এফডিসিকেন্দ্রিক চলচ্চিত্রশিল্প এখন মৃতপ্রায়। সিনেমা হল বন্ধ হতে হতে এখন দেশের অনেক জেলাতেই একটি সিনেমা হলও অবশিষ্ট নেই। যেখানে সিনেমা হলই নেই, সেখানে সিনেমা নির্মাণের সংখ্যাও অনেক কমে গেছে। হাতে গোনা কয়েকজন বাদে নিদারুণ অভাব আর কষ্টের মধ্য দিয়েই শত শত শিল্পী, কলাকুশলী দিনাতিপাত করছেন। কেউ কেউ এরই মধ্যে পেশা বদল করেছেন। কেউবা ঢাকা শহর ছেড়ে গ্রামে চলে গেছেন। যে এফডিসি থেকেই একসময় তৈরি হয়েছে ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’, ‘জীবন থেকে নেয়া’, ‘সারেং বউ’, ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’, ‘ভাত দে’, ‘নয়নমনি’, ‘অনন্ত প্রেম’-এর মতো অসংখ্য ভালো ও বাণিজ্যিক ছবি; সেখানে এখন তা প্রত্যাশা করা মানেই যেন আকাশকুসুম কল্পনা!
ঢাকার বাংলা সিনেমায় যখন এই দুর্দিন, তখন কিছুটা হলেও মুখরক্ষা করছে ‘রেহানা মরিয়ম নূর’, ‘রিকশা গার্ল’, ‘গুণিন’, ‘মৃধা বনাম মৃধা’র মতো কয়েকটি ছবি। ভবিষ্যতে এফডিসির ফর্মুলার বাইরে গিয়েও স্বাধীন চলচ্চিত্রকারেরা হয়তো বাংলা সিনেমার বিজয় নিশান তুলে ধরবেন, তা প্রত্যাশা করতেই পারি।
ঢাকায় সিনেমা বানাতেও অনেক ঝক্কিঝামেলা পোহাতে হয়। কয়েকটি সংগঠনের অনুমতি নিতে হয়, চাঁদা দিতে হয়। এফডিসিতে ২৭টি সংগঠন। ২৭টি ছবি হবে কি না, তার কোনো ঠিকঠিকানা না থাকলেও সারা বছর ধরে ২৭টি সংগঠনের নির্বাচন, বনভোজন নিয়ে এফডিসি থাকে সরগরম। এখানে সারা বছরই ২৭টি সংগঠনের মধ্যে রয়েছে একে অন্যের বিরুদ্ধে কাদা-ছোড়াছুড়ি আর বিষোদ্গার।
এই শিল্পের সবচেয়ে বড় সংগঠন চলচ্চিত্র প্রযোজক পরিবেশক সমিতি। যারা চলচ্চিত্রশিল্পের ভালোমন্দ দেখভাল করে, সেখানেই স্থবিরতা। একের পর এক মামলার কারণে সঠিক নেতৃত্ব আসছে না। আবার এখানে শুধু ভোটের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য শাপলা মিডিয়ার স্বত্বাধিকারী সেলিম খান একাই ১০০টি ছবি নির্মাণের ঘোষণা দিয়ে প্রায় ৬০টি ছবি বানিয়ে ফেলেছেন। পরে জানা গেল, চাঁদপুরের ‘বালুখেকো’ হিসেবে পরিচিত সেলিম খান তিনি। তিনি এখানেই ৫৪টি ভোটের মালিক বনে গিয়েছিলেন এবং নিজেই এবারের প্রযোজক পরিবেশক সমিতির সভাপতি পদে নির্বাচন করছেন। তবে একই টিন নম্বরে এত ভোটার করার বিষয়টি আইনসম্মত নয় বলে অনেকের ভোটাধিকার নাও থাকতে পারে। এখন প্রশ্ন হলো, সেলিম খান যদি চলচ্চিত্রশিল্পের প্রধান সংগঠনের সভাপতি বনে যান, তবে এই শিল্পের কী ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে?
