‘হামার মতো কোনো মেয়ে যেন এই বয়সে বিধবা না হয়। হামার স্বামীক যামরা মারছে, তার বিচার চাই।’ এ কথা বলতে বলতে সদ্য বিধবা রহিমা বেগমের আর্তনাদ বেড়ে যায়। তিনি আর কথা বলতে পারেন না। পাশে দাঁড়ানো অনেকের চোখে পানি চলে আসে। স্বামী হাবিবুর রহমান ফেরদৌসের মৃত্যু রহিমা বেগম কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না। পারার কথাও নয়। পাশেই ১৩-১৪ বছর বয়সী মেয়ে ফারজানা ফেরদৌসী করুণ আর্তনাদ করে জানতে চায়, ‘আমাকে বলেন তো, বাসস্ট্যান্ড ছাড়া কি যাত্রীকে নামে (নামিয়ে) দেওয়ার নিয়ম আছে? রাস্তার সাইড না করে মাঝখানে কি নামে দেওয়া যায়? আমার ভাইটা যে পাগল হয়া গেল, তার কী হইবে? এসএসসি পরীক্ষা দেবে কেমন করি?’ হাবিবুর রহমানের মা হালিমা বেওয়া বিলাপ করেই চলেছেন, ‘৩৫ বছর আগোত স্বামী মরি গেইচে। কষ্ট করি ছাওয়া মানুষ করছি। সেই ছাওয়াটাক মারি ফেলাইল। এর বিচার চাই।’ গত ২৪ জানুয়ারি বিকেলে কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলার ঠগেরহাটে হাবিবুর রহমান ফেরদৌসের মামা আবুল হোসেনের বাড়িতে গিয়েছিলাম। নিজেদের জমি না থাকায় মামার জমিতেই তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত হন। সেখানেই কথা হয় হাবিবুর রহমানের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে।
হাবিবুর রহমান ফেরদৌসের বাড়ি কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলায়। গাজীপুরে থাকতেন। স্মার্টকার্ড নিতে এসেছিলেন চিলমারী। সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী ও সপ্তম শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়ে। ২২ জানুয়ারি রাতে উলিপুর থেকে থ্রি স্টার বাসে ঢাকা রওনা করেন। ২৩ জানুয়ারি সকাল ছয়টায় বাস থেকে নামেন ঢাকা বাইপাসে। সেখান থেকে হোতাপাড়া যাওয়ার জন্য আলিফ পরিবহনে উঠেছিলেন। কিছুদূর পরেই চৌরাস্তায় শ্যামলী পরিবহনের একটি বাসের সঙ্গে আলিফ পরিবহনের ধাক্কা লাগে। এরপরই দুই বাসের মধ্যে চলে ধাক্কা দেওয়ার প্রতিশোধ। পাল্লা দিয়ে চলতে থাকে গাড়ি দুটি। একসময় হোতাপাড়া ছেড়ে চলে যাচ্ছিল বাসটি। অন্য যাত্রীদের নামিয়ে দিলেও এই পরিবারের কাউকে নামতে দিচ্ছিল না। অনেকবার বলার পর বাস সাইড না করেই হাবিবুর রহমান ফেরদৌসকে চলন্ত বাস থেকে রাস্তার মাঝামাঝি নামিয়ে দেওয়া হয়। রহিমা বেগম ও ফারাজানাকে নিয়ে বাসটি চলে যাচ্ছিল। বাসের মধ্যে আরও কয়েকজন পুরুষ যাত্রী ছিলেন। ভয়ে রহিমা বেগম বাসের সহকারীর শার্ট ধরে টানাটানি আর চিৎকার শুরু করলে তাঁদের একটু সামনেই নামিয়ে দিতে বাধ্য হন। তাঁরা পেছনে ফিরেই দেখতে পান, হাবিবুর রহমানকে ধাক্কা দিয়ে চলে যাচ্ছে একটি বাস। তাঁকে গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে বহির্বিভাগীয় মেডিকেল অফিসার ভর্তির টিকিটে মৃত লিখে দেন।
হাবিবুর রহমানের অসচ্ছল পরিবারে যখন একটুখানি সচ্ছলতার আলো ফুটতে শুরু করেছিল, তখনই না-ফেরার দেশে চলে যান তিনি। প্রায় ৩৫ বছর আগে তাঁদের সমস্ত জমি ব্রহ্মপুত্রের গর্ভে বিলীন হয়। তখনই অবস্থাসম্পন্ন এ গৃহস্থ পরিবার পথে নামে। সেই সময়ে তাঁর বাবাও মারা যান। তাঁর মা হালিমা বেওয়া কখনো ভাইয়ের বাড়িতে, কখনো নদী রক্ষা বাঁধের ওপর টিনের চালাঘর করে সন্তানকে মানুষ করেছেন। তাঁদের কোনো জমি নেই। চিলমারীর ব্যাপারীরহাটে ২ শতাংশ জমির মূল্য পরিশোধ করেছেন। এখনো সেই জমিও রেজিস্ট্রি করে নেননি।
