এক.
তিরুনিল্লাই নারায়ণ সেশনদের পরিবার জ্যোতিষশাস্ত্রকে ধর্মগ্রন্থের মতোই বিশ্বাস করত এবং এখনো করে। বিয়ের সময় হবু স্ত্রী জয়ালক্ষ্মী সম্পর্কে জ্যোতিষীরা সেশন পরিবারকে বলেছিলেন, তাঁর সন্তান হবে না। কিন্তু টি এন সেশন ১৯৫৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর ২৭ বছর বয়সে মাত্র ১০ মিনিট আলাপ শেষেই পিতাকে জানিয়ে দিয়েছিলেন, জয়াকে বিয়ে করতে যাচ্ছেন তিনি। সেই জয়ালক্ষ্মীই শেষ জীবনে ৬০ বছরের সঙ্গী সম্পর্কে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘সত্যের খাতিরে উনি স্ত্রীকেও ত্যাগ করতে পারেন।’
এই উক্তি যে স্রেফ ভালোবাসাপ্রসূত কোনো কথা নয়, প্রতিটি বর্ণ যে সত্য, সেটা ভারতের প্রায় সবাই জানে। বিশেষত, দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিবিদেরা। প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে ভারতীয় রাজনীতিবিদদের দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছিলেন চরম একরোখা এবং অকুতোভয় তামিল ব্রাহ্মণ টি এন সেশন।
বড় ভাই লক্ষ্মীনারায়ণ ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের প্রথম ব্যাচের সেরা একজন ছিলেন। শিক্ষাজীবনের শেষে সেশনেরও ইচ্ছা ছিল একই পেশায় ঢুকবেন। বয়স কম বলে তাঁকে পুলিশ ক্যাডারে পরীক্ষা দিতে হয়। ১৯৫৪ সালের সেই ব্যাচে তিনি প্রথম হন। পরের বছরই আবার পরীক্ষা দিয়ে প্রশাসন ক্যাডারে চলে আসেন। এবং আসতে আসতে ১৯৮৯ সালে ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের সর্বোচ্চ পদ কেবিনেট সেক্রেটারি হন। তবে তাঁকে নিয়ে গল্পের শুরু তখন, যখন তিনি ভারতের নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব পান।
দুই.
প্রশাসন ক্যাডারে থাকতেই সেশনের স্বাধীন, সুচিন্তিত ও সাহসী ভূমিকা অনেকের নজর কেড়েছিল। কায়েমি স্বার্থবাদীদের কাছে বহুবার তাঁর পদক্ষেপ প্রত্যাখ্যাত হলেও কিছু মানুষ তাঁর দক্ষতা ও আগ্রহ সম্পর্কে বিশেষভাবে জানতেন। তাঁদেরই একজন (চন্দ্রশেখরের প্রধানমন্ত্রিত্বের কালে) আইনমন্ত্রী সুব্রানিয়াম স্বামী তাঁকে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব পেতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন। এরপর ছয় বছর (১৯৯০-৯৬) ভারতে নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেন তিনি। তাঁর দায়িত্বকাল ছিল গুচ্ছ গুচ্ছ খণ্ডযুদ্ধের সমাহার। শুরুতে সেশন দক্ষিণ এশিয়ার নির্বাচনী সংস্কৃতির প্রায় এক শটি সমস্যা চিহ্নিত করে প্রতিটির মোকাবিলায় নামেন। এসব যুদ্ধ তাঁকে ক্রমে জনতার নায়কে পরিণত করে। কারণ, তিনি ভোটনির্ভর রাজনীতিতে কোটি কোটি মানুষকে অন্তত এক দিনের সুলতানে পরিণত করেছিলেন।
রাজনীতিবিদ ও আমলাদের রাহুগ্রাস থেকে নির্বাচনী ব্যবস্থাকে পরিষ্কার করতে সেশন ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের সঙ্গে এ নিয়ে লড়াইয়ে নেমে বারবার আদালতে গেছেন। নির্বাচন বন্ধ রেখে হলেও দাবি আদায় করে ছেড়েছেন। সমালোচকেরা বলতেন, সেশন নির্বাচনী উৎসবের রং কেড়ে নিয়েছেন। উত্তরে তিনি বলেছিলেন, নির্বাচন কোনো বিনোদন অনুষ্ঠান নয়। অনেক বেশি গুরুতর কিছু। নির্বাচনী প্রচারে আচরণবিধি লঙ্ঘনের প্রমাণ সংগ্রহের জন্য তিনিই প্রথম ভিডিও গ্রাহক দল নামিয়েছিলেন এলাকায় এলাকায়। এ সময়ই ক্রুদ্ধ রাজনীতিবিদেরা ‘আলসেইশন’ কুকুরের সঙ্গে মিলিয়ে আড়ালে আড়ালে তাঁকে ‘আল-সেশন’ নামে সম্বোধন করতেন। কিন্তু ক্রুদ্ধ এই ‘নেকড়ে’ প্রকৃতই নির্বাচনী আচরণবিধিকে কৌতুককর অতীত থেকে মুক্তি দিয়েছিল।
তিন.
সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের কর্তৃত্বই সর্বোচ্চ—এই সত্য কাজে প্রতিষ্ঠিত করতে প্রতি মুহূর্তে তৎপর ছিলেন সেশন। নির্বাচনকালে সরকারের নির্দেশনা অগ্রাহ্য করতেও তিনি ছিলেন দ্বিধাহীন। তাঁর প্রধান সফলতা ছিল নির্বাচনী কর্মকর্তাদের ওপর নির্বাচন কমিশনের পূর্ণ এখতিয়ার প্রতিষ্ঠা। যে রাজ্যেই যখন নির্বাচন হতো, সেখানে পুলিশ ও প্রশাসন হাতে নিয়ে নিতেন সেশন। প্রয়োজনে যেকোনো স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বদলি ও শাস্তির অধিকার নির্মমভাবে প্রয়োগ করতে দেখা যেত তাঁকে। দুর্নীতিগ্রস্ত নির্বাচন বাতিল করে দিতে দ্বিতীয়বার ভাবতেন না তিনি।
আমলা ও রাজনীতিবিদেরা এসব কাজে বারবার বাধা হয়ে দাঁড়াতেন। অন্তত দুবার তাঁকে সরিয়ে দেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলেন এমপিরা। তাঁর ক্ষমতা খর্ব করতে সংবিধান সংশোধন করে ১৯৯৩ সালে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব বিকেন্দ্রীকৃত করে দুজন সহযোগী কমিশনার (এম এস গিল এবং সি কৃষ্ণমূর্তি) নিয়োগ দেওয়া হয়। এর বিরুদ্ধেও আদালতে গিয়েছিলেন সেশন এবং বিজয়ী হন।
নির্বাচনে স্বচ্ছতা আনতে সেশন নির্বাচনী আইনের সংস্কার, নির্বাচনী প্রক্রিয়ার সংস্কার এবং ভোটারদের সচেতন করার উদ্যোগ নেন। তাঁর কার্যকালে মিথ্যা তথ্য দেওয়ার কারণে অন্তত ১৪ হাজার প্রার্থীকে তিন বছরের জন্য নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করেছিল ভারতীয় নির্বাচন কমিশন। নির্বাচনী ব্যয় মনিটরের জন্য জাতীয় আয়কর বিভাগের কর্মকর্তাদের তৃণমূলে পাঠিয়ে দিতেন সেশন এবং কেন্দ্রীয় কন্ট্রোল রুম থেকে ঘণ্টায় ঘণ্টায় তাঁদের তৎপরতার খোঁজ নেওয়া হতো। দৈনিক ভিত্তিতে প্রার্থীদের নির্বাচনী খরচের হিসাব রাখাকে কঠোর এক বাধ্যবাধকতার বিষয় করে তুলেছিলেন তিনি। এ সময়ই তাঁকে ‘চেঞ্জমেকার’ বলা শুরু হয়।
সেশন প্রকাশ্যেই বলতেন, দক্ষিণ এশিয়ায় নির্বাচনের প্রধান সমস্যা হলো ‘থ্রি এম—মানি, মাসল অ্যান্ড মিনিস্টার্স।’ মন্ত্রীরা কেউ নির্বাচনের দিনক্ষণ নিয়ে প্রচারমাধ্যমে কোনো মন্তব্য করলে সেশন নোটিশ পাঠিয়ে জানিয়ে দিতেন, এ বিষয়ে এখতিয়ার শুধু তাঁরই। নির্বাচন ঘনিয়ে এলে ভোটারদের প্রভাবিত করার জন্য ‘উন্নয়ন কর্মসূচি’ ঘোষিত হলে খোদ নির্বাচনই স্থগিত করতেন তিনি। ভোটারদের আইডি কার্ড দেওয়া না হলে আর কোনো নির্বাচন করা হবে না—১৯৯৫-এ সেশনের এ রকম হুমকির মুখেই ভারতে পরিচয়পত্র দেওয়ার কাজ শুরু হয়। ১৯৯৩ সালে তামিলনাড়ুতে নির্বাচনকালে সরকার রক্ষীবাহিনী পাঠানোর জন্য তাঁর আবেদন অগ্রাহ্য করলে সেশন নির্বাচন স্থগিত করে দিয়েছিলেন। বিষয়টি সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়ায়। সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের কর্তৃত্ব এবং চাওয়ার মূল্য হতে হবে সর্বোচ্চ—এই সত্য কাজে প্রতিষ্ঠিত করতে তৎপর ছিলেন তিনি।
আজকের বাংলাদেশের মতো না হলেও সেশনের কার্যকালের আগে ভারতেও নির্বাচন ছিল অনেকটা এলিটদের ‘উৎসব’ মাত্র। মাত্র ছয় বছরে সেশন তার চরিত্র অনেকখানি পাল্টে দেন।
চার.
কর্মজীবনের মতোই অবসরজীবনেও সেশন সম্পূর্ণ ‘অন্য রকম’ এক মানুষ। জয়ালক্ষ্মীকে নিয়ে চেন্নাইয়ে এক বৃদ্ধনিবাসে থাকতেন। এ বছর মার্চে স্ত্রী মারা যাওয়ার পর এখন অনেক একা। কাউকে কাছে পেলেই ভারতের এই দশম সিইসি মজা করে বলেন, একজন ব্রাহ্মণ আদিপেশাচ্যুত হলে যা করার থাকে তা হলো কোথাও প্রশাসক হওয়া বা গান করা বা রান্না করা।
শুরুতে সেশন প্রথমটিই বাছাই করেছিলেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব ছেড়ে একদা (১৯৯৭-এ) প্রেসিডেন্ট হওয়ারও আগ্রহ ছিল তাঁর। কিন্তু ভারতীয় রাজনীতিবিদ ও আমলাতন্ত্র দ্বিতীয়বার কোনো ঝুঁকি নেয়নি। শিবসেনা ছাড়া আর কোনো দল তাঁকে সমর্থন দেয়নি। কে আর নারায়ণনের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে বিশাল ব্যবধানে পরাজিত হয়েছিলেন। বিজয়ী প্রার্থীর ৪ হাজার ২৩১ ভোটের বিপরীতে সেশন পেয়েছিলেন ২৪০ ভোট মাত্র। অনেকেই তখন একে অভিহিত করেছিলেন সেশনের বিপক্ষে রাজনীতিবিদদের মধুরতম এক প্রতিশোধ হিসেবে।
আসলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সমাজ ও রাজনীতির জগদ্দল পাথর সরাতে অনেক টি এন সেশন দরকার। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বিষয়টি আরও জরুরি বটে। এখানে বারবার নতুন নির্বাচন কমিশন ও কমিশনার আসেন। কিন্তু দেশটির দরকার ‘চেঞ্জমেকার’।
আলতাফ পারভেজ: দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক