আগামী ১২ ডিসেম্বর ব্রিটেনে নতুন সাধারণ নির্বাচন। অনেকেরই মনে হতে পারে, এই নির্বাচন নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় বসে কথা বলার কী প্রয়োজন। কিন্তু নির্বাচনটি ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক রণাঙ্গনে রূপ নিয়েছে। দুনিয়ায় কোনো কিছু যে আর কারও ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়’ নেই, তার নজির ব্রিটেনের নির্বাচন।
এই নির্বাচনের প্রধান অ্যাজেন্ডা ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে কীভাবে বের হবে, সেই প্রশ্ন। পুরো ইউরোপের অর্থনীতি জড়িয়ে গেছে এ প্রশ্নকে ঘিরে। কিন্তু কেবল এ কারণেই দেশটির ডিসেম্বরের নির্বাচন আন্তর্জাতিক রূপ পায়নি। সেখানকার লেবার পার্টির নেতা জেরেমি করবিনকে লক্ষ্য করেই মূলত আন্তর্জাতিক পরিসরে বড় ধরনের রাজনৈতিক মেরুকরণ ঘটে যাচ্ছে এই নির্বাচন সামনে রেখে। সর্বশেষ জরিপে প্রতিপক্ষ কনজারভেটিভদের চেয়ে লেবার পার্টি অন্তত ১০ পয়েন্ট পিছিয়ে আছে। তারপরও নির্বাচনের প্রধান চরিত্র হয়ে আছেন বিরোধী নেতা করবিন। ব্রিটেনের রাজনীতিতে বহুদিন পর আবার আদর্শিক পরিবর্তনের হাওয়া তুলেছেন তিনি। ভোটে বিজয়ের চেয়েও চাইছেন কাঠামোগত কিছু পরিবর্তন। ঠিক এই কারণেই নির্বাচনে কেবল কনজারভেটিভ কিংবা ব্রেক্সিট পার্টি করবিনের প্রতিপক্ষ নেই, বরং দেশ-বিদেশের বহু ছোট-বড় শক্তি তাঁর বিরুদ্ধে। তাতে আছেন দেশটির অতিধনীরা, আছে ইসরায়েল—এমনকি খুদে এক প্রতিপক্ষ হিসেবে আছে বহুদূরের ভারত সরকারও।
করবিনের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বরিস জনসনের প্রতি প্রকাশ্যেই সমর্থন জানিয়ে রেখেছেন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ট্রাম্প। ‘বরিস ঠিক তা–ই, যা ব্রিটেন চায়’—আগস্টে এমনই টুইট ছিল ট্রাম্পের। ১ নভেম্বর আরেক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, করবিনের সম্ভাব্য বিজয় ‘বাজে’ বিষয় হবে। ট্রাম্পের পররাষ্ট্রমন্ত্রী গত জুনেই জানিয়ে দিয়েছেন, ‘করবিনের বিজয় ঠেকাতে যা যা দরকার, যুক্তরাষ্ট্র করবে।’
করবিনবিরোধীদের এ রকম তালিকা ক্রমে বাড়ছে এবং সবাই জোটবদ্ধ হচ্ছে। বাড়ছে বিরুদ্ধ প্রচারণার তীব্রতাও। বলা হচ্ছে, ব্রিটেনের ইতিহাসে রাজনীতিবিদ হিসেবে করবিনই সবচেয়ে বেশি বৈরী প্রচারের শিকার। এতে এ–ও প্রমাণিত হচ্ছে, সমাজসংস্কারের রাজনীতিকে অতি বেশি দুরূহ বাধা পেরোতে হয়। ‘স্থিতিশীলতা’র পক্ষের শক্তিরা সহজে পাশে পায় পরাক্রমশালীদের।
করবিন যখন ‘টেররিস্ট’
বিলিয়নিয়ারদের সংখ্যার হিসাবে ব্রিটেনের অবস্থান বিশ্বে এখন সপ্তম। এই ধনীরা আওয়াজ তুলেছেন, করবিন প্রধানমন্ত্রী হলে বাড়তি করের বোঝায় পর্যুদস্ত হবেন তাঁরা। ফলে দেশত্যাগ ছাড়া উপায় থাকবে না। ব্রিটেনবাসীকে তাই এই মুহূর্তে বিনিয়োগ প্রত্যাহার এবং কাজ হারানোর ভয় দেখানো হচ্ছে। এই দলে আছেন মিডিয়া অধিপতি রুপার্ট মারডকও।
করবিন অবশ্য কখনোই তাঁর করনীতি গোপন করেননি। অতি উচ্চ আয়ের মানুষদের সম্পদে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত করারোপের পক্ষে তিনি, যা বর্তমানের চেয়ে বেশি। করমুক্ত সম্পদসীমাও নামিয়ে আনতে ইচ্ছুক লেবার পার্টি। আর্থিক গোপনীয়তার অলিগলি বন্ধ করে সম্পদ তৈরির দুর্নীতিগ্রস্ত ‘সিস্টেম’টি বদলাতে চান করবিন। সমাজের ওপর তলার ১ শতাংশ তাঁর টার্গেট। যেসব ধনাঢ্য শ্রম শোষণ এবং পরিবেশ ধ্বংসে ইতিমধ্যে কুখ্যাত, তাঁদের ওপর চড়াও হওয়ার ইচ্ছা তাঁর। তাঁদের মধ্যে আছেন ‘স্পোর্টস ডিরেক্ট’-এর মালিক মাইক অ্যাশলে, পেট্রোকেমিক্যাল বস জিম রেটক্লিফ প্রমুখ। এই অতিধনীরা পত্রপত্রিকা, আয়কর আইনজীবী, সম্পদ ব্যবস্থাপক ও হিসাবরক্ষকের বড় বড় সমিতির মাধ্যমে গুজব ছড়াচ্ছেন, করবিনের করনীতির ভয়ে বিপুল সম্পদ অন্যত্র চলে যাবে। এই প্রচারণার পেছনে আছেন ব্রিটেনের শক্তিশালী এস্টাবলিশমেন্টের অনেকেও। এই পুরো ‘জোট’-এর কাছে দেশটি ইউরোপীয় ইউনিয়ন কীভাবে ছাড়বে, তার চেয়েও জরুরি করবিনকে ঠেকানো।
বিশ্বের অন্য অতিধনীরাও এদের পাশে আছেন নানান সম্পর্কসূত্রে। নির্বাচনে লেবার পার্টির সফলতা অন্যান্য দেশের করনীতিকে প্রভাবিত করতে পারে। বিশেষ করে এতে যুক্তরাষ্ট্রের স্যান্ডার্সপন্থীরা উৎসাহ পাবেন। করবিনের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ খুন করা তাই আন্তর্জাতিকভাবে অনেকের জন্য এখনই জরুরি। পশ্চিমের প্রভাবশালী ‘ফরেন পলিসি জার্নাল’ করবিনকে বহু আগেই ‘অ্যান্টি-ওয়েস্টার্ন-টেররিস্ট’ বলে ফেলেছে। এই ‘টেররিস্ট’ নিশ্চিতভাবে ‘ন্যাটো’র বৈশ্বিক নীতিকৌশলের জন্য বড় হুমকি!