এবার নজর দেওয়া যাক চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির দিকে। যে কারণে আজ এই লেখার অবতারণা। বছরের শুরু থেকেই চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচন নিয়ে চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। নির্বাচনের আগে একধরনের উত্তেজনা, নির্বাচন শেষ হয়ে যাওয়ার পর আবার নতুন করে উত্তেজনা। নির্বাচনের কয়েক মাস পেরিয়ে গেছে। সাধারণ সম্পাদক কে, তা নিয়ে চলছে উচ্চ আদালতে মামলা। আপাতদৃষ্টে ইলিয়াস কাঞ্চন-নিপুণ সমিতি চালাচ্ছেন। জায়েদ খানের বিরুদ্ধে অনেক সমালোচনা শোনা যায়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এরপরও তিনি এতটা শক্তিশালী কেন? কারণ, জায়েদ খানের সঙ্গে আছেন চলচ্চিত্রের আরেক আলোচিত-সমালোচিত ডিপজল। এমনকি সোহেল রানা বা উজ্জ্বলের মতো দুজন সিনিয়র শিল্পীরও সমর্থন রয়েছে জায়েদ খানের প্রতি। এসবই তাঁর শক্তির উৎস। গত নির্বাচনের আগের নির্বাচনে মৌসুমী-ওমর সানী ছিলেন জায়েদের প্রধান প্রতিপক্ষ। আর গতবার আমরা কী দেখলাম? মৌসুমী-ওমর সানী জায়েদ খানকে নিয়ে প্যানেল করে নির্বাচন করেছেন। ওমর সানী জায়েদের জন্য প্রকাশ্যে ভোট চেয়েছেন, জায়েদের জন্য ছিলেন অন্তঃপ্রাণ।
সিনেমা হলের বিনোদন সিনেমায় না থাকলে কী হবে! এফডিসিতে কিন্তু হরহামেশা এসব ঘটনা ঘটছেই। এ ঘটনাগুলো থেকে আসলে লাভবান কে হলেন? প্রথম লাভবান হলেন জায়েদ খান। ক্লিন চিট সার্টিফিকেট পেয়ে গেছেন। অন্যদিকে তাঁর কোনো কাজ নেই। কোনো শুটিং নেই, কিন্তু বছরে এ রকম একেকটি ঘটনার কারণে তিনি আলোচনায় থাকছেন।
ওমর সানী যখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মৌসুমী ও জায়েদ খানের একসঙ্গে কাজ করার পেছনে তাঁর যুক্তি তুলে ধরতে লাইভে যুক্ত হন, তখন শত শত ভক্ত ওমর সানী ও মৌসুমীকে গালমন্দ করেছেন। চলচ্চিত্রে মৌসুমী ও ওমর সানীর বন্ধু বা শুভাকাঙ্ক্ষীরাও তাঁদের বুঝিয়েছেন তাঁরা যেন জায়েদের সঙ্গে নির্বাচন না করেন। কিন্তু মৌসুমী ও সানী ছিলেন তাঁদের সিদ্ধান্তে অটল। কেউ কেউ জানতে চাইতেন যে মৌসুমী কেন এমন উদ্ভট সিদ্ধান্ত নিলেন? এর পেছনে যে গল্পটি শোনা যায় তা এমন—জায়েদ খান আলোচনায় থাকলেও তাঁর কোনো জনপ্রিয় সিনেমা নেই। অভিনেতা হিসেবে একটি ইতিবাচক ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে তাঁর একটি সিনেমার দরকার ছিল। ‘সোনার চর’ নামের একটি সিনেমায় জায়েদ খানের সঙ্গে মৌসুমীকে মিলিয়ে দেন এর পরিচালক জাহিদ হোসেন। সেখানে সানীও একটি বিশেষ চরিত্রে কাজ করছেন। তখন থেকেই তাঁদের মধ্যে হৃদ্যতা গড়ে ওঠে। যে ওমর সানী ও মৌসুমী জায়েদের নাম পর্যন্ত শুনতে চাইতেন না, সেই জায়েদ খানকে তাঁরা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্যোগ নেন। যদিও আরেক চিত্রনায়িকা পপি বারবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এসে বলেছেন, জায়েদ নায়িকাদের ব্ল্যাকমেল করেন, তাঁকেও ব্ল্যাকমেল করেছেন।
এবারে সব গুজবে বোমা ফাটালেন ওমর সানী নিজেই। ডিপজলের ছেলের বিয়েতে গিয়ে জায়েদ খানকে নাকি কষে থাপ্পড় দিয়েছেন। অভিযোগ, জায়েদ তাঁর স্ত্রী মৌসুমীকে ডিস্টার্ব করছেন। অন্যদিকে ঘটনাটি সত্য হলেও রোজিনা, ডিপজল, অঞ্জনার মতো সিনিয়র শিল্পীরা (তাঁরা সবাই জায়েদ খানের সঙ্গে নির্বাচন করে জয়ী হয়েছেন) বেমালুম অস্বীকার করেছেন। ওমর সানী দাবি করেছেন, জায়েদ তাঁকে থাপ্পড় মারার কারণে পিস্তল দিয়ে গুলি করার হুমকি দিয়েছেন।
