প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছে যা ‘সত্য’, তা যিনি ‘মিথ্যা’ প্রতিপন্ন করেন, তাঁর হাল কেমন হতে পারে? গত সপ্তাহে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের সরকারি বাসভবনে শাসক দলের হামলা এর একখণ্ড নমুনা। পুলিশি উপস্থিতির তোয়াক্কা না করে বিজেপির শ দুয়েক কর্মী-সমর্থকের এহেন তাণ্ডব রাজধানীতে বিরল। এমন ধরনের বিক্ষোভ-অভিযানের আঁচ পেলে পুলিশ আগেভাগে ব্যবস্থা নেয়। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ঘটার কারণ প্রথমত, বিক্ষোভ বিজেপির, দিল্লি পুলিশ যার আজ্ঞাবহ এবং দ্বিতীয়ত, যাঁর বিরুদ্ধে রাগ, ইদানীং তিনি নিজেকে মোদির চ্যালেঞ্জার হিসেবে তুলে ধরতে সচেষ্ট।
বিবাদ ও বিতর্কের মূলে দ্য কাশ্মীর ফাইলস, যে সিনেমা নিয়ে ইদানীং বিজেপি উদ্বাহু নৃত্য করছে। সিনেমার নির্যাস, নব্বইয়ের দশকে কাশ্মীর উপত্যকায় হিন্দু পণ্ডিতদের অকথ্য নির্যাতন ও বিতাড়ন, যার জন্য দায়ী স্রেফ মুসলমানরা! সিনেমার নির্মাতা ও কুশীলবদের বাসভবনে ডেকে প্রধানমন্ত্রী কাশ্মীরি পণ্ডিতদের ঠাঁইনাড়া হওয়ার ‘সাহসী দলিল’ তৈরির জন্য শাবাশি জানিয়ে বলেছেন, ‘এটাই কাশ্মীরের সত্য। এই সত্য বহু বছর চেপে রাখা হয়েছিল। আজ উদ্ঘাটিত।’
প্রধানমন্ত্রীর সার্টিফিকেট পাওয়ামাত্র কালক্ষেপ না করে সব বিজেপিশাসিত রাজ্য সিনেমাটিকে বিনোদন করমুক্ত করেছে। অত্যুৎসাহী মুখ্যমন্ত্রীরা সিনেমা দেখতে সরকারি কর্মীদের ছুটি মঞ্জুর করেছেন। চাপ সৃষ্টি হয়েছে অবিজেপি রাজ্যগুলোর ওপর করমুক্তির জন্য। কেজরিওয়াল মানেননি। বরং বিজেপির দাবি নস্যাৎ করে বিধানসভায় যা বলেছেন, তা জলবিছুটির ঝাপটা। রাগের কারণও তা। তাই পরিকল্পিত হামলা।
কী বলেছিলেন কেজরিওয়াল? প্রথমে তীব্র কটাক্ষ। ‘ট্যাক্স ফ্রি করার দাবি উঠছে সবাই যাতে কম টাকায় সিনেমাটা দেখতে পারে। সেটাই যদি উদ্দেশ্য, তাহলে ইউটিউবে আপলোড করে দিলেই তো হয়? দূরদর্শনও দেখিয়ে দিক? সবাই বিনা পয়সায় দেখতে পাবে?’ কটাক্ষের পর ছিল বোলতার হুল। কেজরিওয়াল বলেন, ‘একটা লোক কাশ্মীরি পণ্ডিতদের জ্বালা, যন্ত্রণা, দুর্দশা দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা কামাচ্ছে আর আপনারা সেই “মিথ্যা” ছবির পোস্টার সাঁটছেন! দুর্ভাগ্য!’
কেজরিওয়াল ‘মিথ্যা’ শব্দটি ভেবেচিন্তে বলেছেন, যেহেতু ‘সত্য’ সার্টিফিকেট খোদ প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া। সত্য-মিথ্যার এই রাজনৈতিক কচকচানির মধ্যে একমাত্র নির্ভেজাল ‘সত্য’, ২০ কোটি টাকায় তৈরি দ্য কাশ্মীর ফাইলস ইতিমধ্যেই ২০০ কোটির ক্লাবে ঢুকে পড়েছে। লক্ষ্মীর কৃপা পাওয়ার পাশাপাশি পরিচালক বিবেক অগ্নিহোত্রী শাসকপ্রিয়ও হয়ে উঠেছেন! ভাগ্য বটে!
