মতামত

এই বসন্তে টিসিবির লাইনে

এখন বসন্তকাল। বসন্ত মানে উৎসব, আনন্দ। কিন্তু মানুষের মন নিরানন্দ। জীবন উচ্ছ্বাস হীন। সারা দেশে টিসিবির ট্রাকের সামনে গরিব, বেকার আর মধ্যবিত্তের ভিড় বাড়ছে। গৃহকর্মী থেকে গৃহস্থ পরিবারের নারী, পুরুষ শ্রেণিবদ্ধভাবে লাইনে দাঁড়াচ্ছেন। মলিন মুখে উদ্বেগ, কখন গিয়ে পৌঁছাবে ওই টিসিবির পণ্য বিক্রির ট্রাকের সামনে। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ভাষায়, ‘আমার বসন্ত কাটে খাদ্যের সারিতে প্রতীক্ষায়,/ আমার বিনিদ্র রাতে সতর্ক সাইরেন ডেকে যায়।’ স্বাধীনতার ৫০ বছর গেল, খাদ্যের সারিতে দাঁড়ানো মানুষের প্রতীক্ষা গেল না। কেন?

নরেন্দ্রনাথ মিত্রের ‘অবতরণিকা’ গল্প অবলম্বনে সত্যজিৎ রায়ের এক অনন্য সিনেমা ‘মহানগর’। এক মধ্যবিত্ত পরিবারের গল্প বলতে গিয়ে সত্যজিৎ রায় ষাটের দশকের শহর কলকাতার রূঢ় বাস্তবতাগুলোকে ক্যামেরায় তুলে ধরেছেন। ঢাকার দক্ষিণ বাড্ডায় টিসিবির লাইনে দাঁড়ানো মরিয়ম আক্তারের মুখে সেদিন যেন আরতি চরিত্রে অভিনয় করা মাধবী মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠ শোনা গেল। ‘এত বড় শহর। এত রকম চাকরি। দুজনের একজনও কি পাব না একটা।’ সিনেমার আরতি চাকরি ছেড়েছিলেন সহকর্মীর প্রতি অন্যায়ের প্রতিবাদ করে। আর মরিয়মের চাকরি গেছে মহামারি করোনার কারণে।

করোনার ধকল কাটিয়ে ওঠার আগেই জ্বালানি তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎসহ নিত্যপণের দাম বাড়ায় সাধারণ মানুষের জীবন হাঁপিয়ে উঠেছে। এসবের ফলস্বরূপ টিসিবির লাইনে আজকে এত হুড়োহুড়ি, বিশৃঙ্খলা ও হাহাকার। সরকার কি জনগণের আর্তনাদ শুনছে?

কুমিল্লার মেয়ে মরিয়ম পাঁচ বছর আগে ঢাকা এসেছিলেন। নিরাপত্তাকর্মীর চাকরি নেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। করোনার কারণে তাঁর স্বামীর হোটেল ব্যবসাও লাটে উঠেছে। ধারদেনার সংসার। মাসখানেক আগে তাঁর স্বামী এনজিও থেকে ৩০ হাজার টাকা তুলে ভ্যানে করে সবজি বিক্রি শুরু করেছেন। এদিকে মরিয়ম চাকরি খুঁজছেন।

গত দুই সপ্তাহে রাজধানীতে টিসিবির পণ্য বিক্রি নিয়ে সরেজমিন প্রতিবেদন করতে বিভিন্ন স্থানে গিয়ে দেখা গেল, টিসিবির পণ্যবোঝাই ট্রাক দাঁড়ালেই এগলি-ওগলি থেকে মানুষ ছুটে আসছে। ঠিক যেন কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘চিলেকোঠার সেপাই’ উপন্যাসের বর্ণনার মতো। ‘…নবদ্বীপ বসাক লেনের পেছন দিকের বস্তি দিয়ে বেঢপ কোট ও রঙ-জুলাজামা গায়ে বেরিয়ে আসে ১০-১২ জন মানুষের একটি দল। পাঁচভাই ঘাট লেনের শামসুদ্দীনের রুটি কারখানার লোকজন বেরিয়ে এসেছে তন্দুরের ওম ছেড়ে। হৃষিকেশ দাস রোডের গ্যারেজ থেকে আসছে রিকশাওয়ালার দল।’

শুধু নিম্নবিত্ত নয়, সম্প্রতি বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন,সাশ্রয় পেতে টিসিবির পণ্য কিনতে মধ্যবিত্তরাও আসছে। কিন্তু প্রতিবাদী মধ্যবিত্ত কেন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রতিবাদ না করে টিসিবির লাইনে মুখ লুকায়, তার তত্ত্বতালাশও প্রয়োজন।

২৭ মার্চ মহাখালীর ওয়্যারলেস গেটের সিঅ্যান্ডবি মাঠে দেখি, টিসিবির লাইনের পেছনে বসে দিনমজুর কাম আখের রস বিক্রেতা নুরজামাল বারবার টাকা গুনছেন আর খাতওয়ারি আলাদা করছেন। তাঁর সম্বল দেড় হাজার টাকা। রাত পোহালে ৫৫০ টাকা কিস্তি দিতে হবে। কত টাকা দিয়ে ভাগে পণ্য কিনবেন আর কত টাকা জমা রাখবেন, এ নিয়ে তাঁর হিসাব কুলায় না। নুরজামাল যেন কথাসাহিত্যিক জাকির তালুকদারের আজগর আলীর হিসাববিজ্ঞান গল্পের আজগর আলীর মতো বিড়বিড় করে বলেছেন, ‘কিস্তি, ভাঙা হাত, চাল-ডাল, নাতি-নাতনির একটু শখ, ঘরফেরত খরচ। এই টাকা দিয়ে কি সব হবে না?’

দেশের করোনা মহামারি শুরুর পর অর্থনীতিবিদ ও গবেষকেরা বলে আসছেন, দেশে দারিদ্র্য বাড়ছে। ২০২০ সালের জুনে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) এক যৌথ সমীক্ষার গবেষণায় বলা হয়েছিল, দেশের দারিদ্র্য বেড়ে ৪৩ শতাংশ হয়েছে। সিপিডি বলেছিল, দারিদ্র্যের হার ৩৫ শতাংশ। এর পাশাপাশি আয় ও ভোগের বৈষম্যও বেড়েছে। সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের তথ্যও বলেছে, করোনায় দারিদ্র্যের হার বেড়ে ২৯ শতাংশ হয়েছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) আরেকটি তথ্য দিয়ে বলেছিল, পরিবারভিত্তিক মাসিক আয় প্রায় ৪ হাজার টাকা কমে সাড়ে ১৫ হাজার টাকা হয়েছে। বেকারত্ব ১০ গুণ বেড়েছে। করোনার ধকল কাটিয়ে ওঠার আগেই জ্বালানি তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎসহ নিত্যপণের দাম বাড়ায় সাধারণ মানুষের জীবন হাঁপিয়ে উঠেছে। এসবের ফলস্বরূপ টিসিবির লাইনে আজকে এত হুড়োহুড়ি, বিশৃঙ্খলা ও হাহাকার। সরকার কি জনগণের আর্তনাদ শুনছে?

বাংলার মন্বন্তর সম্পর্কে জওহরলাল নেহরু বলেছিলেন, ‘কলিকাতার রাজপথ যখন মানুষের মৃতদেহে আকীর্ণ, তখনও কিন্তু কলিকাতার উচ্চসমাজের লোকদের জীবনযাত্রার মধ্যে কোনোও পরিবর্তনই ঘটেনি। বিলাসিতার প্রাচুর্যে, নৃত্য-গীতে, আহারে-ব্যসনে তাঁদের জীবন ছিল পরিপূর্ণ।...এই সময়েও যথারীতি সাপ্তাহিক ঘোড়দৌড় অনুষ্ঠিত হত এবং ফ্যাসনেবল লোকের ভিড়ে ঘোরদৌড়ের মাঠ ভর্তি হয়ে যেত।...ইংরেজ ও ভারতীয় উভয়েই কলিকাতার এই অবিশ্বাস্য প্রমোদ-জীবনে অংশগ্রহণ করতেন, কারণ মুনাফা লাভ করে উভয়পক্ষের অবস্থা তখন স্বচ্ছল, টাকার তখন ছড়াছড়ি’ (জওহরলাল নেহরু: ভারত সন্ধানে)।

বাংলাদেশের ক্ষমতাশালী ও উচ্চবিত্ত শ্রেণিও আজ আমোদ-প্রমোদে মশগুল। রাষ্ট্রের মালিকানা থেকে ক্রমাগত বিচ্ছিন্ন হতে থাকা জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের পথে আবার শপথ নেওয়া জরুরি।

  • জহির রায়হান নিজস্ব প্রতিবেদক, প্রথম আলো। rayhan.jahir@prothomalo.com