এই শিশুদের পক্ষে বলার কি কেউ নেই

মা সংসারের নানা কাজে ব্যস্ত থাকায় ছেলেবেলায় কুয়াতলা, কলতলা, পুকুর বা নদীতে আমরা নিজেরাই আমাদের গোসলের কাজ সেরে নিতাম। তবে শুক্রবার জুমার আগে তিনি ঠিকই সময় ম্যানেজ করে ফেলতেন। কানের পাশে, পায়ের পাতায়, গোড়ালির নিচে, শরীরের নানা সন্ধিতে ময়লা জমত। সেগুলো ‘রগড়িয়ে রগড়িয়ে’ পরিষ্কারের যন্ত্রণা কম ছিল না। খেলতে গিয়ে কাঁটাছেড়ার লুকানো দাগ এ সময় মায়ের নজরে চলে আসত, জবাবদিহি করতে হতো সেসব দাগের। খোসপাঁচড়ার ইঙ্গিত পেলে সাবান আর নিমপাতার এস্তেমাল হতো কঠোরভাবে।

এ রকমই এক শুক্রবারের (২১ মে ২০২২) সালতামামি গোসলে কুমারখালীর এক মা আবিষ্কার করেন তাঁর শিশুটি একদিন আগেই কঠিন যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ভুক্তভোগীর মা জানিয়েছেন, ‘…শুক্রবার আমার ছেলেকে গোসল করানোর সময় পেছনে খুব ব্যথা অনুভব করে। ছেলেকে ব্যথার কারণ জিজ্ঞেস করলে তখন বিষয়টি জানতে পারি। এ বিষয়ে থানায় অভিযোগ করেছি। মামলা দায়েরও করব।’… ভুক্তভোগী দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র মায়ের জেরার মুখে অকপটে জানিয়ে দেয়, ‘হারুন ভাই (স্কুলের দপ্তরি) আমাকে স্কুলের ভেতর ডেকে নিয়ে এ কাজ করেন। বিষয়টি কাউকে বললে মেরে ফেলার হুমকিও দেন। এর আগেও দুইবার এমন কাজ করেছে।’

অভিযুক্ত দপ্তরির এমন খাসলতের কথা কমবেশি সবাই জানতেন। তারপরেও তার চাকরি হয়েছে শিশুদের স্কুলে। নৈশপ্রহরী কাম দপ্তরি। রাতদিন ২৪ ঘণ্টা স্কুল তার জিম্মায়। বিকেলে স্কুলের মাঠে শিশুরা গেলে সে শিকারের অপেক্ষায় থাকে। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, ‘দপ্তরি একজন চরিত্রহীন লোক। তাঁর বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতনের অনেক অভিযোগ রয়েছে। স্থানীয়ভাবে টাকা দিয়ে সমস্যা সমাধান হয়ে যায় বিধায় বারবার এ ধরনের ঘটনা ঘটানোর সাহস পায়।’

গরিবের জন্য ‘বিচার’ দূরের স্বপ্ন, এটা জানার পরেও মাকে কেউ আটকাতে পারেনি। তিনি আইনের দরজার শক্ত কড়া নাড়িয়েছিলেন শিশুর নিরাপত্তাকে আমলে নিয়েছিলেন তিনি। পুলিশ দপ্তরিকে ধরে এনেছিল। কিন্তু ওই পর্যন্তই। টাকা দিয়ে নাকি মিটমাট করে ফেলেছে দপ্তরি সাহেব। বিদ্যালয়ের সভাপতি মো. মানিক হোসেন জানাচ্ছেন, ‘মামলার বাদীর সঙ্গে আসামির মিটমাট হয়েছে। একটা লিখিত মীমাংসার কাগজ স্কুলে দিয়েছে।’

ধর্ষণ এখন এমনই এক সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আছে যে অনেকেই আর এটাকে তেমন বড় অপরাধ বলে মনে করছেন না। নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় বাইতুল হুদা ক্যাডেট মাদ্রাসার ১২ শিশু ছাত্রীকে ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির অভিযোগে গ্রেপ্তার অধ্যক্ষ আল আমিন তঁার অপরাধের কথা স্বীকার করে দাবি করেছিলেন, ‘শয়তান ভর করায়’ ধর্ষণ করেছেন তিনি। তঁার কোনো দোষ নেই, সব দোষ শয়তানের।

এর মধ্যে জামিন ‘ম্যানেজ’ করে ফেলেছেন অভিযুক্ত দপ্তরি। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের মামলায় জামিন সহজ নয়। এই প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মামলা তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই লিটন চন্দ্র দাস সংবাদকর্মীদের জানান, ‘বাদী আদালতে মীমাংসার কথা বলায় আদালত আসামিকে জামিন দিয়েছেন। এ ধরনের অপরাধ মীমাংসার যোগ্য নয়। আমি খুব দ্রুতই মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রদান করব।’ কুমারখালী উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা মো. শরিফুল ইসলাম বলেছেন, ‘স্কুলের শান্তি রক্ষায় ও শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার স্বার্থে এ ধরনের ঘটনায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া দরকার।’ তারপরেও এটাই এখন সত্য, অভিযুক্ত মুক্ত। ধর্ষণের সুস্পষ্ট প্রমাণ আর বিধিবিধান কিছুই শিশুদের স্বার্থ রক্ষা করতে পারেনি।

দপ্তরি আবার কাজে যোগদানের পাঁয়তারা করছেন। তবে এবার অভিভাবকেরা একজোট হয়েছেন। গত ১১ জুন শনিবার অভিভাবকেরা দল বেঁধে স্কুলে গিয়ে জানিয়ে দিয়েছেন, ‘অভিযুক্ত ব্যক্তি স্কুলে থাকলে আমরা এই স্কুলে সন্তান পড়াব না।’ বিষয়টি নিশ্চিত করে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ফিরোজ হোসেন জানান, ‘...অভিভাবকেরা এসেছিলেন। তাঁদের সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁদের চাওয়া–পাওয়া নিয়ে পরে কথা বলব। এ বিষয়ে আপাতত কিছু বলতে চাচ্ছি না।’ স্পষ্টত তিনি চাপের মধ্যে আছেন।

গত বছরের (২০২১) এপ্রিলে নরসিংদীর শিমুলের কান্দির ঘটনা নিশ্চয় পাঠকের মনে আছে। সেই ঘটনায় শিশুটির বাবা ছেলের রক্তভেজা শরীর দেখে স্থির থাকতে পারেননি। তিনি ও তাঁর স্ত্রী বাঁশের লাঠি নিয়ে ধর্ষককে শায়েস্তা করতে ছুটে যান। মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ও মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির কয়েকজন ঘটনাস্থলে এসে তাঁদের বাধা দেন। যুক্তি ছিল, বেশি জানাজানি হলে মাদ্রাসার ইমেজ নষ্ট হয়ে যাবে, তাই মিটমাট করে নেওয়াই ভালো। শিশুটির বাবার কাছে পরে জানা যায়, অনেক চাপ ও মিথ্যা প্রবোধ দেওয়ার পর মাদ্রাসায় সালিস বৈঠক ডাকা হয়েছিল। বৈঠকে অভিযুক্ত শিক্ষকসহ আরও অনেকে উপস্থিত ছিলেন। সালিসকারীরা শিশুটির চিকিৎসার জন্য ওষুধ ও মলম কিনে দেওয়া এবং সঙ্গে ‘খুব সামান্য’ টাকা নিয়ে বিষয়টি চেপে যেতে বলেন। টাকার পরিমাণ বেশি হলে কি হতো আমরা জানি না । ওই ঘটনা শেষ পর্যন্ত থানা-পুলিশ পর্যন্ত গড়ায়। সালিস পণ্ড হয়ে যায়।

ধর্ষণ এখন এমনই এক সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আছে যে অনেকেই আর এটাকে তেমন বড় অপরাধ বলে মনে করছেন না। নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় বাইতুল হুদা ক্যাডেট মাদ্রাসার ১২ শিশু ছাত্রীকে ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির অভিযোগে গ্রেপ্তার অধ্যক্ষ আল আমিন তঁার অপরাধের কথা স্বীকার করে দাবি করেছিলেন, ‘শয়তান ভর করায়’ ধর্ষণ করেছেন তিনি। তঁার কোনো দোষ নেই, সব দোষ শয়তানের।

কুমারখালীর ঘটনা নিয়ে ফেসবুকে লেখালেখি হলে একজন সাবেক প্রধান শিক্ষক তাঁর প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে লেখেন, ‘…পতিতালয় উচ্ছেদ হওয়ার আগে সমাজে এত ধর্ষণের প্রকোপ ছিল না।’ তারপর লিখেছেন, ‘...বাল্যবিবাহ কিন্তু ধর্ষণ বন্ধ হওয়ার একটি ভালো উপায় ছিল।’ ভাবতে অবাক লাগে, এই ‘ভদ্রলোক’ কমপক্ষে দুটি সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন!

কাউকে বোঝাতে না পেরে পরিবারকে পাশে না

পেয়ে গত ৮ এপ্রিল ২০২১ বুধবার কুলিয়ারচর থানায় দৌড়ে ঢুকে যায় এক শিশু। থানার পুলিশকে খুলে বলে ধর্ষণের কথা। তার শিক্ষকের বিরুদ্ধে নিজেই নালিশ

করে। পরে কুলিয়ারচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের

জরুরি বিভাগের চিকিৎসক জানান, ‘শিশুটি তার কাছে ধর্ষণের বর্ণনা দিয়েছে। পরে পরীক্ষা করে তাকে ধর্ষণের আলামত মিলেছে।’

মনোবিজ্ঞানীরা পরিষ্কার করেই বলেছেন, ধর্ষণের শিকার শিশুগুলো সারা জীবনই মনোবৈকলিক মনোবৈকল্যে এবং একসময় এমন বিকৃত যৌনাচারে নিজেরাও কখনো কখনো জড়িয়ে পড়তে পারে। মেয়েশিশুদের জীবনটা আরও বেশি কষ্টকর হয়ে ওঠে। সমাজ ওই মেয়েদের দিকেই আঙুল তুলে তাদের দোষ খুঁজে বেড়ায়। আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোতে ধর্ষণের শিকার শিশুদের পক্ষে বলার কি কেউ নেই?

গওহার নঈম ওয়ারা লেখক ও গবেষক

nayeem5508@gmail.com