ভূস্বর্গ থেকে কাশ্মীরের ‘অশান্ত’ হওয়ার ইতিহাসের একটি দুঃখজনক অধ্যায় অবশ্যই পণ্ডিতদের ভিটে ছাড়ার কাহিনি। সেই কাহিনির প্রকাশ্য ও নেপথ্য কুশীলব কারা, কোন রাজনীতির বোড়ে হতে হয়েছে তাঁদের, পণ্ডিত বিতাড়নের মধ্য দিয়ে কাদের কোন রাজনৈতিক অভিসন্ধি চরিতার্থ হয়েছে, কাশ্মীরি মুসলমান ও হিন্দু কীভাবে ক্রমে অকাশ্মীরি মুসলমানদের আগ্রাসনে হাঁসফাঁস করেছে, সেসব ‘সত্য’ এই আখ্যানে অপ্রদর্শিত। চিত্রিত যা, সবটাই একতরফা। উদ্দেশ্যটাই একমুখী। উগ্র হিন্দুত্ববাদের পালে বাতাস জোগানো।
তিন দশকে ৮৯ জন পণ্ডিতের খুন হওয়া যতটা ‘সত্য’, ততটাই ‘সত্য’ ১ হাজার ৬৩৫ জন কাশ্মীরি মুসলমানের হত্যাও। তিন দশকে ভূস্বর্গে প্রাণ হারিয়েছেন লক্ষাধিক। সেনা অভিযানে, ‘ফেক এনকাউন্টারে’, পুলিশি হেফাজতে, জঙ্গি হানায়, বাছাই হত্যায়। জওয়ান টু জঙ্গি, তালিকা দীর্ঘ! এসব ‘সত্য’ কাশ্মীরের তিন দশকের অবিকৃত উপাখ্যানের উপাদান। তা থেকে বেছে বেছে পণ্ডিত নিধনের চলচ্চিত্রায়ণ আজকের নব্য ভারতের ইসলামোফোবিক ঘৃণার রাজনৈতিক গৌরবায়ন ছাড়া অন্য কিছু নয়।
ক্ষমতাসীন হওয়ার পর বিজেপি যেভাবে কাশ্মীর পুনর্গঠনের নকশা তৈরিতে ব্যস্ত, হিন্দুরাষ্ট্র গঠনে যা গুরুত্বপূর্ণ সোপান, এই সিনেমা আশ্চর্যজনকভাবে সেই লক্ষ্য পূরণের অনুঘটক হয়ে উঠেছে। সেই চালচিত্রে মুসলমানরা এক ও অদ্বিতীয় খলনায়ক। নিজ দেশে পরবাসী বিরক্ত পণ্ডিতেরাও তাই বলছেন, ধর্মীয় ঘৃণা ছাড়া এই সিনেমা আর কিছু জন্ম দেবে না। ‘সত্য’ উদ্ঘাটনে তাঁদের সমস্যার পরিবর্তন হবে না।
হচ্ছেও না। হচ্ছে না বলেই ৩৭০ অনুচ্ছেদ খারিজের পর বিশেষ মর্যাদাহীন কাশ্মীরে মাত্র ৩৪ জন অকাশ্মীরি জমি কিনেছেন! সংসদে পেশ করা এই তথ্যে জমির নতুন মালিক ও কেনাবেচার উদ্দেশ্য নিয়ে কোনো উল্লেখ যেমন নেই, তেমনই জানা নেই সেখানে অকাশ্মীরিদের বসবাস কিংবা ব্যবসা চালানো আদৌ সম্ভবপর হবে কি না। ভয় সাপের মতো কুণ্ডলী পাকিয়ে রয়েছে বলেই এত নিরাপত্তা, এত আশ্বাস, এত বাবা-বাছা সত্ত্বেও সরকারি হিসাবে মাত্র ৩ হাজার ৮০০ জন কাশ্মীরি পণ্ডিত নিজভূমে চাকরি নিয়ে ফিরেছিলেন। কিন্তু গত বছর নতুনভাবে বাছাই হত্যা শুরু হলে সহস্রাধিক অকাশ্মীরি উপত্যকা ত্যাগ করেন। সরকারি অভয়দান কাজে আসেনি। নিরাপত্তার আশ্বাসে পণ্ডিতমন ভেজেওনি।
না ভেজার কারণ আস্থা ও বিশ্বাসহীনতা। ১৯৮৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে যখন টিকালাল টাপলু, মোহনলাল, ভূষণলাল রায়না, নীলকণ্ঠ গঞ্জুদের মতো বিশিষ্টজন খুন হচ্ছিলেন, তখন কিন্তু দিল্লি ও শ্রীনগরের সরকারি কর্তাদের সেভাবে নড়েচড়ে বসতে দেখা যায়নি স্রেফ রাজনৈতিক কারণে। কেন্দ্রে তখন বিজেপির সমর্থনপুষ্ট বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংয়ের সরকার। দেশের প্রথম মুসলমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মুফতি মহম্মদ সঈদ। দিল্লিবাসী হয়েও মুফতির নজর কাশ্মীরে নিবদ্ধ। লক্ষ্য, ফারুক আবদুল্লাহকে