প্রখ্যাত ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক ইয়ান ফ্লেমিংয়ের উপন্যাসের কাল্পনিক চরিত্র জেমস বন্ড। তাকে নিয়ে নির্মিত হয়েছে অসংখ্য চলচ্চিত্র ও কমিকস। বাংলাদেশে জেমস বন্ড না থাকলেও একজন নয়ন বন্ড আছেন। তিনি নিজেই এই উপাধি নিয়েছেন। তাঁর শক্তির উৎস মাদক ও ক্ষমতার রাজনীতি।
গত বৃহস্পতিবার যখন প্রথম আলোর বরগুনা প্রতিনিধি মোহাম্মদ রফিককে টেলিফোন করি, তখন সাব্বির আহম্মেদ ওরফে নয়ন বন্ডের আংশিক পরিচয় পাই। তিনি এলাকায় মাস্তান হিসেবে পরিচিত ও মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। নিজেও মাদক সেবন করেন। কিন্তু গতকাল বরগুনার বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে এবং পুরোনো পত্রিকা ঘেঁটে আমরা তাঁর রাজনৈতিক পরিচয়টিও পেয়ে যাই। নয়ন বন্ড কোনো পদে না থাকলেও আত্মীয়তা ও ‘বড় ভাই’ সূত্রে ক্ষমতার রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। ২০১১ সালে এসএসসি পাস করে নয়ন আর পড়াশোনা করেননি। তাঁর বন্ধু রিফাত ফরাজী ও তাঁর ছোট ভাই রিশান ফরাজী সাবেক সাংসদ ও বর্তমান জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেনের ভায়রার ছেলে।
বরগুনার আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী হলেন সাংসদ ও সাবেক উপমন্ত্রী ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন। গত সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের এই দুই নেতা একে অপরের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, দখলবাজি, মাস্তানি, মাদক ব্যবসা, বিএনপি-জামায়াত তোষণের অভিযোগ আনেন। কিন্তু মাদক ব্যবসায়ী নয়ন বন্ড, রিফাত ফরাজী ও রিশান ফরাজীদের বিরুদ্ধে কেউ কোনো কথা বলেননি। বরং উভয় পক্ষ তাঁদের হাতে রাখার চেষ্টা করেছেন। এটি তাঁদের ও সহযোগীদের বক্তৃতা-বিবৃতি ও ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে স্পষ্ট।
২০১৮ সালের ২৮ এপ্রিল বরগুনা প্রেসক্লাবে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি জুবায়ের আদনান ও সাধারণ সম্পাদক তানবীর হোসাইন সংবাদ সম্মেলন করে বলেছিলেন, ‘আমরা আগে শুনেছি কাজের বিনিময়ে খাদ্য, মানে কাবিখা। কাজের বিনিময়ে টাকা, মানে কাবিটা। অপ্রিয় হলেও সত্য, এখন সেখানে শুনতে হচ্ছে ‘মাবিরা’ (মাদকের বিনিময়ে রাজনীতি)।’ তাঁদের অভিযোগ, সুনাম দেবনাথ (সাংসদ ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর ছেলে) বরগুনার মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন।...সুনামের আরেক সহযোগীর নাম নয়ন বন্ড। প্রায় ১২ লাখ টাকার হেরোইন, ফেনসিডিল, দেশি অস্ত্রসহ ধরা পড়েন পুলিশের হাতে। এ ছাড়া ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাল পে-অর্ডার করে আলোচনায় আসেন বরগুনার তৎকালীন প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) ইস্রাফিল। তিনি ছিলেন সুনামের ফেনসিডিল ব্যবসার অংশীদার। (কালের কণ্ঠ, ২৯ এপ্রিল ২০১৮)
অথচ রিফাত শরীফ হত্যার পর ফেসবুকে সুনাম দেবনাথ লিখেছেন, ‘হত্যাকারীদের মধ্যে প্রধান হচ্ছে নয়ন এবং তার সহযোগীরা হচ্ছে রিফাত ফরাজী, পিতা দুলাল ফরাজী, সাং বরগুনা ধানসিঁড়ি রোড। এবং রিফাতের ছোট ভাই রিশান ফরাজী, পিতা: ও সাং ঐ।’
