শৈশবে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বাংলা পাঠ্যবইয়ে পড়েছিলাম আরব দেশের অন্ধকার যুগের কথা। সে যুগের মানুষ খুব নিষ্ঠুর আর বর্বর ছিল। ঘরে কন্যাশিশুর আগমন মেনে নিতে পারত না বাবারা। আঁতুড়ঘরেই মেরে ফেলত। এমনকি নবজাতক কন্যাকে জ্যান্ত পুঁতে ফেলার মতো নারকীয় অপকর্মও করেছে তারা। কিন্তু নরসিংদীর বাহারচরের বাবা যা করেছেন, সে বর্বরতা বুঝি সেই অন্ধকার যুগের নৃশংসতাকেও ছাড়িয়ে গেছে।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) দেওয়া তথ্যমতে, মাত্র ৩০ লাখ টাকার লোভে শিশুকন্যা ইলমাকে খুন করার অনুমতি দেন তিনি। রাতের আঁধারে তাঁর সামনেই দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রী ইলমার মাথায় মুগুর চালিয়ে, ইটের ছেঁচা দিয়ে হত্যা করা হয়। সিআইডির ভাষ্য অনুযায়ী, নিষ্পাপ শিশু ইলমার মা-ও জানতেন এই খুনের কথা।
সিআইডির ভাষ্য অনুযায়ী, নরসিংদীর বাহেরচরে শাহজাহান ভূঁইয়া ও সাবেক ইউপি সদস্য বাচ্চুর নেতৃত্বে দুটি দলের প্রভাব বিস্তার নিয়ে বিরোধ ছিল। শাহজাহান ভূঁইয়ার লোকজন প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করতে শিশুহত্যার পরিকল্পনা করেন। ঠিক হয়, তিনি ইলমার জান কবচের বিনিময়ে তার বাবা মোতালেবকে ৩০ লাখ টাকা দেবেন। টাকার লোভে মোতালেব মেয়েকে হত্যার অনুমতি দেন। এ পর্যন্ত মোতালেব চার লাখ টাকাও নাকি পেয়েছেন। হত্যাকাণ্ডের প্রধান আসামি মাসুম মিয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এই হত্যাকাণ্ডের বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন বলে জানিয়েছে পুলিশ। মাসুম ইলমার ফুফাতো ভাই। ষড়যন্ত্র মতো ইলমাকে যখন সাত-আটজন মিলে চরম নৃশংসভাবে হত্যা করে, সে সময় পাশেই দাঁড়ানো ছিলেন বাবা। এ কীভাবে সম্ভব? বোধশক্তিতে ধরে না।
এই অভিযোগ যদি সত্যি হয়, তাহলে বলতে হয়, লোভ মানুষকে কোন পর্যায়ে নিয়ে গেলে মা-বাবার মতো পরম নির্ভরতা এমন পাষণ্ড হতে পারে? আদিকালের অন্ধকার যুগের মানুষ জৈবিক চাহিদাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। নিজের চাওয়া-পাওয়ার কাছে অন্যরা ছিল তুচ্ছ। মানবতা, সভ্যতা, সৌজন্য—সব ছিল ভূলুণ্ঠিত। লড়াই আর লুটপাটে মনোবৃত্তি ছিল ষোলো আনা। আর এ যুগে আমরা সভ্যতার সর্বোচ্চ শিখরে। মহামনীষীদের অমৃতবাণী আর পদচিহ্ন আমাদের পথপ্রদর্শক। চাইলে, একটু শ্রম দিলে, একটু মেধা খেলালেই অনেক কিছু জোটে। এরপরও আমরা এত লোভী আর বর্বর কেন?
এখন আমাদের জীবনযাপনে এসেছে কত স্বাচ্ছন্দ্য! শ্বাপদসংকুল বনে হিংস্র প্রাণীর সঙ্গে টেক্কা দিয়ে শিকার করে খেতে হয় না। গাছের ছালবাকলে লজ্জা নিবারণ করতে হয় না। রংবেরঙের বাহারি কত পোশাকই না আমরা পরি! এরপরও লোভের আগুনে পোশাক পুড়িয়ে দিগম্বর হওয়ার এই প্রবণতা কেন?
অল্পে কারও তুষ্টি নেই। চাহিদা থেমে নেই। প্রযুক্তিগত উন্নতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে জীবনযাত্রার অনুষঙ্গ বাড়ছে। আরেকটু ভালো থাকতে গিয়ে প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব দিনরাত আমাদের ছাইচাপা উসকানি দিচ্ছে। এতে কাছের মানুষকে ভালোবেসে সহযোগিতা করার চেয়ে কনুই মেরে এগিয়ে যাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। কমছে মায়ামমতা, সহানুভূতি। ব্যক্তিগত উদগ্র চাহিদা সভ্যতার উর্বর ফসলি জমি থেকে আমাদের কি সেই অন্ধকার যুগের অরণ্যে ঠেলে দিচ্ছে না?
মাত্র কয়েক দিন আগে ঢাকার খিলগাঁওয়ে এক ফ্ল্যাটবাড়িতে দুই শিশুকন্যাকে গলাকাটা অবস্থায় মৃত উদ্ধার করে পুলিশ। অভিযোগের তির মায়ের দিকে। মাকেও পাওয়া যায় দগ্ধ অবস্থায়। পুলিশের সন্দেহ, দুই কন্যাশিশুকে হত্যা করে মা আত্মহত্যার চেষ্টা চালান। ভেতরে আসল ঘটনা কী, তা তদন্তে বের হবে। আমরা শুধু জানি যে এ ঘটনা মানবতার চরম বিপর্যয়, যা কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না, কিছুতেই আশা করা যায় না।
এমন ঘটনা এর আগেও অবশ্য ঘটেছে। ২০১৬ সালে রাজধানীর রামপুরার বনশ্রীতে জেসমিন নামের এক মা অরণী ও আলভী নামে তাঁর দুই শিশুসন্তানকে হত্যা করেন। ১৯ দিনের নবজাতককে বালতির পানিতে চুবিয়ে বাবার হত্যাকাণ্ড ও ছেলেশিশুকে বিক্রি করে দেওয়ার খবর সংবাদমাধ্যমে এসেছে। আপনজনের পাশবিকতায় সন্তানের সম্ভ্রমহানির এই খবরও আমরা প্রায়ই দেখি।
শুধু তা–ই নয়, মা-বাবার পরই যে শিক্ষক শিশুদের জন্য আরেকটি নির্ভরতার স্থান, সেখানেও সমস্যার ঘনঘটা। প্রায়ই বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের নৈতিক স্খলনের যেসব খবর সংবাদমাধ্যমে আসছে, এতে আদর্শের জায়গায় রীতিমতো ঘুণ ধরতে শুরু করেছে। মাত্র গতকাল সোমবারই প্রথম আলোর প্রথম পাতা ‘৫০ জনকে যৌন হয়রানি, ৪ প্রশিক্ষক প্রত্যাহার’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। চট্টগ্রামের পটিয়ায় পিটিআইয়ে ৫০ জন প্রশিক্ষণার্থী চার প্রশিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ তুলেছেন। এ নিয়ে রীতিমতো তোলপাড়। এক প্রশিক্ষক পর্যন্ত এ অভিযোগ তুলেছেন। শিক্ষক তৈরি হওয়ার পীঠস্থানের অবস্থা যদি এ রকম হয়, তাহলে ছেলেমেয়েদের শিক্ষা–দীক্ষার ভবিষ্যৎ কী? তাদের আদর্শিক প্রতিভূ আর কারা?
মা-বাবা আর শিক্ষকদের কাছ থেকে যদি আমাদের সন্তানেরা নির্ভরতার স্থান হারিয়ে ফেল, তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অবস্থাটা কী হবে? ছোট শিশুরা অবোধ হলেও তারা কিন্তু আপন-পর বোঝার ক্ষমতা রাখে। অবর প্রাণী একটা কুকুরও বুঝতে পারে, কে তাকে পছন্দ করছে, কে করছে না। যে পছন্দ করে, লেজ নাড়তে নাড়তে তার কাছে ভেড়ে। আর যে পছন্দ করে না, তার কাছ থেকে সে দূরে থাকে। আর এ তো মানবশিশু। এরা যদি এভাবে মা-বাবা আর শিক্ষকদের কাছে থেকে নির্ভরতার স্থান হারায়, সম্পর্ক আর সৌহার্দ্য নিয়ে সংশয় দেখা দেয়, তাহলে ভবিষ্যতে প্রজন্ম কেমন পেতে পারি আমরা?
আমরা আশা করব, অধিকতর তদন্তে প্রমাণিত হবে, আপন সন্তানের ঘাতক কোনো পিতা-মাতা নন। তাহলেও এটা তো সত্য যে শিশুরা এমন নিষ্ঠুরভাবে খুন হচ্ছে। সেটা করছে এই সমাজেরই মানুষ। তাহলে এই সমাজের ভবিষ্যৎ কী?
মানুষখেকো হিসেবে হোয়াইট শার্কের পরই টাইগার শার্কের অবস্থান। নির্বিচার খাদক হিসেবে এর পরিচিতি রয়েছে। এদের চোয়াল অপরিমেয় শক্তির অধিকারী। এরা দিনের বেলায় থাকে গভীর সাগরে, রাতে অগভীর পানিতে চলে আসে। চলে শিকার অন্বেষণ। এরা জন্ম থেকেই নির্মম। মা হাঙরের গর্ভাশয়ে ৫০টির মতো নিষিক্ত ডিম্বাণু থাকে। এগুলো বড় হয়ে মায়ের পেটেই পোনা আকারে বেরোতে থাকে। আর একটি পোনা আরেকটিকে সাবাড় করতে থাকে। শক্তিশালী পোনা দুর্বলটিকে খেতে থাকে। এভাবে খেতে খেতে শেষে টেকে মাত্র একটি। তা অনেক বড় হয়ে মায়ের পেট থেকে বেরোয়। আর বেরিয়েই দেয় ভোঁ–দৌড়। কারণ, মা যদি তাকে খেয়ে ফেলে!
শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া: প্রথম আলোর সহকারী বার্তা সম্পাদক ও লেখক।
shariful.bhuiyan@prothomalo.com