তাৎক্ষণিক

উল্টোপথে গাড়ি কেন চলে?

প্রথম আলোর প্রথম পাতায় (১৪ অক্টোবর) একটি ছবি ছাপা হয়েছে। ছবির ক্যাপশনের শিরোনাম: ‘উল্টোপথে গাড়ি’। গাড়িটির ধরন দেখলেই বোঝা যায়, এর সঙ্গে কোনো না কোনো ক্ষমতা জড়িয়ে আছে। ঢাকা শহরে এ ধরনের গাড়িগুলো বেশ দম্ভ নিয়েই চলে। ক্ষমতা ও দম্ভ মিলেমিশে একাকার হয়ে গেলে যা হওয়ার তা-ই হয়েছে৷ সব গাড়ি যে পথে যায়, এসব গাড়ি সে পথ দিয়ে আসে অথবা সব গাড়ি যে পথে আসে, এসব গাড়ি সে পথে যায়!
সমস্যা হচ্ছে এ ধরনের গাড়ির সংখ্যা নিয়ে। বাংলাদেশে ক্ষমতাবানের সংখ্যা কী হারে বাড়ছে, প্রবৃদ্ধি কত—এসবের হিসাব-নিকাশ কোনো গবেষণা প্রতিষ্ঠান করে বলে জানা নেই। তবে অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এই প্রবৃদ্ধি সম্ভবত অন্য সব ক্ষেত্রকে ছাড়িয়ে যাবে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ক্ষমতাবানের দম্ভও। নইলে ঢাকা শহরে এত গাড়ি উল্টোপথে চলবে কেন, আর এর সংখ্যাই দিনে দিনে এত বাড়বে কেন! তবে ‘ক্ষমতাবান’ হয়ে ওঠা ও এর সঙ্গে দম্ভ যোগ হওয়ার বিষয়টি এখন শুধু আর রাজনীতিবিদ বা মন্ত্রী-সাংসদদের মধ্যেই আটকে নেই। আমলা, পুলিশ-র্যাব থেকে শুরু করে আইনজীবী বা সাংবাদিকদের মধ্যেও তা প্রবল হয়ে উঠেছে। উল্টোপথে গাড়ি চালানোর মতো প্রকাশ্য অসভ্যতায় আমরা কেউই পিছিয়ে নেই।
যাঁরা দেশ চালান, দেশ কীভাবে চলবে, সে জন্য আইন তৈরি করেন, তাঁরা গাড়িতে বসে আছেন আর তাঁদের গাড়ি দিব্যি উল্টোপথে চলছে। যাঁরা সরকারের হয়ে দেশে আইন প্রয়োগ করেন ও এর তদারক করেন, সেই র্যাব-পুলিশ ও আমলাদের গাড়ি উল্টোপথে চলে। যাঁরা সরকারের, আমলাদের আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দোষ ধরতে মুখিয়ে থাকেন, সেই সাংবাদিক ও গণমাধ্যমের গাড়িগুলোও নির্লজ্জভাবে উল্টোপথে চলে। মিলেমিশে ক্ষমতা আর দম্ভ প্রকাশের এক উৎসব চলছে ঢাকা শহরজুড়ে। কে কাকে ধরে!
এসব ক্ষমতাবান দেশ-বিদেশে ঘোরেন। তাঁরা কবে কোনো দেশে বা কোনো শহরে কাউকে উল্টোপথে গাড়ি চালাতে দেখেছেন? অথবা দেশের বাইরে তিনি কি এমন কোনো গাড়িতে চড়েছেন, যেটি উল্টোপথে চলেছে? ঢাকা শহরে থাকলে এসব ক্ষমতাবানের কী হয়! এই শহরটি, এর রাস্তাগুলোকে কি তাঁদের নিজেদের সম্পত্তি মনে হয়! জানি কেউ কেউ ঢাকা শহরের অসহনীয় যানজটের দোহাই দেবেন, কিন্তু বাইরের শহরগুলোতেও কি কমবেশি যানজট নেই? সেখানে যানজটে পড়ে কি কারও কখনো উল্টোপথে চলার অভিজ্ঞতা হয়েছে?
এসব প্রশ্ন করা বা তোলাই সার। কার ঠেকা পড়েছে যে এসব প্রশ্নের জবাব দেয়! ক্ষমতা ও এর সঙ্গে দম্ভ যখন মিশে যায়, তখন কে কাকে পরোয়া করে। প্রথম আলোয় ছাপা হওয়া ছবিটি চমক জাগানো কিছু নয়, ঢাকা শহরের যেকোনো রাস্তায় ও মোড়ে যেকোনো সময়েই এমন দৃশ্য আপনার চোখে পড়বে। বিজয় সরণি-তেজগাঁও লিংক রোডে উল্টোপথে আসা যে গাড়িটির ছবি ছাপা হয়েছে, সেটি নিশ্চিন্তেই মোড় পার হয়ে গন্তব্যে চলে গেছে। এই মোড়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কাছেই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এখানে বেশ তৎপর থাকে, তাদের চোখের আড়ালে এখানে কিছু ঘটা কঠিন। এই গাড়িটিও ট্রাফিক পুলিশের চোখের সামনেই আইন ভেঙে পার পেয়ে গেছে। এমন একটি গাড়িকে আটকায়, সে সাহস বা ক্ষমতা কি আমাদের ট্রাফিক পুলিশের আছে?
তাহলে ব্যাপারটা দঁাড়াল কী? আইন আছে কিন্তু আইন ভাঙলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ বা পরিস্থিতি নেই। যদি তা-ই হয়, তবে আইন থাকা বা না-থাকার মধ্যে ফারাক থাকল কই! এ অবস্থায় উল্টোপথে চলা ট্রাফিক আইনের লঙ্ঘন নয়, এমন একটি ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে না কেন? কিন্তু তা তো হওয়ার নয়, কারণ তেমন কিছু হলে তো সাধারণ জনগণের সঙ্গে ক্ষমতাবানের আর কোনো পার্থক্যই থাকবে না! সাধারণ লোকজনের কাছে নিজের ক্ষমতা আর দম্ভ দেখানোর একটি সহজ পথ যে উল্টোপথে গড়ি চালানো। এই বিকৃত আনন্দ যখন আমাদের দেশের সব পর্যায়ের ক্ষমতাবানেরা পেতে শুরু করেছেন, তখন উল্টোপথে গাড়ি চলা মনে হয় চলতেই থাকবে।
উল্টোপথে গাড়ি কেন চলে বা কখন চলে? দেশ ঠিকভাবে চললে কোনো কিছুরই উল্টোভাবে চলার কথা নয়। সমস্যা সম্ভবত গোড়াতেই।
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
akmzakaria@gmail.com