করবিন প্রধানমন্ত্রী হলে তাঁকে কী রকম অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতার মুখে পড়তে হবে, তা কিছুটা আন্দাজ করা যায় এসব কথাবার্তা থেকে। খোদ লেবার পার্টির শক্তিশালী একটা অংশও মনে করে (টনি ব্লেয়ারের অনুসারীরা), করবিনকে সামনে রেখে আন্তর্জাতিক বৈরী প্রচারণা রোখা যাবে না।
করবিনের প্রতিপক্ষ হিসেবে ইসরায়েল ও বিজেপি
দেশের বাইরে এই মুহূর্তে করবিনের প্রধান এক প্রতিপক্ষ ইসরায়েল এবং ইসরায়েলের দূরের এক বন্ধু হিসেবে ভারতের বর্তমান সরকার। ব্রিটেনে বহু ইহুদি ও ভারতীয় আছে করবিনের সমর্থক। কিন্তু সংগঠিত শক্তি আকারে প্রভাবশালী ইহুদি লবিগুলো এবং স্থানীয় অনেক ভারতীয় সংগঠন এই নির্বাচনে করবিনের বিরোধিতার নামে ইতিমধ্যে রক্ষণশীলদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে।
ইসরায়েলের করবিনবিরোধিতার মূল কারণ ফিলিস্তিনিদের দাবিদাওয়ার প্রতি তাঁর ধারাবাহিক সমর্থন। অন্যদিকে, কাশ্মীরের মানবাধিকার প্রশ্নে ইতিবাচক অবস্থান নেওয়ায় আরএসএস-বিজেপি পরিবার তাঁর বিরুদ্ধে।
লেবার পার্টি ২৫ সেপ্টেম্বর এক দলীয় সিদ্ধান্তে কাশ্মীরে আন্তর্জাতিক পরিদর্শনের সুযোগ দাবি করেছিল। ভারত সরকারের বড় ক্ষোভের কারণ এটা। ১৫ আগস্ট ও ৩ সেপ্টেম্বর লন্ডনে ভারতের কাশ্মীরনীতির বিরুদ্ধে যে বিক্ষোভ হয়, তাতে কয়েকজন লেবার পার্টির এমপি অংশ নেন। এ–ও নয়াদিল্লিকে ক্ষুব্ধ করে। ভারত সরকারের প্রভাবে ব্রিটিশ-ইন্ডিয়ানদের অনেক সংগঠন ইতিমধ্যে এসব বিষয়ে লেবার পার্টির কাছে প্রতিবাদ জানিয়েছে। তারা বলছে, এটা ভারতের ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ’। লেবার পার্টিকে ‘অ্যান্টি-ইন্ডিয়ান’ হিসেবে অভিহিত করছে তারা।
স্থানীয় রাজনীতির জটিল সমীকরণের কারণে ভাষ্যকারদের পক্ষে ব্রিটেনের এবারের নির্বাচন নিয়ে পূর্বাভাস দেওয়া প্রায় দুরূহ। প্রথম সারির চার দলই ভালো করার আশা করছে। চারমুখী লড়াই হলে ইহুদি ও ভারতীয় ভোট কিছু আসনে জয়-পরাজয়ে ভূমিকা রাখবে। তবে ভোটের হিসাবের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো ইসরায়েল প্রভাবিত প্রচারমাধ্যমগুলো যেভাবে করবিনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে, তাতে লেবার পার্টির উদ্বিগ্ন না হয়ে উপায় নেই।
ব্রিটেনে ইহুদি জনসংখ্যা বেশি নয়, তিন লাখের মতো। সর্বোচ্চ অর্ধডজন নির্বাচনী আসনে তাঁরা ভোটার হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ। সেই তুলনায় ‘ভারতীয়’ ভোটার বেশি। তাঁরা ১০-১৫টি আসনে ফলাফল প্রভাবিত করতে সক্ষম।
যেসব আসনে লেবার পার্টি ব্রিটিশ-ইন্ডিয়ান প্রার্থী দিয়েছে, বিজেপি সমর্থকেরা সেখানে রক্ষণশীল দলকে সমর্থন দিচ্ছেন এখন। এর মধ্যে আবার লেবার পার্টির শিখ প্রার্থীদের বিরুদ্ধে বিজেপি সমর্থকেরা বেশি সক্রিয়। ব্রিটিশ-ভারতীয়দের একাংশের করবিনবিরোধী ভূমিকার পেছনে ইসরায়েলের সঙ্গে মোদি সরকারের সখ্যের প্রভাবও কাজ করছে বলে ধারণা করা হয়।
ব্রিটেনে প্রায় ১৪ লাখ ভারতীয় রয়েছেন। সাড়ে চার কোটি ভোটারের দেশে এ সংখ্যা সামান্যই। তবে যুদ্ধ ক্রমে চতুর্মুখী রূপ পাওয়ায় নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘুরা ভোটে মনোযোগ পাচ্ছেন বেশি।
সম্মিলিত এক নোংরা প্রচারযুদ্ধ
ইসরায়েলের মানবতাবিরোধী ভূমিকার কারণে দেশটিতে অস্ত্র বিক্রির বিপক্ষে এবং ফিলিস্তিনিদের নিজ ভূমিতে ফেরার পক্ষে সমর্থন দেওয়ায় লেবার পার্টি ক্রমাগত ইসরায়েল প্রভাবিত প্রচারমাধ্যমের বিদ্বেষের শিকার হচ্ছে।
করবিন স্পষ্টই জানিয়েছেন, ক্ষমতায় এলে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেবেন। বহুদিন থেকে তিনি গাজায় ইসরায়েলের ভূমিকাকে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে দেখছেন। এর প্রতিশোধ হিসেবে এখন প্রচার শুরু হয়েছে, করবিন প্রধানমন্ত্রী হলে ইহুদিরা ব্রিটেনে থাকতে পারবেন না। এই প্রচার অনেকাংশে সফলও। লেবার পার্টির এমপিদের অন্তত একজন ইহুদি সদস্যের (এল ইলমান) পদত্যাগের ঘটনাও ঘটেছে। সব মিলিয়ে ইসরায়েলের করবিনবিরোধিতা ইতিমধ্যে খোলামেলা এক নোংরা যুদ্ধে পরিণত হয়েছে। ব্রিটেনের অনেক ‘রাব্বি’ও এই যুদ্ধে শামিল।
পত্রপত্রিকার পাশাপাশি বই-পুস্তক লিখেও প্রমাণ করা হচ্ছে, করবিন কতটা ইহুদিবিদ্বেষী। বিষয়টা এমনভাবে দেখানো হচ্ছে, ফিলিস্তিনিদের মানবাধিকারের পক্ষে থাকা মানেই ইহুদিবিদ্বেষী হয়ে যাওয়া। প্রায় একই সূত্র মেনে দেখানো হয়, কাশ্মীরি শিশুদের পক্ষে কথা বলা মানেই অ্যান্টি-ইন্ডিয়ান হয়ে যাওয়া!
ব্রিটেনের ইনডিপেনডেন্ট পত্রিকা একদা জরিপে (১৯ জুলাই ২০১৬) দেখিয়েছিল, করবিনকে নিয়ে করা প্রতিবেদনগুলোর ৭৫ শতাংশেই অসত্য তথ্য তুলে ধরে। ২০১৫ সালে লেবার পার্টির মুখ্য নেতা নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে তাঁকে ‘টার্গেট’ করার সেই ধারাবাহিকতা এখনো বদলায়নি, বরং বেড়েছে। গাজার ‘হামাস’ এবং লেবাননের ‘হিজবুল্লাহ’ সমর্থক দেখিয়ে ইসরায়েল এখন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আরজি জানাচ্ছে, করবিনকে যেন ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
ব্রিটেনের নির্বাচনের উক্ত পরিস্থিতির বার্তাটি স্পষ্ট। অতিধনী ও কর্তৃত্ববাদী শক্তিগুলো যখন বিশ্বজুড়ে নিজেদের স্বার্থের পক্ষে যৌথভাবে প্রভাববলয় বাড়াতে সক্রিয়, তখন সামাজিক ন্যায়বিচার ও মানবিক মুক্তির লক্ষ্যে কাজ করা শক্তিগুলোকেও আন্তর্জাতিক মৈত্রী শক্তিশালী না করে উপায় নেই।
যুক্তরাষ্ট্রে বার্নি স্যান্ডার্সের সংগ্রাম এবং যুক্তরাজ্যে করবিনের লড়াই বৈশ্বিক সংহতি দাবি করছে। কারণ, তাঁদের আদর্শের বিজয় বিশ্বকে কাঠামোগতভাবে পাল্টে দিতে পারে।
আলতাফ পারভেজ: গবেষক