চলে গেলেন এই সময়ের এক মহানায়ক। এক যোদ্ধা। সুদূরপ্রসারী একজন স্বপ্নদ্রষ্টা, যিনি স্বপ্ন দেখতেন দারিদ্র্য ও ক্ষুধামুক্ত বৈষম্যহীন এক সমাজ গড়ার। স্বপ্ন দেখতেন নারী-পুরুষের থাকবে সমান অধিকার। একটি আলোকিত সমাজ নির্মাণের স্বপ্নও দেখতেন এই নির্মোহ স্বপ্নচারী—স্যার ফজলে হাসান আবেদ।
যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে গড়ে তোলার লক্ষ্যে বিলাসবহুল জীবন বিসর্জন দিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন নিরন্ন, সর্বহারা, সুবিধাবঞ্চিতদের পাশে। শুধু
দাঁড়ানো নয়, সেদিনের তরুণ আবেদ প্রান্তিক মানুষকে স্বপ্ন দেখালেন দারিদ্র্যের কশাঘাত থেকে মুক্তি পাওয়ার। নিজের মেধা, শ্রম, শিক্ষা ও সততা দিয়ে গড়ে তুললেন ব্র্যাক। তাঁর গড়ে তোলা সেই প্রতিষ্ঠানটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এখন বাংলাদেশের গৌরব বাড়িয়েছে।
তবে শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বের ১২টি দেশের দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করা মানুষের চোখেও স্বপ্ন বুনে দিয়েছেন তিনি। দেশে ও বিদেশে মানুষের মধ্যে কীভাবে স্বপ্নের জাগরণ ঘটিয়েছেন আবেদ ভাই? কয়েকটি নমুনা থাকল এ লেখায়। থাকল তাঁকে নিয়ে আমার ছোট্ট ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণাও।
শিশুশিক্ষা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে লাখ লাখ মানুষের শিক্ষার অধিকার তিনি ফিরিয়ে দিয়েছেন, এটা সবাই জানেন। কিন্তু শ্রেণিকক্ষে শুধু পড়ানো নয়, পাশাপাশি সাংস্কৃতিক চর্চাও করাতে হবে, তাঁর ভাবনা ছিল এমনই। ফলে ব্র্যাকের শিক্ষা কর্মসূচিতে শিশু থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত প্রতিটি ক্লাসে নাচ, গান, আবৃত্তি, ছবি আঁকা বাধ্যতামূলক করা হলো। আমরা অতিরিক্ত যান্ত্রিক হয়ে উঠছি এবং মানুষের মধ্যে বই পড়ার অভ্যাস কমছে দেখে পড়াশোনার জন্য নতুন এক ব্যবস্থা নিলেন তিনি, গড়ে তুললেন গণকেন্দ্র। এই ব্যবস্থায় প্রতিটি স্কুলে একটি লাইব্রেরি থাকবে। এখান থেকে কেবল শিক্ষার্থী নয়, এলাকাবাসীও বই নিয়ে পড়তে পারবেন।
অন্যদিকে কিশোর-কিশোরীদের সঠিকভাবে চলতে দেশব্যাপী গড়ে তোলা হলো ক্লাব, যেখানে খেলাধুলা ও সংস্কৃতিচর্চার মাধ্যমে জীবনের অন্য এক উৎকর্ষে পৌঁছেছে অনেকেই। বাল্যবিবাহের অভিশাপ থেকে অনেক কিশোরীকে জীবনের স্বপ্নমুখর বাস্তবতায় ফিরিয়ে এনেছেন আবেদ ভাই। যাদের দুবেলা খাবার জুটত না, সেই অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে ক্ষুদ্রঋণ ও আর্থিক সহায়তা দিয়ে তিনি তাদের বুকে সাহস জুগিয়েছেন ছোট ব্যবসা থেকে বৃহৎ শিল্প গড়ার।
জীবন–মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে প্রসববেদনায় মৃত্যুপথযাত্রীকে বাঁচাতে এল ট্রেনিংপ্রাপ্ত নার্সের মমতাময় হাতের স্পর্শ গ্রামীণ জনগণ পেয়েছে তাঁর হাত ধরে। আবার মরণফাঁদ কলেরা থেকে বাঁচতে ঘরে স্যালাইন তৈরির উদ্যোক্তা তো তিনিই।
আবেদ ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটনাচক্রে। ব্র্যাকে পড়ুয়া শিশু-কিশোরদের নিয়ে ‘তারায় তারায় দীপশিখা’ নামে গান-আবৃত্তি-ছবি আঁকার প্রতিযোগিতামূলক একটি অনুষ্ঠান হয়। উপজেলা-জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে ব্র্যাকে পড়া শিক্ষার্থীরা এতে অংশ নেয়। সবশেষে এক শ নির্ধারিত শিক্ষার্থীকে ঢাকায় এনে ওদের গ্রুমিং করা হয় বিখ্যাত শিল্পীদের তত্ত্বাবধানে।
২০১৪ সালে ব্র্যাকের এ রকম কয়েকটি অনুষ্ঠান ধারাবাহিকভাবে প্রচার করে। তখন দেশব্যাপী রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে। ‘তারায় তারায় দীপশিখা’র চূড়ান্ত পর্ব সাধারণত রবীন্দ্রসরোবরে ধারণ করা হয়। কিন্তু নিরাপত্তার কারণে সেবার সেখানে ধারণ করা সম্ভব নয়। তাই সিদ্ধান্ত হলো, চ্যানেল আইয়ের অফিস প্রাঙ্গণে ধারণ করা হবে চূড়ান্ত পর্বটি।
ব্র্যাকের শিক্ষা কর্মসূচির পরিচালক শফিকুল ইসলাম ভাইকে বললাম, এবারের অনুষ্ঠানটি যেহেতু চ্যানেল আই প্রাঙ্গণে ধারণ করা হবে, আবেদ ভাইকে উপস্থিত থাকার জন্য অনুরোধ করা যায় কি না। আবেদ ভাইয়ের সম্মতি পেয়ে কিছুদিন পর আমাকে তাঁর উপস্থিত থাকার কথা জানালেন শফিক ভাই। এতে আমি তো খুশিতে আত্মহারা। পাঁচ পর্বের ধারণ শেষ হতে প্রায় ঘণ্টা চারেক সময় লেগেছিল। আশ্চর্য ব্যাপার, সামনের সারিতে আবেদ ভাই ভাবিসহ অন্য সবাই সম্পূর্ণ অনুষ্ঠানটি সেদিন উপভোগ করেছিলেন। আবেদ ভাই নিজেও অনুষ্ঠান শেষে মঞ্চে উঠে শিশুদের উদ্দেশে কিছু বললেন এবং পরিশেষে সবার হাতে পুরস্কার তুলে দিলেন। আর আমি বিজয়নীর বেশে নিজেকে ধন্য মনে করলাম।
ধীরস্থির সদা হাস্য স্বল্পভাষী আবেদ ভাইয়ের মধ্যে ছিল কাজ করার এবং লেগে থাকার এক অসাধারণ শক্তি। শিশুদের বড় ভালোবাসতেন। তাদের নিয়েই স্বপ্ন দেখতেন আগামী বাংলাদেশের। স্যার ফজলে হাসান আবেদ যুদ্ধ করেছেন। সেই যুদ্ধ মানুষের বিরুদ্ধে ছিল না, তিনি যুদ্ধ করেছেন সমাজে প্রচলিত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। তিনি চলে গেলেন ঠিকই, কিন্তু দেশের জন্য, মানুষের জন্য আবেদ ভাই এমন সব কাজ করে গেছেন, যা তাঁকে আমাদের মধ্যে বাঁচিয়ে রাখবে অনন্তকাল।
কামরুননেসা হাসান: ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচির কনসালট্যান্ট