সাম্প্রতিক কালে ইরাকের সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী মাস ছিল অক্টোবর। এই মাসে দেড় শতাধিক বেসামরিক ইরাকি নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে পাঁচ হাজারের বেশি। এই লোকগুলোকে মেরেছে না আইএস বা তাদের সহযোগীরা, না কোনো গাড়িবোমা। সরকারের অকার্যকর ব্যবস্থা ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে ন্যায্য প্রতিবাদ করতে আসা নিরপরাধ ইরাকিদের খোদ ইরাকি নিরাপত্তাকর্মীরা গুলি করে মেরেছেন।
ইরাকের রাস্তায় বিক্ষোভ নতুন কিছু না। এই বিক্ষোভ আচমকাও হয়নি। ২০১১ সালে আরব বিদ্রোহের ঢেউ তিউনিসিয়া, মিসর ও সিরিয়াকে কাঁপিয়েছে। সেই ঢেউ এবার ইরাককে প্রচণ্ডভাবে কাঁপিয়ে দিচ্ছে। তবে গত মাসে এর প্রাবল্য ছিল সবচেয়ে বেশি।
ইরাকে কয়েক বছর ধরে বড় দুর্নীতি, বেকারত্ব এবং জনসেবা খাতের ব্যর্থতার প্রতিবাদে কিছুদিন পরপরই বিক্ষোভ হয়ে আসছে। বিশেষ করে গরমকালে বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহের ঘাটতি নাগরিকদের তাৎক্ষণিকভাবে বিক্ষুব্ধ করে তোলে। এ সময়ে বিক্ষুব্ধ লোকজন বাগদাদ ও অন্যান্য শহরে নেমে পড়ে। তখন বিদ্যুৎ বা পানির সমস্যার সঙ্গে আরও নানান ইস্যু যুক্ত হয়। এই আন্দোলনগুলো একদিকে ক্ষমতাসীনেরা দমন করতে চায়, অন্যদিকে বিরোধী রাজনীতিকেরা এটিকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করার চেষ্টা করেন। এ ধরনের পরিস্থিতিতে বরাবরই সরকার বিক্ষোভকারীদের দাবি পূরণের প্রতিশ্রুতি দেয়। শেষ পর্যন্ত তা বাস্তবায়ন করা হয় না।
কয়েক বছর ধরে যে ধরনের বিক্ষোভ বা আন্দোলন হচ্ছে, এবারের আন্দোলন সেগুলো থেকে অনেকটাই আলাদা। তা এ কারণেই যে এবারের বিক্ষোভ হয়েছে সম্পূর্ণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে। এই বিক্ষোভ কারও ডাকে হয়নি। কোনো সংগঠন, কোনো দল বা গ্রুপ এর আয়োজন করেনি।
ইরাকের এলিট কাউন্টার টেররিজম বাহিনীর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল আবদুল ওয়াহাব আল সাদির পদাবনতির ঘোষণা ছড়িয়ে পড়ার পরপরই এই বিক্ষোভ শুরু হয়।
দুই বছর আগে মসুলকে আইএসমুক্ত করার কারণে আল সাদি ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। জাতীয় বীর হিসেবে জনমনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে ওঠা আল সাদি জাতিগত বিভেদ দূর করে ইরাকি জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা হয়ে ওঠেন। আল সাদির পদাবনতিকে জনগণ ইরাকের দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবস্থার একটি ‘সিম্পটম’ বা রোগলক্ষণ হিসেবে নিয়েছে। এর কারণ হলো বেশির ভাগ নাগরিক বিশ্বাস করে, এখন যাঁরা দেশ চালাচ্ছেন, তাঁরা পশ্চিমাদের নির্দেশমতো কাজ করেন, দেশের স্বার্থের চেয়ে নিজেদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখাকেই তাঁরা বড় মনে করেন। এই হতাশা ও বঞ্চনার অনুভূতি থেকে ইরাকিরা প্রবল ক্ষোভের সঙ্গে এবার তাঁদের প্রধান স্লোগান বানিয়েছেন, ‘আমরা একটি দেশ চাই’।
বিক্ষোভকারীদের একটি বিরাট অংশ ২০০৩ সালের ইঙ্গ-মার্কিন বাহিনীর ইরাক অভিযানের সময় জন্ম নেওয়া তরুণ। পশ্চিমাদের ওই অভিযানে শুধু যে সাদ্দাম হোসেনের পতন হয়েছিল তা নয়, সাদ্দামের পতনের পর কার্যত ইরাকের রাষ্ট্রব্যবস্থাই ভেঙে পড়েছে।
ইরাকের প্রতিষ্ঠানগুলো অনিয়ম–দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে। প্রশাসনের সর্বস্তরে নিয়োজিত গোত্রভিত্তিক লোকজন নিজ নিজ গোত্রের স্বার্থ উদ্ধারে কাজ করছেন। এ ছাড়া কেউ ইরানের, কেউ যুক্তরাষ্ট্রের, কেউবা আবার সৌদির হয়ে কাজ করছেন। পশ্চিমা পণ্ডিত ও সাংবাদিকেরা ইরাকের এই ব্যবস্থাকে ‘গণতন্ত্র’ বলে চালিয়ে দিলেও আসলে সরকারের নানা স্তরে বসে থাকা লোকজন ইরাকিদের স্বার্থ রক্ষা করছেন না।
ইরাকে বহু মানুষ যখন না খেয়ে মারা যাচ্ছে, সেই মুহূর্তে ইরাকের তেল বিক্রির বিশাল অঙ্কের রাজস্ব ক্ষমতাসীনেরা ও তাঁদের বিদেশি অংশীজনেরা ভাগাভাগি করে খাচ্ছেন। ২০০৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত সরকারি তহবিলের ৪৫ হাজার কোটি ডলার তছরুপ হয়ে গেছে। অথচ এই তরুণেরা প্রচণ্ড দারিদ্র্যকে মেনে নিয়ে জীবন চালাতে বাধ্য হচ্ছেন। তাঁদের মৌলিক চাহিদা পূরণে সরকার ব্যর্থ হচ্ছে।
পশ্চিমা ধারার গণমাধ্যম বলে যাচ্ছে, দুই বছর আগে আইএসের পতনের পর তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত হচ্ছে, অথচ তার আগে ইরাকের যে সমৃদ্ধি ছিল, তা তারা জনগণকে ভুলিয়ে দিতে চাচ্ছে।
ইরাকের নিরাপত্তা বাহিনী বিক্ষোভকারীদের ওপর দমন–পীড়ন আগেও চালিয়েছে, কিন্তু এবার যা করেছে তা একেবারে নজিরবিহীন। ছাদের ওপর দাঁড়িয়ে নিরস্ত্র বিক্ষোভকারীদের ওপর তারা গুলি করেছে। সরকারের কুকীর্তির ছবি ও তথ্য যাতে ছড়িয়ে না পড়তে পারে, সে জন্য তারা বিক্ষোভের দ্বিতীয় দিনেই ইন্টারনেট বন্ধ করে দিয়েছে। সরকারের প্রচারযন্ত্রগুলো প্রচার করছে, সাদ্দাম হোসেনের বিলুপ্ত বাথ পার্টিকে আবার ক্ষমতায় আনার চক্রান্ত হিসেবেই এই বিক্ষোভ চলছে। পাশাপাশি বিক্ষোভ প্রশমনে সরকারের দিক থেকে অর্থনৈতিক সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এই প্রজন্ম আশ্বস্ত হতে পারছে না। তাদের মনে আস্থা জাগানো ছাড়া এই সমস্যার সমাধান এত সহজে হবে বলে মনে হয় না।