ভাষা আন্দোলনের সূত্র ধরেই শুরু হয় ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের জোয়ার। এটি থাকতে পারত ভাষা, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিন্তু পাকিস্তানের শাসকেরা আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছে যে তারা বাঙালিদের সমমর্যাদার নাগরিক হিসেবে মূল্য দেবে না। তারা শাসকগোষ্ঠী আর বাঙালি থাকবে শাসিত গোষ্ঠী হয়ে। তাই বাঙালি পাকিস্তানের কাঠামোয় হয়েছে বঞ্চিত, উপেক্ষিত এবং নিপীড়িত। ফলে অচিরেই ভাষাভিত্তিক সাংস্কৃতিক চেতনা বাঙালি জাতীয়তাবাদী অনুপ্রেরণায় রূপ লাভ করেছে।
এই ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতির চেতনার সামগ্রিক জাতীয়তাবাদী চেতনায় রূপ লাভের পেছনে কার্যকর ছিল বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা এবং এই রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে তাঁর আপসহীন অবিরাম আন্দোলন। সরকার অনেক চেষ্টা করেও বাঙালির এই জাগরণ ঠেকাতে পারেনি। এই আন্দোলনের নেতা মুজিবকে বারবার গ্রেপ্তার, কারাবন্দী করা ও অসংখ্য মামলায় জর্জরিত করা সত্ত্বেও জাগ্রত বাঙালি পিছু হটেনি। কেবল বঙ্গবন্ধু নয়, সেদিন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও জেলা পর্যায়ের প্রথম সারির সব নেতাকেই গ্রেপ্তার করে জেলে বন্দী রাখা হয়েছিল। কিন্তু তাতেও বাঙালির স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের গতি কমেনি, বরং তা বাঁধভাঙা জোয়ারে প্রবল থেকে প্রবলতর হয়েছে। তাদের জাগরণ, দলমত–নির্বিশেষে বৃহত্তর ঐক্য গঠন এবং একক নেতা হিসেবে শেখ মুজিবকে সামনে রেখে স্বাধীনতার জন্য জানপ্রাণ লড়াই করার দৃঢ়সংকল্প পরিস্থিতি পাল্টে দেয়। তার পরের ইতিহাস সবার জানা—বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করল।
স্বাধীন বাংলাদেশে স্বভাবতই রাষ্ট্রভাষা বাংলা হলো, সরকারি কাজকর্ম চলছে বাংলায়, সংবিধান রচিত হলো মাতৃভাষায়। স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সর্বস্তরেই বাংলা হলো শিক্ষার মাধ্যম। পরিভাষা তৈরি ও পারিভাষিক অভিধান রচনার কাজও শুরু হলো। স্বাধীনতার পরে আনন্দময় অভিজ্ঞতা ছিল তেল কোম্পানি এবং ব্যাংকগুলোর নামের রূপান্তর দেখা। তেল কোম্পানি তিনটির নাম হলো পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা। আর প্রধান ছয়টি ব্যাংকের ইংরেজি নাম বদলে নতুন বাংলা নাম রাখা হলো—সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, পূবালী, উত্তরা। এর সঙ্গে সাযুজ্য রেখে মানুষ অফিস ও দোকানের নামেও আনল পরিবর্তন—সর্বত্র চলছিল বাংলা ভাষার জয়জয়কার। উনসত্তরের গণজাগরণ থেকেই শুরু হয়েছিল নবজাতক সন্তানের নাম বাংলায় রাখা। তারপরেই ঘটল ছন্দপতন। ১৯৭৫-এর আগস্ট ও নভেম্বরের মর্মান্তিক নির্মম হত্যাযজ্ঞ ছিল আদতে বাঙালি জাতীয়তাবাদের রথে চেপে উড়তে থাকা জাতিকে প্রত্যাখ্যাত পাকিস্তানি পশ্চাত্পদ রাজনীতির চোরাবালিতে নামিয়ে আনার ষড়যন্ত্র।
তাদের ষড়যন্ত্র তখনকার মতো সফল হয়েছিল। এ সময় যারা ক্ষমতায় এসেছিল, মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমানসহ তারা কেউই বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী ছিল না। ফলে এ সময় থেকে ইংরেজি মাধ্যম স্কুল চালু হলো, দোকানপাট-অফিসের নামে ইংরেজি ফিরতে শুরু করল। পাশাপাশি সমাজজীবনে আরবি সংস্কৃতির প্রভাব বাড়ানোর কাজও শুরু হয়। ভাষা আন্দোলনের ফসল বাংলাদেশে জামায়াত-বিএনপির রাজনৈতিক ক্ষমতার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হলো, তা দিনে দিনে জোরদারও হলো, কিন্তু একুশে ফেরুয়ারিকে ঘিরে ওই এক মাস এবং পয়লা বৈশাখকে ঘিরে কয়েক দিন ছাড়া মাতৃভাষা-সংস্কৃতির বিষয়ে তেমন সচেতনতা বা বাঙালিপ্রীতির প্রকাশ দেখা গেল না।
আরেকটু পরে গত শতকের নব্বই দশকে এসে বিশ্বায়ন ও বাজার অর্থনীতির প্রবল অভিঘাত এসে লাগল আমাদের উন্নয়নশীল দেশের ওপর। একদিকে এর প্রভাবে ইংরেজি ভাষা ও ইংরেজিয়ানার প্রভাব বাড়তে থাকল, আর অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার আরবিভাষী মুসলিমপ্রধান বিভিন্ন দেশে সমাজের নিম্নবর্গের বিপুল মানুষের অভিবাসী শ্রমিক হিসেবে বসবাসের ফলে তাদের মাধ্যমে সমাজে ছড়াল আরবি পোশাক ও আরবি-ইসলামি রক্ষণশীলতার প্রভাব। দেশের ধর্মীয় রক্ষণশীল দলগুলোও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় এই আরবি সংস্কৃতির বিস্তার ও ইসলামের রক্ষণশীল গোঁড়া ধারাকে শক্তিশালী করার কাজে নিয়োজিত হয়।
আমরা লক্ষ করলাম দেশের সর্বত্র একদিকে ইংরেজি মাধ্যম ও ইংরেজিয়ানার সবল-দুর্বল অনুসারী স্কুলের প্রসার ঘটেছে, আর অন্যদিকে নানা ধারার মাদ্রাসা—যার মধ্যে ক্যাডেট নামধারীও আছে—বেড়ে চলেছে। সরকারের কাজে এবং সামাজিক জীবনে ক্রমেই প্রকট হয়ে বোঝা যাচ্ছে এ দেশটি নানা ধর্মের অসাম্প্রদায়িক উদার মানবিক বাঙালির নয়, কেবল মুসলিম বাঙালির দেশ। এ বাস্তবতায় সংখ্যালঘুদের মধ্যেও ধর্মীয় গোঁড়ামি ও ধর্মীয় পরিচয় মুখ্য হয়ে উঠতে শুরু করেছে।
আজকের বাংলাদেশে ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে বাংলা একাডেমির বইমেলা কেবল সফলভাবেই আয়োজিত হয় না, প্রতিবছর এর কলেবর বাড়ছে, বই বিক্রিও বেড়ে চলেছে, লেখকের সংখ্যা বেড়েছে, ক্রেতার সংখ্যাও তাল রেখে বেড়ে চলেছে। কেবল সন্দেহ জাগে পাঠক নিয়ে। সাধারণভাবে মানুষের পাঠাভ্যাস কমতে দেখা যাচ্ছে। তরুণ-কিশোরেরা তো নতুন প্রযুক্তিতে আসক্ত হয়ে পড়েছে। তাই এ বিষয়টি ধোঁয়াশাতেই রয়েছে।
এখন জেলায় জেলায়ও বইমেলা হচ্ছে, এমনকি অনেক জেলায় স্থানীয় প্রকাশক ও লেখকেরাও বেশ তত্পর আছেন। এ মাসে মুদ্রণ ও বৈদ্যুতিন মাধ্যমের লেখা ও অনুষ্ঠানে ভাবাবেগের প্রকাশ দেখে কে বলবে যে দেশের উচ্চ থেকে মধ্যবিত্ত সব পরিবারই সন্তানদের ইংরেজি মাধ্যমেই পড়াচ্ছেন! নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের কর্তারাও বড় ঝুঁকি নিয়ে ইংরেজি স্কুলেই ছুটছেন। এমনকি দেশের লেখক-বুদ্ধিজীবী, প্রগতিশীল শিল্পী-সাহিত্যিকদের পরিবারেও তো একই ধারা চলছে।
ইতিপূর্বে আমরা অনেকেই বারবার লিখেছি যে শৈশব থেকে কেবল ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করলে সন্তানদের মধ্যে সাংস্কৃতিক সংকট তৈরি হতে বাধ্য। কারণ, সংস্কৃতি বা জীবনচর্যার ভাবগত ও ব্যবহারিক সব বিষয়ের কেন্দ্রে থাকে দুটি মূল উপাদান—ভাষা ও ঐতিহ্য। এই দুটি উপাদান যদি তাদের আয়ত্তে না থাকে, তবে তাদের স্বদেশচেতনা ও ভালোবাসা হবে অনেকটাই বায়বীয়, ভাসমান। যার ফলে নিজস্ব ঐতিহ্য ও ভাষাসম্পদের ভূমি থেকে পুষ্টি সংগ্রহ হবে বাধাগ্রস্ত, তাদের বিকাশ হবে ক্ষুণ্ন। এমনিতেই বর্তমান সময়ে সামগ্রিকভাবে বিশ্বজুড়ে মানবিক সংস্কৃতির বিরাট সংকট চলছে। এর মধ্যে যাদের নিজের সংস্কৃতির মৌলিক উপাদানের সঙ্গে সংযোগ থাকে না অথবা তা হয় দুর্বল, তাদের বিকাশ বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কাই বেশি।
এটা ঠিক, আজ আমরা এক বিশ্বপল্লিতেই বাস করছি অর্থাৎ সবাই বিশ্বনাগরিক হয়ে উঠছি। তাই এটাও স্বাভাবিক যে এখনকার শিশুরা মাতৃভাষা বাংলা ও আন্তর্জাতিক ভাষা ইংরেজি শিখবে অর্থাৎ তারা দ্বিভাষিক নাগরিক হবে। কিন্তু ইংরেজি তারা শিখবে বাংলার সঙ্গে পরিপূরক ভাষা হিসেবে, কোনো অবস্থাতেই বাংলা ভাষার বিনিময়ে নয়। ভালো বাংলা এবং ভালো ইংরেজি শেখা শিশুর জন্য অসম্ভব কোনো কাজ নয়। আদতে আমাদের মনে রাখতে হবে আজকের প্রযুক্তিনির্ভর এ জীবনে বিজ্ঞানের জ্ঞান হওয়া চাই পাকা, তাই একালের শিক্ষার্থীদের গণিতটাও খুব ভালোভাবে জানতে হবে, কেননা এ হলো বিশুদ্ধ বিজ্ঞানের ভাষা।
তাহলে ভাষা আন্দোলনের এই দিনে আমাদের অঙ্গীকার হতে পারে যে জাতি হিসেবে আমরা তিনটি ভাষাতেই দক্ষতা অর্জন করব—বাংলা, ইংরেজি ও গণিত। আর আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য লালন ও চর্চার ওপর জোর দিতে হবে, যাতে শিক্ষার বাতাবরণটি হয় বাঙালি সংস্কৃতির সমৃদ্ধ ঐতিহ্যে নির্মিত, তার সঙ্গে বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মিলন হলে তা হবে উত্কৃষ্ট পথ। এ কাজ শিক্ষার গোড়া থেকেই শুরু করলে শিশুর সুষ্ঠু বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ নিশ্চিত হবে। আধুনিক অগ্রসর জাতি গঠনে এটাই হতে পারে উপযুক্ত পথ। আমরা জানি, মান বজায় রেখে ভাষা শিক্ষার জন্য উপযুক্ত শিক্ষকের সহযোগিতা চাই, প্রয়োজন প্রতিটি ভাষা চর্চার উপযুক্ত পাঠ ও অনুশীলনসামগ্রী।
দেশ শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং জাতি গঠনের যে ক্রান্তিকাল তথা কঠিন সংকটকালে আছে তা কেবল একুশের প্রাণের মেলার নামে আবেগ-উচ্ছ্বাসে ভেসে কাটিয়ে ওঠা যাবে না। তার জন্য বাংলা ভাষার প্রাধান্য বজায় রেখে বাঙালি সংস্কৃতির বাতাবরণে আন্তর্জাতিক প্রযুক্তিদক্ষ যুক্তিবাদী সমকালীন নাগরিক গড়ার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। আজকের পরিবর্তিত বাস্তবতায় বায়ান্নর ৬৮ বছর পরে, এ পথেই হয়তো আমরা একুশের চেতনাকে এর রাজনৈতিক–সাংস্কৃতিক প্রণোদনাসহ এগিয়ে নিতে পারব।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক