আমাদের নির্বাচন কমিশনে আবারও নিয়োগ নিয়ে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে। সম্প্রতি চার কমিশনারের মতামত না নিয়েই সিইসি ও কমিশনের সচিব কর্তৃক ৩৩৯ জন কর্মচারীর নিয়োগ নিয়ে এ দ্বন্দ্ব, যা স্বেচ্ছাচারিতার পর্যায়ে পৌঁছেছে বলে একজন কমিশনারের দাবি। স্মরণ করা যেতে পারে যে বর্তমান হুদা কমিশন গঠনের পরপরই অন্য কমিশনারদের না জানিয়ে সিইসি ও সচিবের উদ্যোগে সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের বদলি নিয়ে ইসি ও নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারের মধ্যে প্রথম বিরোধ দেখা দেয়। অন্য তিন কমিশনার তখন নীরব ছিলেন, যদিও ইসি সে সময় বলেছিলেন যে বদলির বিষয়ে কমিশনারদের জানারও প্রয়োজন নেই (প্রথম আলো, ১৬ জুলাই ২০১৭)। আমরা মনে করি, ইসি সচিবের অবস্থান শুধু অনাকাঙ্ক্ষিতই নয়, বিদ্যমান আইন, এমনকি আমাদের সংবিধানের সঙ্গেও অসামঞ্জস্যপূর্ণ।
উল্লেখ্য, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব তথা নিজেদের স্বার্থহানির কারণে ইসি সচিব ও অন্যান্য কমিশনারের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হলেও জনস্বার্থ সমুন্নত রাখতে তাঁদের মধ্যে তেমন কোনো উদ্যোগ ও বিরোধ পরিলক্ষিত হয় না। উদাহরণস্বরূপ, ১১তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে যে জালিয়াতি ঘটেছে, যেখানে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২-এর ষষ্ঠ অধ্যায়ের ৭৩-৮৯ ধারায় বর্ণিত প্রায় সব নির্বাচনী অপরাধে প্রশাসনিক ও নির্বাচনী কর্মকর্তা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা জড়িত হয়ে জনগণের ভোটাধিকার হরণ করেছেন, সেখানে মাহবুব তালুকদারের ক্ষীণ প্রতিবাদ ছাড়া অন্য সবাই ছিলেন নিশ্চুপ। তাঁরা আরও নিশ্চুপ ছিলেন প্রশিক্ষণের নামে জনগণের অর্থ লোপাটের ব্যাপারে। তাই এটি সুস্পষ্ট যে আমাদের সিইসি এবং অন্তত তিনজন নির্বাচন কমিশনার জনস্বার্থের পরিবর্তে ব্যক্তিস্বার্থ দ্বারাই পরিচালিত হচ্ছেন।
জনস্বার্থ জলাঞ্জলি প্রদান ও জনগণের ভোটাধিকার হরণের মাধ্যমে বর্তমান নির্বাচন কমিশন আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থা ভেঙে ফেলেছে। উপজেলা নির্বাচনে ভোটারদের অনুপস্থিতি তারই প্রমাণ বহন করে। তবে নির্বাচনী ব্যবস্থা ভেঙে যাওয়ার সুদূরপ্রসারী পরিণতি রয়েছে। নির্বাচনই শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা বদলের একমাত্র পন্থা। তাই নির্বাচনী ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে গেলে নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা রদবদলের পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে, যা দীর্ঘমেয়াদিভাবে কারও জন্যই কল্যাণ বয়ে আনবে না। এমনি প্রেক্ষাপটে আমরা আশা করেছিলাম যে জনগণের বিশ্বাস ভঙ্গ করার দায় মাথায় নিয়ে বর্তমান নির্বাচন কমিশন স্বপ্রণোদিত হয়েই তাঁদের সাংবিধানিক পদ থেকে সরে দাঁড়াবেন। কিন্তু আত্মমর্যাদাবিবর্জিত এবং নির্বাচনী, এমনকি সম্ভাব্য ফৌজদারি অপরাধে জড়িত এই কমিশন নিয়ে আমরা এখন কী করব! এ ব্যাপারে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের মাধ্যমে মহামান্য রাষ্ট্রপতিকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
এবার নিয়োগ-বদলি নিয়ে কমিশনের মধ্যে দ্বন্দ্বের বিষয়ে আসা যাক। অনেকেরই স্মরণ আছে যে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে কমিশনকে সহায়তার জন্য নির্বাচন কমিশন সচিবালয় আইন, ২০০৯-এর মাধ্যমে কমিশনের একটি স্বতন্ত্র সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। আইনের প্রস্তাবনায় সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, এটি ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১১৮ (৪) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন এবং স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে উহার জন্য একটি স্বাধীন সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় বিধান প্রণয়নকল্পে প্রণীত আইন।’
আর এই স্বাধীন সচিবালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একজন সচিবসহ বেশ কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়ে। অনেকের আরও স্মরণ থাকার কথা যে কমিশন যাতে নির্বাচন পরিচালনার ক্ষেত্রে সরকারের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে পারে, সে লক্ষ্যে ড. হুদা কমিশনের আমলে কমিশনে বেশ কিছু কর্মকর্তা নিয়োগ পান। এসব নিয়োগের উদ্দেশ্য ছিল গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের লক্ষ্যে কমিশনকে দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা। বস্তুত, কমিশনের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর দায়িত্বই হলো কমিশনকে সহায়তা প্রদান। তাই তাঁদের নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতির এখতিয়ার কমিশনেরই হওয়া আবশ্যক। কারণ, কমিশনেরই সাংবিধানিক দায়িত্ব সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করা। কমিশনের সচিব বা অন্য কোনো কর্মকর্তার ওপর এ দায়িত্ব অর্পণ করা হয়নি। অর্থাৎ কমিশনের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর ‘বস’ বা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ নির্বাচন কমিশন।
তবে নির্বাচন কমিশন সচিবালয় আইনের ৫(১) ধারা অনুযায়ী ‘সচিব নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের প্রশাসনিক প্রধান হইবেন’। আইনের ৪(১৩) (খ) উপধারা অনুযায়ী, সচিবের দায়িত্ব ‘নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে কর্মকর্তা ও কর্মচারীগণের প্রশাসন ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা’। এ ছাড়া আইনের ৪(১৩) (ছ) উপধারায় সচিবকে ‘মাঠপর্যায়ের অফিসারসমূহের প্রশাসন ও নিয়ন্ত্রণে’র দায়িত্বও দেওয়া হয়েছে। আর সচিবের এসব দায়িত্ব পালন করার উদ্দেশ্য হলো সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনার ক্ষেত্রে কমিশনকে সহায়তা প্রদান। আইনের ৪(১) ধারায় সুস্পষ্টভাবে বলা আছে, ‘নির্বাচন কমিশন সচিবালয় নির্বাচন কমিশনের প্রয়োজনীয় সকল সাচিবিক দায়িত্ব পালন করিবে এবং নির্বাচন কমিশন কর্তৃক উহার ওপর অর্পিত অন্যান্য যাবতীয় দায়িত্ব সম্পাদন করিবে।’ অর্থাৎ সচিবেরও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ নির্বাচন কমিশন এবং দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে তিনি কমিশনের নিকট দায়বদ্ধ।
নির্বাচন কমিশন সচিবালয় আইনে নির্বাচন কমিশনের কাছে এ দায়বদ্ধতার কথা আরও সুস্পষ্ট করা হয়েছে। আইনের ১৪(১) ধারা অনুযায়ী, ‘নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের যাবতীয় দায়িত্ব সম্পাদনের জন্য সচিব প্রধান নির্বাচন কমিশনারের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনের নিকট দায়ী থাকিবেন’। অর্থাৎ আইনে সচিবকে সুস্পষ্টভাবে কমিশনের কাছে দায়বদ্ধ করা হয়েছে, যদিও সিইসির মাধ্যমে। তাই সিইসির অন্য কমিশনারদের পাশ কাটিয়ে সচিবকে নিয়ে কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের এখতিয়ার নেই, কারণ, কমিশন একটি যৌথ সত্তাসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান (Composite body) [জাতীয় পার্টি বনাম ইলেকশন কমিশন [৫৩ ডিএলআর (এডি) (২০০১)]।
এমনকি অন্য কমিশনারদের বাদ দিয়ে সিইসি এককভাবে কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তও নিতে পারেন না। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২-এর ধারা ৪ অনুযায়ী, ‘কমিশন উহার চেয়ারম্যান বা উহার কোনো কর্মকর্তাকে এই আদেশের অধীন উহার সকল বা যে কোন কর্তব্য বা দায়িত্ব পালন করিবার জন্য ক্ষমতা অর্পণ করিতে পারিবে’। অর্থাৎ পুরো কমিশন প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে দায়িত্ব না দিলে তিনি এককভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। জাতীয় পার্টি বনাম ইলেকশন কমিশন মামলায় বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ সুস্পষ্টভাবে বলেছেন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের অধীনে যেকোনো দায়িত্ব পালন বা ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে অবশ্যই কমিশন থেকে ক্ষমতাপ্রাপ্ত হতে হবে, অন্যথায় তাঁর কার্যক্রম এখতিয়ারবহির্ভূত (Coram nonjudice) হবে।’
ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের একটি বিখ্যাত রায় প্রধান নির্বাচন কমিশনারের ক্ষমতার পরিধি আরও সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেছে। পাঠকদের কারও কারও হয়তো জানা আছে যে ভারতের স্বনামধন্য সিইসি টি এন সেশন একসময় সিইসি হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত একমাত্র কমিশনার ছিলেন। ভারত সরকার ১৯৯৩ সালে আরও দুজনকে কমিশনে নিয়োগ দেয়, যা জনাব সেশন মেনে নেননি। ফলে কমিশনে দ্বন্দ্ব দেখা দেয় এবং সিইসি নিজে ও একাধিক নাগরিক উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হন। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট রায়ে সুস্পষ্টভাবে বলেন যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার, কমিশনের সভাপতি এবং “...সভাপতির দায়িত্ব হবে সভায় সভাপতিত্ব করা, নিয়মকানুন বজায় রাখা, দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনা করা, সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও লিপিবদ্ধকরণ নিশ্চিত করা এবং এর কার্যক্রম নির্ঝঞ্ঝাটভাবে পরিচালনার লক্ষ্যে যা কিছু প্রয়োজন তা করা।...তাঁর দায়িত্ব হলো সভায় এমনভাবে আচরণ করা, যাতে তিনি তাঁর সহকর্মীদের আস্থা ও সম্মতি অর্জন করতে পারেন। একজন সভাপতি এটি অর্জন করতে সক্ষম হবেন না, যদি তিনি কমিশনের অন্য সদস্যদের তাঁর অধস্তন মনে করেন...যদি সিইসিকে ঊর্ধ্বতন হিসেবে ধরে নেওয়া হয়, এই অর্থে যে তাঁর কথাই চূড়ান্ত, তাহলে তিনি পুরো কমিশনকেই অকার্যকর ও আলংকারিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করবেন।’
প্রসঙ্গত, নির্বাচনসংক্রান্ত ভারতীয় ও বাংলাদেশের সাংবিধানিক বিধান—যথাক্রমে অনুচ্ছেদ ৩২৪ এবং ১১৮ ও ১১৯—প্রায় একই রকম এবং আমাদের সংবিধানেও সিইসিকে কমিশনের সভাপতি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তাই কমিশনে চলমান দ্বন্দ্বের ক্ষেত্রে সিইসি এবং সচিবের অবস্থান সম্পূর্ণরূপে আইনের পরিপন্থী।
ড. বদিউল আলম মজুমদার: সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক