জনপ্রিয় সিনেমারও রাজনীতি আছে। পপুলার সিনেমার রাজনীতি চলে ইমেজের মাধ্যমে, ইমেজই সেখানে আইডিয়ার কাজ করে। এসব সিনেমায় আজগুবি ও রংচড়ানো দৃশ্য থাকবেই। সেসব সমস্যা নয়। তবে সেসবের কৌশলে এক্সট্র্যাকশনে কোন বাংলাদেশের আইডিয়া ফুটেছে, তা ভালো করে দেখা দরকার। এক্সট্র্যাকশনে একটা গুরুতর ইঙ্গিত আছে। বিনোদনের সিনেমার কাছে কেউ সত্য আশা করে না, কিন্তু যত আজগুবিই হোক, জনপ্রিয় বাণিজ্যিক সিনেমায় কোনো না কোনো পক্ষের 'দেখা' থাকে। সেই 'দেখা'র ধাঁধার বিশ্লেষণে অনেক সময়ই সত্যটা পাওয়া যায়। এক্সট্র্যাকশনের নির্মাতা, গুণগ্রাহীদের কাছে এর অবদান, বাংলাদেশের নতুন পরিচয় নির্মাণ।
২০০৪ সালে বানানো বাটারফ্লাই ইফেক্টে এক লাইনে বাংলাদেশি কৃষকের কথা আছে; কারণ, তারা জানত এটা মূলত কৃষিপ্রধান দেশ। ২০০১ সালের 'জ্যুলান্ড্যার' সিনেমায় বাংলাদেশকে পরিচিত করানো হয়েছে শিশুশ্রমিকের দেশ হিসেবে। কোন প্রসঙ্গে জানেন? ঠিক ধরেছেন, আমাদের জাতীয় গর্ব পোশাকশিল্পের বর্ণনায়। ২০১৮ সালের ব্লকবাস্টার মুভি 'অ্যাভেঞ্জারস: এইজ অব আলট্রন'-এ চট্টগ্রামের জাহাজভাঙা শিল্পের দৃশ্য ব্যবহৃত হলেও বাংলাদেশের নাম আসেনি। হলিউড অদ্ভুত, চিত্তকাড়া, অসম্ভব সব লোকেশন খুঁজতে খুঁজতে ২০২০-এ সরাসরি বাংলাদেশে এসে হাজির অ্যাট্রাকশন সিনেমায়। তাই করোনার এই সময়েও অনেক তরুণ এক্সট্র্যাকশনের 'বাংলাদেশ' দেখে শিহরিত, অনেকে চূড়ান্ত বিরক্ত।
অনলাইন সিনেমাঘর নেটফ্লিক্সের সিনেমা 'এক্সট্র্যাকশন'। নেটফ্লিক্সের যাবতীয় সিনেমার রেকর্ড এই ছবি ভেঙেছে। অন্য কারণেও এটা রেকর্ডে থাকবে; এই সিনেমার মূল ভিলেন বাংলাদেশি এবং কাহিনির রঙ্গমঞ্চ হিসেবে বাংলাদেশও স্বনামেই উপস্থিত। বাংলাদেশিদের কাছেও এটা বিশেষভাবে মনে থাকবে। এই সিনেমায় হলিউডের 'বাংলাদেশ দর্শন' অনেকটা সংজ্ঞায়িত হয়ে গেছে মাফিয়া এবং তাদের শিশুসেনাদের রাজত্ব হিসেবে। চোখের মজা নিলেও তাই বাংলাদেশিরা অনেকে লিখে ও বলে তাঁদের মনের জ্বালা প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশের এই পরিচয় বাংলাদেশিদের কাছে ভালো লাগার কথা নয়। কিন্তু বাস্তবের মতোই সিনেমার সত্যও কঠিন, মনের জ্বালা একপাশে রেখে সেই সত্য দর্শন করাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ।
এক্সট্র্যাকশন একটা ডিসট্র্যাকশন ও ডেস্ট্রাকশনও বটে। করোনায় ঘরবন্দী দক্ষিণ এশিয়ার বিস্তর মধ্যবিত্ত তরুণের কাছে এই সিনেমা একটা ডিসট্র্যাকশন—কাঁহাতক আর করোনাময় থাকতে ভালো লাগে? কিছুটা সময়ের জন্য অনেকের মনোযোগ অন্যদিকে সরানোয় এই সিনেমা সফল। আর ডেস্ট্রাকশন বা ধ্বংসই হলো এর আসল কাহিনি—রাষ্ট্রের ধ্বংস।
সিনেমা ও খবর দিয়ে দেশের ভাবমূর্তি তৈরি হয় আজকের যুগে—যেমন ভারত বা যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি অনেকটা নিজ নিজ দেশের বিনোদন ইন্ডাস্ট্রির অবদান। এদিকে বাংলাদেশ 'তলাহীন ঝুড়ির দেশ', 'ঝড়-বন্যার দেশ', 'কৃষিপ্রধান দেশের' পরে 'দ্য ইকোনমিস্ট' পত্রিকার চোখে হয়েছিল 'দ্য নেক্স্ট আফগানিস্তান'—জঙ্গি উপদ্রুত দেশ। এক যুগ আগের সেই লেবেল 'হোলি আর্টিজানের' ঘটনার পর আরও জোরদার হয়। আমরা যতই উন্নয়নের বিলবোর্ডে দেশ ছেয়ে ফেলি, সমস্যাজনক দেশ হিসেবে আমাদের দেখিয়ে আসছে হলিউড-বলিউড। তারপর কিছুকাল হাওয়া মোটামুটি স্বাস্থ্যদায়কই ছিল। বাংলাদেশের 'উন্নতি' 'মিরাকল' বলে প্রচারিত হলো পশ্চিমা গণমাধ্যমে। অমর্ত্য সেন বাংলাদেশের মানুষের জীবনমানের উন্নতি নিয়ে পঞ্চমুখ হলেন। কিন্তু বাড়া ভাতে ছাই দিয়ে দিল 'অ্যাট্রাকশন'। জ্যুল্যান্ডার প্রভৃতি সিনেমায় শিশুশ্রমিকের দেশের বিবর্তন এখানে হয়েছে শিশুসন্ত্রাসীদের দেশ হিসেবে। ঢাকাই বড়লোকের শানশওকত, অট্টালিকা, দামি গাড়ি না দেখিয়ে শহর ভরা পোশাকশ্রমিক আর কিশোর অপরাধী দেখিয়ে ভারতীয় ও পশ্চিমা দর্শকদের কাছে সেটা নিশ্চিত করা হয়েছে।
যাঁরা দেখেননি তাঁদের জন্য গল্পের স্কেচটা এ রকম: মুম্বাইয়ের মাফিয়া লর্ডের ছেলেকে অপহরণ করেছে ঢাকার মাফিয়া লর্ড। তাকে উদ্ধারের জন্য অস্ট্রেলিয়া থেকে ভাড়া করা হয় টাইলার নামের এক ভাড়াটে কমান্ডোকে। ঢাকায় এসে একাই ধাপাধাপ মাফিয়া বাহিনী, পুলিশ, এলিট ফোর্স, সামরিক বাহিনীকে কচুকাটা করার পর টাইলার জানতে পারে, মাফিয়াপুত্রকে উদ্ধারের জন্য চুক্তিমাফিক টাকা সে পাবে না। মাঝখানে বাগড়া দিয়েছে মুম্বাইয়ের মাফিয়ার স্যাঙ্গাত। নৈরাজ্যময় এক শহরের গলি-ঘুপচি-নর্দমা আর গরিব মানুষের জাহান্নামের মধ্যে বহুমুখী লড়াই করে টাইলার মাফিয়াপুত্র অভিকে নিরাপদে পাঠাতে পারলেও নিজে মারা যায় এক ঢাকাই কিশোর সন্ত্রাসীর গুলিতে। কাঁচপুরের কাছের সুলতানা কামাল সেতুতে যাবতীয় অ্যাকশন সেরে তার গুলিবিদ্ধ দেহ গিয়ে পড়ে বাংলার নদীতে।
এই ছবির একটা বার্তা খুব ভালো লেগেছে। সুলতানা কামাল সেতুতে ঝোলানো দীর্ঘ ব্যানারে লেখা: নদী বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে। পানি ভালোবাসা টাইলারের দেহ যে এই নদীতে পড়ে, সেটাও এক সুন্দর দৃশ্য।
সভ্য জীবনের জন্য জাহান্নাম এই ঢাকায় চলে এক মাফিয়া রাজত্ব। মাফিয়া রাজত্বকে আর যা-ই হোক, রাষ্ট্র বলা চলে না। এক্সট্র্যাকশনের এই বাংলাদেশের সঙ্গে মিল কেবল রাষ্ট্র ভেঙে পড়ার সময়ের সোমালিয়ার সঙ্গে। 'এক্সট্র্যাকশন' তাই গভীরভাবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রহীনতার গল্প। রাষ্ট্র এখানে লাপাত্তা। এই বাংলাদেশের সীমান্ত ঝাঁজরির মতো শত ছিদ্রময়। ভারতীয়-অস্ট্রেলীয় মাফিয়া-মার্সেনারির জন্য এই সীমান্ত দিয়ে যাওয়া-আসা ওয়ান-টুর ব্যাপার। এর আকাশে অবলীলায় বিদেশি সন্ত্রাসীদের হেলিকপ্টার ওড়ে; তারা আবার গুলিও করে। এর নৌপথে হেলেদুলে চলে মাফিয়াদের নৌযান। ওই যে বাংলাদেশ দেখলাম, তার সব বাহিনীর বেশুমার লোককে মাত্র একজন ভাড়াটে বন্দুকবাজ (টাইলার) পাখির মতো টপাটপ গুলি করে মারে, কুমড়ার মতো ছুরি দিয়ে কাটে। কোই মুশকিল নেহি। এই দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাবান লোকটি একজন ড্রাগসম্রাট। পুলিশ, এলিট বাহিনী, মিলিটারি—সব তার কথায় চলে, সে চাহিবামাত্র দেশটির রাজধানী লকডাউন করে দেওয়া যায়, সেতুতে সেতুতে গণতল্লাশি চলে। বিপরীতে ভারতীয় ড্রাগসম্রাট জেলে থাকে, জেল থেকে কাজ চালাতে পারলেও ভারতীয় আইন যে তার চাইতে শক্তিশালী, সেটা বোঝানো হয়।
পশ্চিমা শ্বেতাঙ্গ যোদ্ধাদের এই অসম্ভব বীরত্বই দেখানো হতো আশির দশকের র্যাম্বো মুভিতে। আফগানিস্তান, কম্বোডিয়ার মতো দেশে র্যাম্বো যেভাবে সুপারম্যানের মতো মিশন চালাত, তা ভিয়েতনাম যুদ্ধে পরাজিত যুক্তরাষ্ট্রের অপরাজেয় 'ভাব' ধরে রাখায় কাজে লাগত। র্যাম্বোর কাছে আফগানিস্তানের যেভাবে হার হতো, অ্যাট্রাকশন সিনেমার নায়ক টাইলারের কাছে বাংলাদেশেরও তেমন হার হয়। টাইলার একই দেহে র্যাম্বোর মতো রাষ্ট্রবিধ্বংসী আবার ভাড়াটে খুনি হলেও তার হৃদয় মাসুদ রানার। যত সমালোচনাই থাক, টাইলার-সাজুর মতো 'অপরাধী'র হাতে কোনো দেশের জাতীয় বাহিনীগুলোর ইউনিফর্মের এমন অপমান সে দেশের মানুষের ভালো লাগার কথা নয়।
এক্সট্রাকশনের বাংলা হলো নিষ্কাশন, উদ্ধার অর্থেও ব্যবহৃত হয় শব্দটি। এই সিনেমায় রাষ্ট্র বাংলাদেশ নিষ্কাশিত এবং উদ্ধারকৃত হলো শিশু অভির 'ইনোসেন্স'। অভিজ্ঞ টাইলার শিশুকে উদ্ধার করলেও নিষ্কাশিত করে নিয়েছেন বাংলাদেশের ইমেজ। সব অর্থেই।
টাইলার চরিত্র বানানো হয়েছে ব্রিটিশ লেখক এ জি কুইনেলের 'ম্যান অন ফায়ারের' নায়ক আর র্যাম্বোর মিশেলে। মাসুদ রানা সিরিজের 'অগ্নিপুরুষ', হুমায়ূন আহমেদের 'অমানুষ'ও ম্যান অন ফায়ারের ছায়ায় লেখা। ম্যান অন ফায়ারে এক দেহরক্ষী মাফিয়ার অপহৃত কিশোরী কন্যাকে অন্য মাফিয়ার কবল থেকে বাঁচাতে না পেরে শীর্ষ মাফিয়া নেটওয়ার্ক ধ্বংস করে দেয়, টাইলারও সেটাই করে। এই বীরত্বই তার আকর্ষণ। এহেন অগ্নিপুরুষ ভারতীয় ড্রাগসম্রাটের পুত্রস্নেহে কাতর, তার স্যাঙ্গাত সাজু বাংলাদেশিদের হাতে জীবন দেওয়া বীর, সব নষ্টের গোড়া কেবল হিন্দি সিরিয়ালের কায়দায় চলাফেরা করা বাংলাদেশি ভিলেন, তার অনুগত বিভিন্ন ইউনিফর্ম পরা বাহিনী এবং কিশোর সন্ত্রাসীদের দঙ্গল। বলা বাহুল্য, টাইলার ভাড়াটে খুনি হয়েও অনেক মানবিক। অথচ বাংলাদেশিদের সবই খারাপ। তারা বস্তিতে থাকে, নোংরা ঘিঞ্জি রাস্তায় ঘোরে, ঘরে ঘরে হিন্দি গান বাজে, তারা অপহরণ-গুম এসব করে, তাদের বাহিনীগুলো ড্রাগসম্রাটের হুকুম তামিলে একপায়ে খাড়া।
মুসলমানেরা রাষ্ট্র চালাতে পারে না, তারা অনেক সন্তান পয়দা করে, তাদের অর্থনীতি ক্রিমিনাল অর্থনীতি, তাদের দেশ বসবাসের অনুপযোগী, তাদের নেতারা বালখিল্য মাফিয়া, মানুষের বিন্দুমাত্র মর্যাদা সেখানে নেই—বর্ণবাদী ইসলামোফোবিক নকশার সব উপাদানই এক্সট্র্যাকশনে আছে। এই বাংলাদেশের রং মরুভূমির মতো হলুদ, বিপরীতে মুম্বাইয়ের দৃশ্যগুলো হালকা ফিরোজা রঙের আলোয় ভরা, পরিপাটি, সুন্দর এবং বিলাসবহুল। মুম্বাইয়ের মাফিয়া সন্তান স্নেহে কাতর, টাইলারও অকালপ্রয়াত সন্তানের মৃত্যুর শোক বুকে বহন করে চলে। আনায়ক আর আধাখলনায়ক সাজুরও সুন্দর স্ত্রী-সন্তান থাকে। এসব মসলা সিনেমায় আপাত নিষ্ঠুর মানুষের প্রতি মানবিক টান তৈরির কৌশল। কিন্তু বাংলাদেশি ভিলেইন শতভাগ ভিলেইন, সে শিশুঘাতক ও নরপশু। তার তৈরি করা নারকীয় বাংলাদেশে ভারতীয় কিশোর বন্দী। তাকে উদ্ধারে বিশেষ অভিযান চালায় অস্ট্রেলীয়-আমেরিকান-ভারতীয় বেসরকারি বাহিনী। বীরত্ব তাদের, মানবিকতা তাদের, রংঢংও তাদের। মাফিয়াপুত্র হলেও অভি এক সুশ্রী, বুদ্ধিমান, মানবিক, স্বাভাবিক ও সাহসী কিশোর। আর বাংলাদেশের কিশোরেরা ড্রাগ বেচে, অস্ত্র ধরে, মাফিয়ার হয়ে বন্দুকবাজি করে।
গত এক যুগে বাংলাদেশে গুম, অপহরণ, মাদক ব্যবসা, কিশোর অপরাধ, বিচারহীনতা, নিষ্ঠুরতার যেসব খবর আমরা গণমাধ্যমে পাই, অ্যাট্রাকশন কি তার সিনেমাটিক উপস্থাপন নাকি পুরোটাই কল্পনা। শুধু সমালোচনা করে লাভ কী, যদি-না আমরা নিজেদের বাস্তবতা ও সিনেমাটিক উপস্থাপনাকে আমাদের মতো করে করতে না পারি?
এক্সট্র্যাকশনে বাস্তবতা বিকৃত করে দেখানো হলেও তার ভেতরের সত্যটা কি অস্বীকার করা যায়? এই সিনেমায় দেখানো বাস্তবতা কি আমাদের ভবিষ্যৎ, নাকি বর্তমান? পাঠক ও দর্শকদের প্রতি এই প্রশ্নটা তোলা রইল।
ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
faruk.wasif@prothomalo.com