>জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন প্রকল্পে দুর্নীতি ও টাকা ভাগাভাগির অভিযোগ উঠেছে। এ নিয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা সেখানে আন্দোলন করছেন। তাঁরা উপাচার্যের পদত্যাগ দাবি করছেন। অন্যদিকে প্রশাসনের দাবি, কোনো দুর্নীতি হয়নি। বিষয়টি শিক্ষকেরা কীভাবে দেখছেন, এ বিষয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেন দর্শন বিভাগের অধ্যাপক রায়হান রাইন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান ও মাইদুল ইসলাম।
প্রথম আলো: বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নকাজ হচ্ছে, এটি তো আনন্দের খবর। আপনারা আন্দোলনে নামলেন কেন?
রায়হান রাইন: আমরা শুনেছিলাম মাস্টারপ্ল্যানের আওতায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বড় অঙ্কের বরাদ্দ আসছে। কিন্তু মাস্টারপ্ল্যানে কী আছে, তা জানতাম না। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জানায়নি। যাঁদের সঙ্গে আলাপ করেছি, সবাই বলেছেন, তাঁরাও কিছু জানেন না। পরে শিক্ষার্থীরা বললেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের পাশের মাঠের খালি জায়গায় দেড় হাজারের মতো গাছে লাল দাগ দেওয়া হয়েছে কেটে ফেলার জন্য। আরও জানা গেল, পাঁচতলা রবীন্দ্রনাথ হল ঘিরে তিনটি ১০ তলা হল করা হবে। আমরা দেখলাম উন্নয়নের নামে ক্যাম্পাসের সবচেয়ে নান্দনিক ও সবুজ স্থানটি নষ্ট করে ফেলা হচ্ছে। তখনই শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামেন। আমরা উন্নয়ন চাই কিন্তু সে উন্নয়ন হতে হবে প্রাকৃতিক ও পরিবেশগত সৌন্দর্য অক্ষুণ্ন রেখে। উন্নয়ন হতে হবে দুর্নীতিমুক্ত।
প্রথম আলো: পরিবেশ রক্ষার আন্দোলন কীভাবে উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে রূপ নিল?
রায়হান রাইন: বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ঐক্য মঞ্চ নামে একটি সংগঠন আগে থেকেই ছিল। আমরা এই মঞ্চের ব্যানারে সভা-সমাবেশ করতে থাকি। একপর্যায়ে উপাচার্যের অফিস থেকে টেলিফোন করে জানতে চাওয়া হলো আমরা কেন আন্দোলন করছি। বললাম, আমরা মাস্টারপ্ল্যান দেখতে চাই। তারা রাজি হলো। কিন্তু বৈঠকে বসার পর কয়েকটি ভবনের নকশা দেখাল। আমরা বললাম, এটা তো মাস্টারপ্ল্যান নয়। মাস্টারপ্ল্যান করতে হলে পরিবেশগত জরিপ থাকতে হবে, ক্যাম্পাসের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, পানিনিষ্কাশন কীভাবে হবে, সেসব থাকতে হবে। অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ তিন মাসের জন্য কাজ স্থগিত রেখে মাস্টারপ্ল্যান ওয়েবসাইটে দেওয়ার প্রস্তাব করলেন। কিন্তু প্রশাসন তাতে রাজি হলো না। তারা অদ্ভুত যুক্তি দিল, ওয়েবসাইটে দিলে মাস্টারপ্ল্যান চুরি হয়ে যাবে। মাস্টারপ্ল্যান করা হয় নির্দিষ্ট একটি জায়গার জন্য। সেটি অন্যরা চুরি করবে কেন? তারা বলল, দেরি করা যাবে না। তাহলে অর্থ ফেরত যাবে।
প্রথম আলো: তখন আপনাদের অবস্থান কী ছিল?
রায়হান রাইন: আমরা কর্মসূচি অব্যাহত রাখলাম। এরপর দেখলাম ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থানে প্রচুর মাটি ও গাছ কাটা হচ্ছে। গাছ কাটার ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতির সঙ্গে বৈঠক করলাম। প্রকল্প পরিচালক ও প্রধান প্রকৌশলীর কাছে গেলাম। বললাম, রবীন্দ্র হলের পাশের মাঠটি বাঁচাতে হবে। তখন তাঁরা বললেন, দ্বিতীয় পর্যায়ে যেসব স্থানে স্থাপনার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, সেখানে সরিয়ে নিলে মাঠটি বাঁচানো যায়। এরপর ছাত্র-শিক্ষক ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের যৌথ বৈঠকে উপাচার্যও উন্নয়ন পরিকল্পনাটি পুনর্বিন্যাস করতে রাজি হলেন। কিন্তু আমাদের শঙ্কা ছিল ঈদের ছুটিতে গাছ কাটা হয় কি না। উপাচার্য আশ্বাস দিলেন, ঈদের ছুটিতে কাটা হবে না। কিন্তু ঈদের পর একদিন ভোরে বৈদ্যুতিক করাত দিয়ে প্রচুর গাছ কেটে ফেলা হলো। তাৎক্ষণিকভাবে অনেক শিক্ষার্থী নেমে এলেন। আন্দোলনের মুখে গাছ কাটা বন্ধ হলো। আন্দোলন নতুন মোড় নিল। প্রচুরসংখ্যক শিক্ষার্থী যোগ দিলেন। উপাচার্য বললেন, আলোচনা হতে পারে। তবে কাজও চলবে। আমরা বললাম, আপনি যদি আপনার অবস্থানে অনড় থাকেন, তাহলে আলোচনা করে কী লাভ? এর মধ্যে ২৩ আগস্ট বাংলাদেশ প্রতিদিন-এ খবর এল দুই কোটি টাকা ভাগ-বাঁটোয়ারা হয়েছে। এরপর ডেইলি স্টার পত্রিকায়ও একই খবর ছাপা হলো। ছাত্রলীগ কর্মীদের হাতে ক্যাম্পাসে দুজন সাংবাদিক লাঞ্ছিত হলেন। এরপর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আইন জারি করল যে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থবিরোধী রিপোর্ট করা যাবে না। এর বিরুদ্ধেও আন্দোলন হলো।
প্রথম আলো: উন্নয়নকাজে দুর্নীতি হচ্ছে, এই ধারণা কীভাবে হলো?
রায়হান রাইন: এরপর আমরা ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর’ নামে নতুন প্ল্যাটফর্ম তৈরি করলাম। এর আগেও কিছু ঘটনা ঘটল। ৭ তারিখে বৈঠকে বসতে যাব, এ সময় সাইমুম নামের এক সংস্কৃতিকর্মীকে মারধর করেন এক ছাত্রলীগ নেতা। পরে জানা গেল, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রই নন। অনেক আগে পাস করে গেছেন। আমরা বললাম, অছাত্রদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। তাঁদের জন্যই শিক্ষার্থীদের গণরুমে থাকতে হচ্ছে। একপর্যায়ে ওই শিক্ষার্থীকে বের করে দেওয়া হলো। এর আগে বিশ্ববিদ্যালয় কাজের দরপত্র আহ্বান করে ১৫ দিন সময় দেওয়া হলে। ১৪ দিন দরপত্র পাওয়াই গেল না। শেষ দিন পাওয়া গেলেও পছন্দের বাইরের কোনো প্রতিষ্ঠানকে দরপত্র কিনতে দেওয়া হলো না। ইউনাইটেড কনস্ট্রাকশন নামে একটি প্রতিষ্ঠান লিখিত অভিযোগ করেছে। এসব ঘটনায় আমরা ধারণা করি, দুর্নীতি হয়েছে। কাজে স্বচ্ছতা আনতে আমরা তিন দফা প্রস্তাব করি।
প্রথম আলো: আপনাদের তিন দফায় কী ছিল?
রায়হান রাইন: উপাচার্য ১২ সেপ্টেম্বর আমাদের সঙ্গে ফের বসলেন। সেখানে আমরা তিন দফা দাবি পেশ করি। এক. উন্নয়ন পরিকল্পনা পুনর্বিন্যাস করতে হবে। দুই. উন্নয়নকাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। তিন. বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদার স্বার্থে দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত হতে হবে। সেটি বিচার বিভাগীয় হতে পারে কিংবা ইউজিসি ও আচার্যের অফিস থেকেও তদন্ত হতে পারে। উপাচার্য প্রথম দুটি দাবি মেনে নিলেও তৃতীয়টি মানলেন না। বললেন, আইনি পরামর্শ প্রয়োজন। এ জন্য তিন কর্মদিবস সময় চাইলেন।
প্রথম আলো: এরপর আপনারা আন্দোলন অব্যাহত রাখলেন?
রায়হান রাইন: আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া ছাড়া আমাদের উপায় ছিল না। জাহাঙ্গীরনগরে এর আগে যত স্থাপনা হয়েছে, সব কটিতেই দুর্নীতি হয়েছে। কিছুদিন না যেতেই ছাত্রাবাসগুলো বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ে। ১৩ সেপ্টেম্বর উপাচার্য নিজেই সংবাদ সম্মেলন করে ছাত্রলীগ নেতাদের কমিশন চাওয়ার বিষয়টি জানিয়ে দেন। কিন্তু এর আগে আমাদের সঙ্গে যতবার বৈঠক হয়েছে, তিনি বলেছেন, ওরা এসেছিল সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে। টাকাপয়সা নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। তিনি একেক সময় একেক কথা বলেন।
প্রথম আলো: আপনারা উপাচার্যের পদত্যাগ চাইছেন কেন?
রায়হান রাইন: ছাত্রলীগ নেতাদের টেলিফোন আলাপে কমিশন কেলেঙ্কারির ঘটনা ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর আমরা মনে করি, উপাচার্যের আর পদে থাকার নৈতিক অধিকার নেই। আমরা উপাচার্যের ভবনে তিন দিনব্যাপী অবরোধ কর্মসূচি পালন করলাম। তাঁর পদত্যাগ দাবি করেছি। প্রথমে উপাচার্য ছাত্রলীগ নেতাদের চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। এরপর গোলাম রাব্বানী তাঁকে পাল্টা চ্যালেঞ্জ করেছেন। জাহাঙ্গীরনগর ছাত্রলীগ নেতা সাদ্দাম হোসেনের সঙ্গে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতা রাব্বানীর অডিওতে স্পষ্ট যে টাকা নেওয়ার সঙ্গে কারা ছিলেন ও কে কাকে কত টাকা দিয়েছেন। এর সঙ্গে উপাচার্যের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ মেলে। তাই আমরা তাঁর প্রতি অনাস্থা এনেছি। আগামী ১ অক্টোবরের মধ্যে তাঁকে পদত্যাগ করার আহ্বান জানিয়েছি। তিনি তা না করলে আমরা জোরদার কর্মসূচিতে যাব।
প্রথম আলো: ধন্যবাদ আপনাকে।
রায়হান রাইন: আপনাকেও ধন্যবাদ।
আরও পড়ুন:
সুষ্ঠু তদন্ত হোক আমরাও চাই