মতামত

একজন শিক্ষক হৃদয় মণ্ডল এবং ‘শিক্ষাগুরুর মর্যাদা’

কারাগারের ছোট ফটক দিয়ে মাথা নিচু করে যখন একজন শিক্ষক বের হন, সেই দৃশ্য দেখে আমাদেরও মাথা নিচু হয়ে যায় তখন
ছবি: প্রথম আলো

১৯ দিন কারাগারে থাকার পর গত রোববার (১০ এপ্রিল) বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় মণ্ডল জামিনে মুক্তি পেলেন। এরই মধ্যে দেশজুড়ে তিনি আলোচিত চরিত্র। অনলাইনে সংবাদমাধ্যমগুলোর তাঁকে নিয়ে খবরের নিচে বিষোদ্‌গার ও গালিগালাজের শেষ ছিল না। ধর্ম বনাম বিজ্ঞান নিয়ে তো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘উচ্চমার্গীয়’ আলোচনার আসরও জমিয়ে ফেলে একদল। গত কয়েক বছরে ধর্ম অবমাননার নামে কত কিছু ঘটল, একজন ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিকে মসজিদ থেকে বের করে পুড়িয়েও মারা হলো। সাম্প্রদায়িক হামলায় তছনছ হলো সংখ্যালঘুদের উৎসব। একাধিক ঘটনায় পুলিশের গুলিতে নিহতও হলো অনেকে।

এরপরও সুচিন্তিতভাবে কেউ চিন্তা করল না, হৃদয় মণ্ডল আসলেই কি ধর্ম অবমাননা করেছিলেন? নাকি এর পেছনে অন্য কোনো ঘটনা আছে? ক্লাসে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাঁর তর্কবিতর্কের রেকর্ড শোনারও কেউ প্রয়োজন মনে করল না। এর মধ্যে কেউ সেই বিতর্ক অনুলিখন করলে তখন অনেকের হুঁশ হলো। তখন দেড়-দুই সপ্তাহ পার হয়ে গিয়েছে। দুইবার আবেদন করেও আদালত জামিন দেননি তাঁকে।

শেষ পর্যন্ত বোঝা গেল তিনি ষড়যন্ত্রের শিকার। পরিকল্পনা করে তাঁকে ফাঁসানো হয়েছে। তার আগেই গোটা দেশ দুই ভাগ হয়ে গেল। সাম্প্রদায়িক ইস্যু বানানোর প্রবল চেষ্টাও আমরা দেখতে পেলাম। পক্ষে-বিপক্ষে ঘৃণার চাষাবাদেও ব্যস্ত হয়ে পড়লেন অনেকে। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের যে ভূমিকা রাখার কথা ছিল সেটি নিয়েও নানা প্রশ্ন আমরা দেখতে পাই।

মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলার বিনোদপুর রামকুমার উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডল। দুই বছর করোনার প্রভাবে স্কুল বন্ধ ছিল। স্কুল খোলার পর প্রথম বা দ্বিতীয় ক্লাস হবে, ক্লাসে তাঁর সঙ্গে ধর্ম ও বিজ্ঞান নিয়ে তর্ক তৈরি করে শিক্ষার্থীরা। তারা সেই বিতর্ক মুঠোফোনে রেকর্ড করে, কিছুই জানতেন না শিক্ষক। এমনকি পরের দুই দিনও স্বাভাবিক নিয়মে ক্লাস করেছেন তিনি। এরপর দিন যা ঘটল, তা রীতিমতো ভয়াবহ। তিনি বলছেন, ‘কতজন মানুষ সেখানে হামলা করেছিল, সেটা আমি দেখিনি, রুমের ভেতরে ছিলাম। তাদের চিৎকারের শব্দ শুনছিলাম। পরবর্তী সময়ে পুলিশ এসে আমাকে নিয়ে যায়। পুলিশ যেভাবে আমাকে জড়িয়ে ধরে সেখান থেকে বের করেছে, সেটা না করলে আমার মৃত্যু নিশ্চিত ছিল। রুম থেকে বের হয়ে দেখতে পাই বড় বড় লাঠি নিয়েও অনেকে সেখানে ছিলেন। পুলিশ আমাকে গাড়িতে তুলে যখন নিয়ে যাচ্ছিল তখনো মানুষ আমাকে মারার চেষ্টা করছিল, ইট ছুড়ছিল। অনেকে গাড়িতে ওঠারও চেষ্টা করে। পুলিশ তাদের সরিয়ে দেয়। তারা প্রায় আধা কিলোমিটার পর্যন্ত আমাকে তাড়া করে।’ ১৯ দিন পর জামিনে মুক্তি পেয়ে ডেইলি স্টারকে এক সাক্ষাৎকারে সেদিনের বিভীষিকাময় পরিস্থিতির বর্ণনা করেছেন এভাবে।

শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সেই বিতর্ক যারা মনোযোগ দিয়ে শুনেছেন বা পড়েছেন, তাতে কারও সন্দেহ থাকার কথা না, কীভাবে তাঁকে ফাঁসানো হয়েছে। ছাত্রদের একের পর এক উদ্দেশ্যমূলক প্রশ্নবাণে পড়ে তিনি কিছু অমূলক কথাবার্তা হয়তো বলেছেন, কিন্তু বেশির ভাগ কথাই ছিল যুক্তিসংগত এবং ধর্ম নিয়ে অবমাননা সেখানে ছিল না। কিন্তু নিরাপত্তার নামে তাঁকে জেলে রেখে যে মামলা দেওয়া হলো, সেটি যেন আরও বেশি প্রশ্নবিদ্ধ করে গোটা ঘটনাকে। তাঁর বিরুদ্ধে কোনো শ্রেণির উপাসনালয় বা পবিত্র বলে বিবেচিত কোনো বস্তু ধ্বংস, অনিষ্ট বা অপবিত্র করার মামলা দেওয়া হলো। যার শাস্তি সর্বোচ্চ দুই বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড। ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ততা ছিল না স্কুলের একজন অফিস সহায়ককে দিয়ে পরোক্ষভাবে পুলিশই সেই মামলা করালো হৃদয় মণ্ডলের বিরুদ্ধে। এরপর ১৯ দিন ধরে কারাগারে কাটাতে হলো তাঁকে। এমন বড় জুলুমের ভেতর দিয়েই যেতে হলো একজন শিক্ষককে। কারাগারের ছোট ফটক দিয়ে মাথা নিচু করে যখন তিনি বের হন, সেই দৃশ্য দেখে আমাদেরও মাথা নিচু হয়ে যায় তখন।

হৃদয় মণ্ডলের সঙ্গে মোবাইলে কথা হলো। তাঁকে নিয়ে অনেকের একটি ধারণার কথা জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি বিজ্ঞান ক্লাসে ধর্ম নিয়ে আগেও এমন কথা বলতেন কি না। তাঁর জবাব হচ্ছে, তিনি কখনো ধর্মকে অসম্মান করে কোনো কথা বলতেন না। এমনকি দশম শ্রেণির যেসব শিক্ষার্থী তাঁকে ফাঁসাল, তাদেরও আগের কোনো শ্রেণিতে তিনি পড়াননি। কারণ, তিনি সব সময় নবম-দশম শ্রেণিতেই ক্লাস নেন এবং করোনার কারণে গত দুই বছর স্কুলই বন্ধ ছিল। ফলে এসব শিক্ষার্থীর সঙ্গে ক্লাসে তেমন একটা দেখাও হয়নি তাঁর।

তাহলে এ ঘটনা ঘটানোর কারণ কী থাকতে পারে। ১২ এপ্রিল ভোরের কাগজ এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে জানাচ্ছে, স্কুলের নামে ১০টি চালের আড়তের অগ্রিম ভাড়া, গত বছরের পিইসি-জেএসসি-এসএসসির শিক্ষার্থীদের থেকে নেওয়া টাকা স্কুলের ব্যাংক হিসাবে জমা না হওয়া, শিক্ষকদের ফান্ডের টাকা ব্যাংক থেকে তুলে নেওয়া—এমন সব ঘটনায় কোটি টাকার বেশি অর্থের অনিয়ম এবং স্কুলের কমিটিতে স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের অনুসারীদের প্রভাব বিস্তার নিয়ে জর্জরিত ছিল স্কুলটি। আর্থিক অনিয়ম নিয়ে দুদকেও অভিযোগ দেওয়া হয়। শিক্ষার্থীদের বেতন জমা নিয়ে এক কর্মচারীর সঙ্গে বিরোধও হয় হৃদয় মণ্ডলের।

এসব অনিয়মের বিষয়ে ফোনে জানতে চাইলে তিনি কিছু জানেন না বলে মন্তব্য করেন। স্কুলটিতে দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে শিক্ষকতা করছেন, আর দুদকে অভিযোগ জমা হওয়া বড় আর্থিক অনিয়মের বিষয়টি তিনি জানেন না জেনে অবাকই হলাম। হয়তো ঝামেলা এড়াতে চাইছেন, সেটিই স্বাভাবিক। তবে স্কুলের টেস্ট পরীক্ষায় জোর করে নম্বর বাড়িয়ে না দেওয়া, প্রাইভেট টিউশন নিয়ে অন্য শিক্ষকদের সঙ্গে বিরোধকেই গুরুত্ব দিলেন তিনি। প্রাইভেট টিউশনের অন্য শিক্ষকেরা স্কুলের পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের নানা অনৈতিক সুযোগ-সুবিধা দেন আর হৃদয় মণ্ডল সেই ব্যাপারে আপস করেন না। সেই সঙ্গে সাম্প্রতিককালে এলাকায় ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা তৈরি হওয়া এবং সেটির প্রভাব এ ঘটনায় কাজ করেছে বলেও দাবি করলেন। ভোরের কাগজের অনুসন্ধানীতে সেটি উঠে এসেছে।

মূলত স্থানীয় ক্ষমতাসীন রাজনীতি, ধর্মীয় প্রভাব ও স্কুলের আর্থিক অনিয়মের সঙ্গে ঘুরেফিরে একটি চক্র জড়িত। কিছু শিক্ষক, কর্মচারী, ম্যানেজিং কমিটির কিছু সদস্য ও স্থানীয় প্রভাবশালী এর সঙ্গে যুক্ত। হৃদয় মণ্ডলকে ফাঁসানোর ঘটনায় তাদের ইন্ধনের বিষয়টি ঘুরেফিরে আসছে। আগেও একাধিক শিক্ষককে হেনস্তা করেছে চক্রটি।

নানা নিরাপত্তাহীনতার মধ্যেও গত ১৩ এপ্রিল হৃদয় মণ্ডল প্রিয় স্কুলে ফিরেছেন। ২৩ দিন পর চেনা প্রাঙ্গণে পা রেখেছেন। এখন ক্লাসে ফিরে যেতে চান। সবকিছু ভুলে আবারও শিক্ষার্থীদের আপন করে নিতে উদ্‌গ্রীব তিনি। এ শিক্ষক বলছেন, ‘আমরা যেহেতু শিক্ষক, ক্ষমাই আমাদের ধর্ম। শিক্ষার্থীরা যা-ই করুক, আমাকে ওদের ক্ষমা করতে হবে, ভালোবাসতে হবে। এভাবেই এগিয়ে যেতে হবে।’ এর মাধ্যমে নিজের শিক্ষক-সত্তার মর্যাদাই প্রতিষ্ঠা করলেন তিনি। যেন ‘চির-উন্নত হল শিক্ষাগুরুর শির’। বাংলা ব্যাকরণে মুখস্থ করা ‘একজন আদর্শ শিক্ষক’ রচনার বাস্তব প্রতিচিত্র হলেন তিনি। হৃদয় মণ্ডল বলছেন, এরা কোমলমতি শিক্ষার্থী। তাদেরকে ক্ষমা ও ভালোবাসতে হবে এ কারণে যে, যাতে স্কুলে এ ধরনের ঘটনা আর কখনও না ঘটে। শুধু নিজের স্কুলই না গোটা দেশের কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমন ঘটনা না ঘটুক। সেই বার্তাই তিনি পৌঁছে দিতে চান। সেই সঙ্গে এও চান, ইন্ধনদাতা চক্রটির শাস্তি হোক।

এখন দেশে যখন কোনো একটি ঘটনা ‘হাইপ’ তুলে সেটিই যেন একের পর এক ঘটতে থাকে। দেখা গেল, এক শিক্ষার্থী ময়লার গাড়ির চাপায় নিহত হলো, এরপর আরও কয়েকজন ময়লার গাড়ির নিচে চাপায় বা ধাক্কা নিহত বা আহত হলো। আলোচিত কোনো ধর্ষণের ঘটনা ঘটল, শিশু ধর্ষণ বা বাসে দলবদ্ধ ধর্ষণ—একের পর এক ঘটতেই থাকল। কয়দিন আগে আমরা দেখলাম, সড়কে একের পর এক শিশু মারা যাচ্ছে। ছেলেধরা গুজব ছড়িয়ে গণপিটুনির ঘটনার ক্ষেত্রেও তেমনটা দেখা গেল। সবকিছুই যেন একটা ‘সিরিজ’ আকারে আসে।

মুন্সিগঞ্জের সেই ঘটনার পর আরও শিক্ষকের বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ আমরা দেখতে পাই। সেসব নিয়েও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সরগরম। একই সময় সিলেটের গোপালগঞ্জের একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ক্লাসে অক্সিজেনে গুরুত্ব বোঝাতে বুক ভরে শ্বাস নেওয়ার জন্য ছাত্রীদের মাস্ক ও নিকাব খুলতে বলে ফেঁসে গিয়েছেন। এ নিয়ে ফেসবুকে ভিডিও ভাইরাল করে তার বিরুদ্ধে মিছিলও হয়েছে। সেই শিক্ষক এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। যদিও অভিভাবক স্বীকার করছেন, বিষয়টি আসলে ভুল বোঝাবুঝি ছিল।

নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার এক স্কুলে ইউনিফর্ম না পরে আসা ছেলে-মেয়ে উভয়কেই শাস্তি দেওয়ার ঘটনায় হিজাব বিতর্কে ফাঁসিয়ে দেওয়া হলো শিক্ষিকা আমোদিনী পালকে। প্রশাসনের তদন্তে মূল বিষয়টি বেরিয়ে আসল। এরপর একই ধরনের ঘটনা ঘটে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের জোরারগঞ্জ বৌদ্ধ উচ্চ বিদ্যালয়ে। সেখানেও প্রধান শিক্ষক তুষার কান্তি বড়ুয়ার বিরুদ্ধে হিজাব অবমাননার অভিযোগ ওঠলে স্কুলের ৭০টি সিসি ক্যামেরার ফুটেজ অনুসন্ধান করে কিছুই পায়নি উপজেলা প্রশাসন। শিক্ষকের বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগের এই ‘সিরিজ’ কয়দিন চলবে জানি না। সেটি শেষ হলেও এরপর কোন ‘সিরিজ’ সামনে আসছে?

  • রাফসান গালিব প্রথম আলোর সহ–সম্পাদক