হাবিবুর রহমান রংপুরে একসময় কাঠমিস্ত্রির কাজ করতেন। যে সামান্য আয় হতো, তাতে তিন বেলার খাবার জুটত না। বাধ্য হয়ে ঢাকায় যান। সেখানেও কাঠমিস্ত্রির কাজে সুবিধা করতে পারেননি। রহিমা বেগমের একটি গরু ছিল। সেই গরু বিক্রি করে, সমিতি থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে ছোট একটি মুদির দোকান দিয়েছিলেন। বড় ছেলে মাহমুদুর রহমান টাইলসের কারখানায় কাজ করে নিজের লেখাপড়ার খরচ নিজেই চালান। বাবা-মাকেও সহযোগিতা করেন। তিনি এখন স্নাতক শ্রেণিতে পড়ছেন। ছোট ছেলে রাকিবুল হাসান এ বছর এসএসসি পরীক্ষার্থী। বাবার মৃত্যুতে শোকে পাগলপ্রায়। ১ ফেব্রুয়ারি খবর নিয়ে জানলাম, সে আগের তুলনায় কিছুটা স্বাভাবিক।
ঢাকা থেকে অনেক দূরের সীমান্তবর্তী জেলা কুড়িগ্রাম। এ জেলা থেকে অসংখ্য বাস ঢাকায় যায়। এই বাসগুলোর বড়সংখ্যক যাত্রী ঢাকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক। এই শ্রমিকদের জন্য কুড়িগ্রাম থেকে ঢাকা যাওয়ার মানসম্মত ট্রেন জরুরি। প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনায় কুড়িগ্রামের অসংখ্য মানুষ মারা যায়। কিন্তু ট্রেনের ব্যবস্থা আজও গড়ে ওঠেনি। ২৩ জানুয়ারি সকালে হাবিবুর রহমানের মৃত্যুকে সড়ক দুর্ঘটনা বলা যাবে না। এটি স্পষ্টত খুন। এই খুনের কি বিচার হবে? মৃত হাবিবুর রহমানের পরিবারের খাওয়া, পরা, বাসস্থান, চিকিৎসা—সবকিছুই অনিশ্চিত। এই অবস্থায় তারা আইনি লড়াইয়ে যেতে পারবে বলে মনে হয় না। তাই বলে এত বড় অপরাধ বিচারবিহীন থাকবে, এটা তো হতে পারে না।
সড়কের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ কতটা আছে, তা বারবার প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। সড়ক দিনের পর দিন মৃত্যুপুরীতে পরিণত হচ্ছে। সড়ককে নিরাপদ করার কোনো কার্যকর ভূমিকা আজ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
২৩ জানুয়ারি সকালে আলিফ পরিবহনের কোন গাড়ি ওই রুটে ছিল—এটা খুঁজে পাওয়া কঠিন কিছু নয়। শ্যামলী পরিবহনের ওই বাসের নম্বর মনে রেখেছে মৃত হাবিবুর রহমানের মেয়ে ফারজানা ফেরদৌসী। ২৭ জানুয়ারির দৈনিক সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে দেখলাম, শ্যামলী পরিবহনের বাসটির নম্বর ঢাকা মেট্রো-ক ৫০৮৩ উল্লেখ করা হয়েছে। সেই নম্বর দিয়ে শ্যামলী পরিবহনের বাসটিও খুঁজে পাওয়া সম্ভব। রাষ্ট্র কি এই অপরাধীদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করবে? হাবিবুর রহমানকে আর ফেরানো যাবে না। কিন্তু বিচার হলে হাবিবুর রহমানের স্ত্রী, সন্তান, মা, ভাই, বোন—সবাই কিছুটা শান্তি পাবেন। আর এই দৃষ্টান্তমূলক বিচার সড়কপথের এই অসুস্থ গাড়ি চালানো এবং বাস সাইড না করে সড়কের মাঝখানে যাত্রী নামিয়ে দেওয়া কিছুটা হলেও রোধ করবে। মানুষকে ভালো হতে হলে আইন এবং মানবিক মূল্যবোধ দুটিরই প্রয়োজন। আমাদের পরিবার-প্রতিষ্ঠান-সমাজ-রাষ্ট্র মানবিক মূল্যবোধ সৃষ্টিতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। রাষ্ট্র চাইলে আইনের শাসন তো প্রতিষ্ঠা করতে পারে।
৩৫ বছর আগে চিলমারীর ব্রহ্মপুত্র সব সম্পদ কেড়ে নিয়ে হাবিবুর রহমানের পরিবারকে পথে বসিয়েছিল, আর ৩৫ বছর পর রাজধানীর সড়কের অব্যবস্থাপনা কেড়ে নিল জীবন। কোথায় তবে নিরাপত্তা?
লেখক: তুহিন ওয়াদুদ, রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক এবং রিভারাইন পিপলের পরিচালক
wadudtuhin@gmail.com