সুনামের অভিযোগ, রিফাত ও নয়নদের আরও একটি পরিচয় আছে, তাঁরা অত্র এলাকায় এমন কোনো ছাত্রাবাস নেই, যেখান থেকে ছাত্রদের ল্যাপটপ, মুঠোফোন, টাকা ইত্যাদি ছিনতাই এবং চুরি করে নিয়ে আসেননি। এ নিয়ে বহুবার মামলা হয়েছে, বহুবার জেল খেটেছেন, কিছুদিন পর আবার ছাড়াও পেয়েছেন। তাঁদের নামে কতগুলো মামলা রয়েছে, তা থানা কর্তৃপক্ষ ভালো বলতে পারবে।
নিহত রিফাতের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে সুনাম আরও লিখেছেন, ‘রিফাত শরীফ আমাদের খুব কাছের ছোট ভাই ও কর্মী ছিল, এবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আমাদের সঙ্গে থেকেই নির্বাচনী প্রচারণা করেছে। নিজের কাছে খুব খারাপ লাগছে রিফাতের মৃত্যুসংবাদে। তবে এ খুনের পেছনে আরও অনেক রহস্য আছে।’
২০১৭ সালের ৫ মার্চ রাত ১১টার দিকে নয়ন বন্ডের বাসায় অভিযান চালায় বরগুনা জেলা গোয়েন্দা পুলিশ। এ সময় ৩০০ ইয়াবা, ১২ বোতল ফেনসিডিল, ১০০ গ্রাম হেরোইনসহ আটক হন নয়ন। এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে বরগুনা সদর থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ও অস্ত্র আইনে দুটি মামলা করে নয়ন বন্ড ও তাঁর সহযোগী ইমামের বিরুদ্ধে। সে সময় আওয়ামী লীগের কোনো পক্ষ নয়ন সম্পর্কে মুখ খোলেনি। এমনকি ২০১৮ সালের ২৮ এপ্রিল জেলা ছাত্রলীগের নেতারা যখন মাদক ব্যবসায়ী নয়ন বন্ডকে সাংসদ পুত্রের সহযোগী হিসেবে শনাক্ত করেন, তখন তিনি একে প্রতিপক্ষের অপপ্রচার বলে চালিয়েছিলেন। এখন বলছেন নয়ন মাদকসন্ত্রাসী ছিলেন।
বরগুনায় রিফাত হত্যার ঘটনা গোটা বাংলাদেশের এক খণ্ডচিত্র তুলে ধরেছে মাত্র। প্রায় সব অপরাধের পেছনে কাজ করে মাদক ও ক্ষমতা। সরকারের নীতিনির্ধারকেরা প্রায়ই বলেন, সন্ত্রাসী ও মাদক ব্যবসায়ীদের কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। অথচ তারা যে পদে পদে ছাড় পেয়ে যাচ্ছে। পুলিশ চুনোপুঁটিদের পাকড়াও করলেও রাঘববোয়ালেরা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। মাদকসন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়, বিচার হয় না। পুলিশের দাবি, ‘আমরা তো ধরছি, কিন্তু আদালত থেকে জামিন নিয়ে বেরিয়ে এলে কী করার আছে।’ আদালত বলছেন, মামলার দুর্বলতার কারণেই আসামিরা জামিন পেয়ে যাচ্ছে। মানুষ কার কথা বিশ্বাস করবে?
এই যে সারা দেশে খুনখারাবি বাড়ছে, নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে, তার পেছনে রয়েছে মাদক ও ক্ষমতার রাজনীতি। অনেক ক্ষেত্রে তারা হাত ধরাধরি করে চলছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রিফাত হত্যার ছবি ছড়িয়ে পড়ায় দেশবাসী দ্রুত এই নৃশংসতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে। অনেকে প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে এসেছেন। এ জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ধন্যবাদ পেতে পারেন। কিন্তু যে নারী তাঁর স্বামীকে বাঁচাতে দুর্বৃত্তদের সঙ্গে একা লড়াই করলেন, তাঁকে নিয়ে মহল বিশেষের কুৎসা রটনার কারণ ঘাতকদের রক্ষা করা। এই অপপ্রচারকারীদের বিরুদ্ধে আমাদের আরও সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে। ঘাতক-দুর্বৃত্তদের চাপাতি-রামদার সামনে দাঁড়িয়ে বলতে হবে, ‘রুখে দাঁড়াও বাংলাদেশ।’
সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
sohrabhassan 55 @gmail. com