চলচ্চিত্রশিল্পে চলচ্চিত্র নেই, ভালো গল্প নেই, তাই বুঝি তাঁরা এখন নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনকে টেনে আনছেন। ওমর সানী শিল্পী সমিতিতে জায়েদের বিরুদ্ধে সংসার ভাঙার চেষ্টার অভিযোগ করে বিচার চেয়েছেন। আর পরের দিন মৌসুমী নিজের অডিও বার্তা দিয়ে জানিয়ে দিলেন, ‘জায়েদ ভালো ছেলে, সে আমাকে কোনো দিন ডিস্টার্ব করেনি। ওমর সানী মিথ্যাচার করেছে।’ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যদিও মৌসুমীকে তাঁর ভক্তরা গালমন্দ করছেন, কিন্তু মৌসুমীর এই সার্টিফিকেট জায়েদ খানকে বীরের বেশে মিডিয়ার সামনে কথা বলার সুযোগ করে দিয়েছে। এ ঘটনার নাটকীয়তা এখানেই শেষ নয়। এবার ওমর সানী মাঠে নামালেন তাঁর ছেলে ফারদিনকে। ফারদিন মিডিয়ায় জানিয়ে দিলেন, তাঁর বাবা মিথ্যা বলেননি। জায়েদ খান তাঁর মাকে ডিস্টার্ব করেছেন। এর প্রমাণও আছে। ছেলে ফারদিন বলেছেন, ‘আমাদের পরিবারের সমস্যা চলছে, আছে, এটা মিটে যাবে।’
এ ঘটনার পর ইউটিউবাররা আছেন তাঁদের ভিউ বাড়ানোর জন্য চটকদার শিরোনাম দিয়ে ভরপুর গপ্প সাজাতে। বিভিন্ন মিডিয়াও ঝাঁপিয়ে পড়েছে। সিনেমা হলের বিনোদন সিনেমায় না থাকলে কী হবে! এফডিসিতে কিন্তু হরহামেশা এসব ঘটনা ঘটছেই।
এ ঘটনাগুলো থেকে আসলে লাভবান কে হলেন? প্রথম লাভবান হলেন জায়েদ খান। ক্লিন হিসেবে সার্টিফিকেট পেয়ে গেছেন। অন্যদিকে তাঁর কোনো কাজ নেই। কোনো শুটিং নেই, কিন্তু বছরে এ রকম একেকটি ঘটনার কারণে তিনি আলোচনায় থাকছেন। মানুষ তাঁকে চিনছে। এদিকে অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বলছেন যে মৌসুমী পরিস্থিতির শিকার। তিনি জায়েদের শিখিয়ে দেওয়া বাক্য পাঠ করেছেন? মৌসুমী কেন তা করবেন? এর কারণ হলো, মৌসুমী কোনো না কোনোভাবে জায়েদের প্রতি আস্থা রাখছেন। ফারদিন ও ওমর সানী তাঁদের হাতে রাখা প্রমাণগুলো জনসমক্ষে নাও আনতে পারেন। কারণ, এতে মৌসুমী এত দিন যে ভালো একটি ইমেজ নিয়ে ছিলেন, তাতে দাগ পড়ে যাবে। অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না, যদি শোনা যায় যে মৌসুমী বলছেন, আমি পরিস্থিতির স্বীকার। কিন্তু এসব ঘটনায় সবচেয়ে ক্ষতি হয়ে গেল সিনেমার। এমনিতে দর্শক মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। এসব ঘটনার পর এখন অনেক বেশি সমালোচনা হচ্ছে, ফলে শিল্পীদের প্রতি সাধারণ মানুষের যে সম্মান ও ভালোবাসা ছিল, তা-ও শেষ হয়ে যাচ্ছে।
পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে বলা যায়, এই শিল্পে আরও কিছু ঘটনা ঘটবে। হয়তো কাল অথবা পরশু। নতুন নতুন স্থূল বিনোদন আমরা দেখব। আর এভাবেই একদিন এই এফডিসিকে জাদুঘরে অথবা খাদ্যশস্যের গুদামে রূপ দেওয়া হবে। এফডিসির অন্ধকারাচ্ছন্ন ফ্লোরগুলোতে এখন ভুতুড়ে পরিবেশ। লাইট-ক্যামেরা-অ্যাকশনের কোনো আওয়াজ নেই। চাঁদপুরের সেলিম চেয়ারম্যানের বালু বিক্রির টাকায় এত দিন যে ছবি হচ্ছিল, সেটাও স্বাভাবিকভাবেই বন্ধ হয়ে যাবে। চলচ্চিত্রের প্রতি ভালোবাসা আছে এমন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যদি আর দশটা স্বাভাবিক ব্যবসার মতোই একে দাঁড় করানোর উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে না আসে, তবে চলচ্চিত্রশিল্পের জন্য অন্ধকার সময় অপেক্ষা করছে। আর সেই সুযোগে এসব তামাশা ঘটেই চলবে। হতাশ হয়ে আমরা শুধু দীর্ঘশ্বাস ছাড়তে পারি, এই চলচ্চিত্রশিল্প লইয়া কী করিব!
কামরুজ্জামান বাবু সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি