নির্বাচন শুধু বাংলাদেশে নয়, পৃথিবীর সব দেশেই অত্যন্ত উত্তেজনাকর একটি রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার ঘটনা। স্থানীয় বা জাতীয় যে নির্বাচনই হোক না কেন, তার সঙ্গে উত্তাপ-উত্তেজনা, দ্বন্দ্ব-সংঘাত, অভিপ্রেত–অনভিপ্রেত কিছু ঘটনা-দুর্ঘটনা, আবশ্যক–অনাবশ্যক সরকারি ব্যয় এবং ব্যক্তি ও সামষ্টিক ব্যয়ের প্রশ্ন জড়িত। নির্বাচন এমনি একটি কর্মকাণ্ড, যাতে সরকার, রাজনৈতিক দল, নিরীহ সাধারণ মানুষসহ একসময় সবাই জড়িত হয়ে পড়ে। জাতীয় নির্বাচন হয় সাধারণত পাঁচ বছরে একবার। কিন্তু আমাদের দেশে একটি সরকারের পাঁচ বছর মেয়াদের প্রতিটি বছরই কোনো না কোনো স্থানীয় নির্বাচন হতেই থাকে। এক বছর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন, তো পরের বছর পৌরসভা নির্বাচন। আর এক বছর উপজেলা পরিষদ হলে পরের জেলা পরিষদ নির্বাচন। এর মধ্যে আবার সিটি করপোরেশনও বাদ যায় না, রাজনৈতিকভাবে বলতে গেলে সে এক চরম উত্তেজনাকর নির্বাচন। পার্বত্য তিনটি জেলার জন্য আছে পৃথক জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদ নির্বাচন।
পাঁচটি নির্বাচনের প্রতিটির জন্য ঘোষিত হয় পৃথক পৃথক তফসিল। পৃথক তফসিল মানে মোটামুটি এক-দুই মাসের একটি সময় ব্লক করে রাখা। স্থানীয় প্রশাসন থেকে সর্বস্তরের মানুষ ওই সময়টায় অনেক স্বাভাবিক কাজে মনোনিবেশ করতে পারে না। অহিংস-সহিংস নির্বাচনী উত্তেজনা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সবার বাড়তি কিছু দায়িত্ব। বাড়তি ব্যয়। কিছু অস্থিরতা, স্নায়ুচাপ, সামাজিক সম্পর্কের অবনতি, বিভেদ-বিভক্তি অনেক কিছু। তাই বলে কি আমরা নির্বাচন করব না? অবশ্যই করব। কিন্তু এখানে এ ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা আনার লক্ষ্যে কিছু সংস্কার করলে সময় ও অর্থের বিরাট সাশ্রয় এবং অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয় এড়ানো যায়। এ বিষয়ে প্রতিবেশী ভারতসহ অনেক দেশের স্থানীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানপদ্ধতি পর্যালোচনা করে দেখা যায়। বিভিন্ন দেশের স্থানীয় নির্বাচনপদ্ধতি বা ব্যবস্থা পর্যালোচনা করে আমি এ অভিমতটি দিতে চাই যে, আমরা আমাদের দেশে পাঁচ বছরব্যাপী নানা পৃথক তফসিলে পাঁচটি স্থানীয় প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রচলিত ব্যবস্থাকে পরিবর্তন করে একটি একক তফসিলে সব স্থানীয় নির্বাচন বিশেষ সময়ে অনুষ্ঠান করে নিতে পারি। তাতে করে পাঁচ বছর ধরে নির্বাচনী উত্তেজনাকে বিস্তৃত করা থেকে জাতি রক্ষা পেতে পারে। প্রতিটি সংস্থা একসঙ্গে একই অর্থবছরে মেয়াদ শুরু এবং শেষ করতে পারবে।
ভারতে একটি একক তফসিলে গ্রাম পঞ্চায়েত (জিপি), পঞ্চায়েত সমিতি (পিএস) ও জেলা পরিষদ (জেপি) এবং অন্য একটি পৃথক তফসিলে সব পৌরসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ভারতে এটি সম্ভব হয়। কারণ, সে দেশে একটি একক আইনে তিন স্তরের তিনটি প্রতিষ্ঠান গঠিত ও পরিচালিত হয়। তিনটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে পারস্পরিক কর্ম–সম্পর্ক বিদ্যমান। আমাদের দেশে প্রথম সমস্যা হচ্ছে ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন কোনো একক আইনে নয়, সম্পূর্ণ পৃথক পাঁচটি আইনের মাধ্যমে গঠিত ও পরিচালিত। দ্বিতীয় সমস্যা আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোর সাংগঠনিক কাঠামো। আমাদের রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারের আদলে গঠিত ইউনিয়ন, উপজেলা, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনে প্রতিজন ভোটার প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে তিনটি করে ভোট দেন। আবার জেলা পরিষদে সাধারণ ভোটারের ভোটাধিকার নেই। পরোক্ষ ভোটের মাধ্যমে জেলা পরিষদ গঠিত হয়। প্রতিষ্ঠান ও স্তরনির্বিশেষে সবখানে নির্বাচনপদ্ধতি ও সাংগঠনিক কাঠামো একই রকম না হওয়ায় আমরা সহজ একটি বিষয়কে অনেক জটিল করে ফেলেছি।
স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে অধিকতর অংশগ্রহণমূলক, গণতান্ত্রিক, জবাবদিহিমূলক ও প্রাণবন্ত করতে হলে এর (১) রাষ্ট্রপতি আদলের সাংগঠনিক কাঠামোকে সংসদীয় পদ্ধতিতে রূপান্তর করা প্রয়োজন হবে, (২) পাঁচটি পৃথক ও পরস্পর সম্পর্কবিহীন আইনের পরিবর্তে এক ও
অভিন্ন একটি ফ্রেমওয়ার্ক আইনের (Framework Law) মাধ্যমে পাঁচটি প্রতিষ্ঠান গঠন ও পরিচালনা করতে হবে ও (৩) স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে
সংসদীয় পদ্ধতি চালুর মাধ্যমে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ দুটি পদ্ধতির মিশ্রণে একটি নতুন নির্বাচনী ব্যবস্থা চালু করতে হবে।
এ ব্যবস্থায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ দুটি পর্যায়ে নির্বাচনের মাধ্যমে ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনগুলো গঠিত হবে। প্রথম পর্যায়ে সাধারণ ভোটাররা জাতীয় সংসদের মতো নিজ নিজ ওয়ার্ড সদস্য বা কাউন্সিলর নির্বাচন করবেন। সদস্য বা কাউন্সিলররা পরবর্তী সময়ে পরিষদে এমপিদের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থনে হাউসে নেতা নির্বাচন করবেন। একই তফসিলে পাঁচটি প্রতিষ্ঠানে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। গ্রামীণ বাংলাদেশের প্রতিজন ভোটার যুগপৎভাবে ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা পরিষদের তিনজন ওয়ার্ড সদস্যকে তিনটি ব্যালটে তিনটি ভোট দেবেন। পৌর এলাকার প্রতিজন ভোটার একইভাবে পৌর কাউন্সিলর, উপজেলা ও জেলার ওয়ার্ড সদস্যদের এক এক করে তিনটি ভোট দেবেন। সিটি করপোরেশনের ভোটাররা প্রত্যেকে দুটি করে ভোট দেবেন। একটি ভোট করপোরেশনের ওয়ার্ড কাউন্সিলরকে অপর ভোটটি দেবেন জেলা পরিষদের ওয়ার্ড সদস্যকে। এভাবে প্রতিটি পরিষদ গঠিত হবে। প্রতিটি পরিষদ দলীয় সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে নির্বাহী নেতৃত্ব নির্বাচন করবে এবং নির্বাচন দলীয় প্রতীকে হতে কোনো বাধা থাকবে না। স্বতন্ত্র সদস্যরাও অবশ্যই নির্বাচন করতে পারবেন।
এই প্রস্তাবিত নতুন ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচন করতে হলে স্থানীয় সরকারবিষয়ক বিরাজিত আইনগুলোর আমূল সংস্কারের প্রয়োজন হবে। বিরাজিত সব আইনকে সমন্বিত করে একটি মাত্র ‘লোকাল গভর্নমেন্ট ফ্রেমওয়ার্ক ল’ তৈরি করতে হবে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল পঞ্চায়েত অ্যাক্ট-১৯৭৩’ কিংবা পাকিস্তান সময়ের ‘মৌলিক গণতন্ত্র আদেশ-১৯৫৯’ একীভূত ফ্রেমওয়ার্ক আইনের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। বাংলাদেশের বিরাজিত আইনগুলো পরস্পর বিচ্ছিন্ন, অনেক ক্ষেত্রে পরস্পর সংঘাতপূর্ণ। ফলে পরিষদগুলোর মধ্যে আন্তপ্রতিষ্ঠান সম্পর্ক অত্যন্ত দুর্বল। পারস্পরিক উন্নয়ন সহযোগিতার কোনো স্বীকৃত কাঠামো নেই। প্রস্তাবিত আইনে ওই সব কাঠামোগত অসুবিধা দূর করা যাবে।
নতুন আইনে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে চেয়ার বা মেয়র নির্বাচিত হবেন না। যাঁরাই চেয়ার বা মেয়র হতে আগ্রহী, তাঁদের প্রথমে সদস্য বা কাউন্সিলর হতে হবে। এভাবে সব মেয়র বা চেয়ারপ্রত্যাশী সদস্য বা কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে পরিষদ সদস্যদের গুণগত মান বৃদ্ধি পাবে। এখন যে নির্বাচন হয় তা মূলত চেয়ারম্যান বা মেয়রকেন্দ্রিক। প্রস্তাবিত পদ্ধতিতে সদস্য বা কাউন্সিলররা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবেন। প্রতিটি পরিষদের অভ্যন্তরে ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের আবির্ভাব ঘটবে। গণতান্ত্রিক জবাবদিহি ও তৃণমূলে সংসদীয় রীতির চর্চা শুরু হবে। নির্বাচন ব্যয়সাশ্রয়ী ও কম উত্তেজনাকর হবে। পুরো বিষয়টি নিয়ে অন্যত্র বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে (Reform Agenda for Local Governance (2016), প্রথমা)। এখানে এই স্বল্প পরিসরে পুরো বিষয়ের বিস্তারিত ব্যাখ্যা সম্ভব নয়। তবে বিষয়টি শুধু উপস্থাপিত হলো। জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলগুলো এ বিষয়গুলো নিয়ে নিজেদের মধ্যে বিতর্ক অনুষ্ঠান করতে পারে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হবে এ লক্ষ্যে সংস্কারের একটি দৃঢ় অঙ্গীকার এবং তাই রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী ইশতেহারে বিষয়গুলোর সংযোজন সময়ের দাবি। আশা করি, মাঠ প্রশাসন ও স্থানীয় সরকারব্যবস্থা সংস্কারের লক্ষ্যে একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি বা কমিশন গঠন করে সেই সুপারিশের ভিত্তিতে এসব বিষয়ে একটি ব্যাপক সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হবে এবারের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে—এটি হোক আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর অন্যতম একটি অঙ্গীকার।
ড. তোফায়েল আহমেদ রাজনীতি ও লোকপ্রশাসনের অধ্যাপক, স্থানীয় সরকার ও শাসন বিশেষজ্ঞ
tofail101@gmail.com