গদিচ্যুত করা। ১৯৮৯ সালের ৮ থেকে ১৩ ডিসেম্বর সেই সুযোগ অযাচিতভাবে চলেও এল তাঁর কাছে। কন্যা রুবাইয়া অপহৃত হলেন। অপহরণকারীরা জম্মু-কাশ্মীর লিবারেশন ফ্রন্টের পাঁচ জঙ্গির মুক্তির বিনিময়ে রুবাইয়াকে ছাড়ার শর্ত দিল। লন্ডন থেকে তড়িঘড়ি ফিরে মুখ্যমন্ত্রী ফারুক আবদুল্লাহ তীব্র আপত্তি জানালেন। ১৩ ডিসেম্বর সকালে ইন্দ্রকুমার গুজরাল ও আরিফ মহম্মদ খান শ্রীনগর এলেন। বার্তা, জঙ্গিদের না ছাড়লে ফারুক সরকার বরখাস্ত হবে। সেই সন্ধ্যায় পাঁচ জঙ্গি ও রুবাইয়ার মুক্তি। কাশ্মীরের সর্বনাশের পথ প্রশস্ত হওয়ারও সেই শুরু। পরের মাস থেকে শুরু হলো পণ্ডিত নিধন ও উৎখাত পর্ব। ১০ বছর পর ১৯৯৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর ছিনতাই হওয়া ভারতীয় বিমানযাত্রীদের ছাড়াতে জেলবন্দী সন্ত্রাসীদের নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী যশোবন্ত সিং আফগানিস্তান উড়ে গিয়েছিলেন।
দ্য কাশ্মীর ফাইলস নিয়ে আজ যাঁরা গদগদ, দায়ের ভাগ তো তাঁদেরও? ১৯৮৯ সালে বিজেপি ছিল সরকারের খুঁটি, ১৯৯৯ সালে প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ী!
কাশ্মীরের ‘সত্য’ এসবও। আবহমান কাল ধরে ভারত সরকারের সঙ্গে কাশ্মীরের টানাপোড়েন; কেন্দ্র ও রাজ্যের ক্ষমতাসীনদের আত্মঘাতী ও অদূরদর্শী রাজনীতি; পাকিস্তানি রাষ্ট্রীয় চক্রান্ত; আমলাশাহি ও সেনা-পুলিশের বাড়াবাড়ি; সম্পদের লাগামহীন লুট ভূস্বর্গকে নরকে পরিণত করেছে। শান্তিপ্রিয়, ঘরকুনো, অলস ও আয়েশি কাশ্মীরিরা বছরভর কেন রক্তের হোলিতে মত্ত, সেই রহস্য যেমন অনুদ্ঘাটিত, তেমনই অনুচ্চারিত অকাশ্মীরি মুসলমানের চক্রান্তে কাশ্মীরি মুসলমানের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠার উপাখ্যানও। ট্রিগার হ্যাপি ভারতীয় নিরাপত্তারক্ষীদের বাড়াবাড়ি, পদোন্নতির অভীপ্সায় অগুনতি ‘ফেক এনকাউন্টার’, বিরামহীন গুম-খুন কাশ্মীরি মুসলমান জীবনও অতিষ্ঠ করে তুলেছে। সিনেমায় এসব ‘সত্য’ অনুপস্থিত। উপস্থিত শুধু পণ্ডিত নিধনে মুসলমানি চক্রান্ত!
তিন দশকে ৮৯ জন পণ্ডিতের খুন হওয়া যতটা ‘সত্য’, ততটাই ‘সত্য’ ১ হাজার ৬৩৫ জন কাশ্মীরি মুসলমানের হত্যাও। তিন দশকে ভূস্বর্গে প্রাণ হারিয়েছেন লক্ষাধিক। সেনা অভিযানে, ‘ফেক এনকাউন্টারে’, পুলিশি হেফাজতে, জঙ্গি হানায়, বাছাই হত্যায়। জওয়ান টু জঙ্গি, তালিকা দীর্ঘ! এসব ‘সত্য’ কাশ্মীরের তিন দশকের অবিকৃত উপাখ্যানের উপাদান। তা থেকে বেছে বেছে পণ্ডিত নিধনের চলচ্চিত্রায়ণ আজকের নব্য ভারতের ইসলামোফোবিক ঘৃণার রাজনৈতিক গৌরবায়ন ছাড়া অন্য কিছু নয়। রামমন্দির আন্দোলন দিয়ে যা শুরু, গোরক্ষা অভিযান, লাভ জিহাদ হয়ে সাম্প্রতিক ‘হিজাব-হালাল’ বিতর্ক তাকে নতুন রূপ দিয়েছে। দ্য কাশ্মীর ফাইলস সেই একমুখী প্রবাহের আরও একটা বাঁক, যা হয়ে উঠেছে ‘নব্য’ ভারতের একদর্শী রাষ্ট্রীয় চরিত্র গঠনের এক সার্থক বিজ্ঞাপন।
● সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি