত, যাঁরা মাদ্রাসাশিক্ষা বিষয়ে কোনোরকম নেতিবাচক অবস্থান নিতে চান না, তাঁরা ধর্মীয় শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের কাছে আরও বেশি নৈতিক আচরণ আশা করেন, তাঁরা সম্ভবত এগুলোকে ব্যত্যয় মনে করেন। তাঁরা মনে করেন যে এগুলো কেবল অনাকাঙ্ক্ষিতই নয়, সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের দিকে নজর দিলে এ কথা মনে হয় যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে মাদ্রাসাগুলোতে শিক্ষার্থীরা তুলনামূলকভাবে বেশি যৌন নিপীড়নের শিকার হয়। এই বিষয়ে আরও তথ্যনির্ভর প্রতিবেদনের প্রয়োজনীয়তা আছে, কিন্তু সমাজের ভেতরে বিরাজমান কথিত ‘ধর্মীয় অনুভূতির’ কারণে না রাষ্ট্রীয়ভাবে, না স্বাধীন গবেষকেরা এ নিয়ে গবেষণা করতে সক্ষম হচ্ছেন। এ ধরনের গবেষণা করতে চাইলেও রাষ্ট্র ও সরকারের সমর্থন পাওয়া যাবে, এমন মনে হয় না। বাংলাদেশের আলেম সমাজ, যাঁরা মনে করেন যে এই ধরনের আচরণকে কোনোভাবেই ইসলাম সমর্থন করে না এবং এই ধরনের কর্মকাণ্ডে জড়িত ব্যক্তিরা ইসলামের অবমাননাই করছে, তাঁরাও যে সহযোগিতা করতে চান তার কোনো নজির নেই। এসব ঘটনার ব্যাপারে তাদের বেদনাদায়ক নীরবতা সহজেই লক্ষণীয়, কঠোর প্রতিবাদ কিংবা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা তো দূরের কথা।
এই নীরবতা, সমাজে ধর্মীয় অনুভূতির প্রশ্ন ছাড়াও আছে ধর্মভিত্তিক প্রতিষ্ঠানের কাছে উচ্চতর নৈতিকতার প্রত্যাশা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিবেশের
প্রশ্ন। এ বিষয়ে আলোচনা করা দরকার। আমাদের মনে রাখতে হবে যে নুসরাতের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত আছে রাজনীতি, প্রশাসন এবং পুলিশের ভূমিকার প্রশ্ন।
আগামী মঙ্গলবার পড়ুন: কত নুসরাতের ন্যায়বিচার সম্ভব?
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর