১৭ সেপ্টেম্বর দেশের শিক্ষা দিবসে শিক্ষাঙ্গনের ইতিহাসে একটি অনন্য ঘটনা ঘটতে পারত। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এম আবদুস সোবহান তা হতে দেননি। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) কাজে তিনি বাধা দিয়েছেন। এটা ভিন্নমত বা এটা সদাচরণ নয়। এটা নিজেকে দুর্বিনীত রাখা এবং সর্বোপরি নিজেকে আইনের ঊর্ধ্বে রাখা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬৫ জন শিক্ষক ৩০০ পাতার এক অভিযোগপত্রে উপাচার্য ও সহ–উপাচার্যের বিরুদ্ধে ১৭টি অভিযোগ এনেছিলেন। তার পরিপ্রেক্ষিতে ইউজিসি তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে এবং সেই কমিটি এ ব্যাপারে গণশুনানিতে এই দুজনকে হাজির হতে বলে। উপাচার্য তাতে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানান এবং শেষ পর্যন্ত তিনি যোগ দেননি। আর সহ–উপাচার্য অসুস্থতার কথা বলে যাননি।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন জ্যেষ্ঠ শিক্ষককে টেলিফোন করেছিলাম। বললাম, ‘আপনারা’ ইতিহাস তৈরি করছেন। এরপর কতগুলো অনৈতিক অঘটনের বিবরণ দিলাম। তিনি বললেন, আপনি কি আমাকে একটি পক্ষভুক্ত ধরে নিয়েছেন? আর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা বিচ্ছিন্ন নয়। সারা দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের যে হাল, এখানকার অবস্থাও তাই। তবে তিনি বলেছেন, উপাচার্যবিরোধী অভিযোগকারীরাও ধোয়া তুলসী পাতা নন। বাদীপক্ষের নেতাদের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ মঞ্জুরি কমিশনের অজানা নয়। কিন্তু কমিশন সে বিষয়ে চোখ বুজে আছে। অন্যদিকে উপাচার্যের বিরুদ্ধে আনা দুর্নীতির অভিযোগগুলো অবশ্যই তদন্তযোগ্য।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এ অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ কোনো ‘বিচ্ছিন্ন’ ঘটনা নয় বা অন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও এসব ঘটছে—এটা মেনে নেওয়ার অর্থ হচ্ছে অনৈতিক ঘটনাগুলো শুনে খুব আঁতকে উঠবেন না। কারণ, এটাই তো ‘মানদণ্ড’ হয়ে উঠেছে।
যেমন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্যের পূর্বসূরি উপাচার্য তাঁর মেয়েকে প্রশ্নবিদ্ধ উপায়ে শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছেন। সে তুলনায় বর্তমান উপাচার্যের মেয়ে মেধার জোরেই শিক্ষক হয়েছেন। অবশ্য হোটেল ম্যানেজমেন্ট এবং ট্যুরিজম বিভাগটি খোলার পরেই তাতে উপাচার্যের মেয়েকে শিক্ষক হতে দেখা যায়। অর্থাৎ বর্তমান উপাচার্য পূর্বসূরির পদাঙ্ক অনুসরণ করতে ভুল করেননি। তিনি তাঁর মেয়ের জামাইকে আরও প্রশ্নবিদ্ধ উপায়ে শিক্ষক করেছেন। ঢের ভালো রেজাল্ট করা প্রার্থীকে বঞ্চিত করেছেন।
ইউজিসি সম্ভবত তার ইতিহাসে কোনো উপাচার্যের বিরুদ্ধে এই প্রথম গণশুনানি করল। কিন্তু যেটা লক্ষণীয়, উপাচার্য তাতে অংশ নিলেন না। বরং তিনি বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন। এর আগে তিনি আরেকটি খারাপ নজির সৃষ্টি করেছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে গত বছর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য ও রাষ্ট্রপতির সঙ্গে ‘প্রতারণার মাধ্যমে’ উপাচার্য পদে বহাল থাকার অভিযোগ ওঠে। ২০১৯ সালের ২১ জুন উপাচার্য তাঁর বিভাগের শিক্ষকের পদ থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নেন। আট দিন পরে অবসর নিতে রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করেন। তাতে তিনি তাঁর ইতিমধ্যে স্বেচ্ছা অবসর নেওয়ার বিষয়টি গোপন রাখেন। এ অসত্য তথ্যের ভিত্তিতেই আচার্য তাঁকে ২৯ জুন থেকে অবসর-পরবর্তী উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন অব্যাহত রাখার অনুমতি দেন। এ তথ্য অপসারণযোগ্য একটি নৈতিক স্খলন বলে গণ্য হওয়ার কথা।
একই ধরনের অনৈতিকতা নিয়ে ইউজিসির কর্তৃত্বকে অস্বীকার করেছেন তিনি। তঁার ক্ষেত্রে তদন্ত কেন প্রযোজ্য নয়, সেটা তিনি ব্যক্তিগতভাবে ব্যাখ্যা করতে পারতেন। কিন্তু তিনি বিষয়টিকে একটি আইনগত জায়গা থেকে দেখেছেন। তঁার ব্যাখ্যা যদি সঠিক হয়, তাহলে অতীতে যেসব তদন্ত করা হয়েছে, সেগুলো প্রশ্নবিদ্ধ হবে। এর আগে কমিশন বেশ কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আনা অভিযোগ তদন্ত করেছিল।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দাবি, তঁার দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করে দেখার ক্ষমতাই নেই ইউজিসির। তঁার যুক্তি, তিনি সরাসরি রাষ্ট্রপতির দ্বারা নিয়োগপ্রাপ্ত। তিনি হয়তো খেয়াল করেননি ইউজিসিও রাষ্ট্রপতির সৃষ্টি। কমিশনকে খাটো করে লেখা তাঁর চিঠির ভাষা অযথাযথ, অসংযত ও অসুন্দর। এবং তাতে তাঁর রাজনৈতিক খুঁটির জোরই ফুটে উঠেছে।
ইউজিসি বাংলাদেশের কোনো নিজস্ব উদ্ভাবিত প্রতিষ্ঠান নয়। সারা বিশ্বে এটা আছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সম্পর্ক কী, তা সুস্পষ্ট করে মূল আইনেই উল্লেখ করার সময় হয়েছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের মানে এই হওয়ার নয় যে তাদের দেখার কোনো প্রতিষ্ঠান থাকবে না। বা দেখার কথা উঠলেই কেউ স্বায়ত্তশাসনকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করবে। বরং মানতে হবে, যখন দুর্নীতির প্রশ্ন আসবে, তখন কারও আপনা–আপনি দায়মুক্তি নেই। সেটা রাষ্ট্রের যেকোনো বিভাগের জন্য সমভাবে প্রযোজ্য হওয়া উচিত।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে হাইকোর্টে কিছু বিষয় বিচারাধীন। কিন্তু সেটা গণশুনানি অনুষ্ঠানকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে না। তাই নির্দিষ্টভাবে আদালতের কোনো রায় বা আদেশের লঙ্ঘন ব্যতিরেকে আদালত অবমাননার প্রশ্ন আনা কঠিন। অথচ উপাচার্য কী অবলীলায় তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত করাকেই ‘আদালত অবমাননা’ বলে গণ্য করেছেন।
আসলে ইউজিসির এখতিয়ার ও তার কার্যপরিধি নিয়ে অনেকের মধ্যেই বিভ্রান্তি আছে। ১৯৭৩ সালের আইনটি সংসদের পাস করা আইনের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। এটি শুরুতে রাষ্ট্রপতির আদেশ থাকলেও এখন যথারীতি একটি অ্যাক্ট অব পার্লামেন্ট। আইনটির ৫ ধারার ঝ উপধারা বলেছে, অন্য যেকোনো আইন বা সরকারি আদেশ কমিশনকে যেরূপ ক্ষমতা ও কাজ করতে বলবে, কমিশন তাই করবে।
বর্তমান ইউজিসি চেয়ারম্যান কাজী শহীদুল্লাহ ১৫ সেপ্টেম্বর ১৮টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি (এপিএ) স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে অনিয়মের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করেছেন। আমরা ধরে নেব, সরকারি আদেশবলেই তিনি বলীয়ান। তবে সংসদ যদি নির্দিষ্টভাবে আইন সংশোধন করে তাহলে উত্তম।
ইউজিসি চেয়ারম্যান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে পাঁচ-ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্ব র্যাঙ্কিংয়ে স্থান করে নেওয়ার স্বপ্ন দেখাচ্ছেন। কিন্তু ভিসি নিয়োগ, শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতি (রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ হাজার ২০৩ জন শিক্ষকের প্রায় অর্ধেকই অধ্যাপক) দলীয় দূষণমুক্ত না করতে পারলে হীরক জয়ন্তীতেও তাঁর স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে।
মিজানুর রহমান খান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক
mrkhanbd@gmail.com