জাতিসংঘের সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট সলিউশন নেটওয়ার্কের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনের তথ্যে দেখা যাচ্ছে, জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে সবচেয়ে এগিয়ে থাকা তিনটি দেশের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের নাম (সূত্র: প্রথম আলো)। এসডিজির এবারের সূচকে বাংলাদেশের সার্বিক স্কোর ৬৩ দশমিক ৫ শতাংশ। ২০১৫ সালে এসডিজি গৃহীত হওয়ার সময় এই স্কোর ছিল ৫৯ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ। এ তথ্য নিশ্চয়ই ইতিবাচক, তবে এতেই আত্মপ্রসাদে ভোগার কারণ নেই। পরিসংখ্যানের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর খাদ্য, চিকিৎসা বা শিক্ষাসহ সার্বিক জীবনমান কতটা উন্নত হয়েছে, সেটিও বিবেচনায় আনতে হবে।
জাতিসংঘের ১৫ বছর মেয়াদি এসডিজি পরিকল্পনার উদ্দেশ্য হলো ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বে শান্তি ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করা। এ জন্য ১৭টি লক্ষ্যমাত্রা ও ১৬৯টি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এসবের মধ্যে দারিদ্র্য দূরীকরণ, খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা, সুস্বাস্থ্য ও উন্নত শিক্ষা নিশ্চিত করা এবং লিঙ্গবৈষম্য প্রতিরোধ অন্যতম। আর এসব খাতের প্রতিটির সঙ্গে জলবায়ুজনিত অভিঘাতের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। ফলে এ সময়ে এসে মিলিয়ে দেখা দরকার, পরিবেশ বা জলবায়ুর মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো এসডিজি বাস্তবায়নে বাংলাদেশের গৃহীত পদক্ষেপগুলোয় কতটা গুরুত্ব পেয়েছে।
বিগত ঝড়-বন্যাগুলোয় ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ ও অন্যান্য অবকাঠামো এখন পর্যন্ত পুরোপুরি সারিয়ে তোলা হয়নি। এ কারণে সম্প্রতি আঘাত হানা দুর্যোগেও বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ এখনো উদ্বাস্তুই রয়ে গেছে
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে উন্নয়ন পরিকল্পনাগুলো প্রায়ই প্রশ্নবিদ্ধ থেকে যায়। যাদের জন্য উন্নয়ন, সেই জনগোষ্ঠীর সঙ্গে নীতিনির্ধারকদের মিথস্ক্রিয়া হয় না বলে পরিকল্পনাগুলো শেষ পর্যন্ত হয়ে ওঠে নগরকেন্দ্রিক। গ্রামীণ, উপকূলীয় ও অন্য বিচারে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী প্রায়ই উপেক্ষিত থেকে যায়। অনেক সময় দেখা যায় পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি বলে বরাদ্দ ফেরত গেছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পিরোজপুর, বরগুনা, সাতক্ষীরা ও চট্টগ্রামের উপকূলীয় অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড়ের প্রকোপ বাড়ছে। সিডর, আইলা, বুলবুল, ফণী বা আম্পানসহ সাম্প্রতিক ঘূর্ণিঝড়গুলো শুধু দেশের দক্ষিণাঞ্চলই নয়, পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোকেও নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। প্রতিবছর বাংলাদেশের প্রায় ২৬ হাজার বর্গকিলোমিটার অঞ্চল (প্রায় ১৮ শতাংশ ভূখণ্ড) বন্যাকবলিত হয়। অতিবন্যা হলে দেশের ৫৫ শতাংশের বেশি ভূখণ্ড প্লাবিত হয়। বিগত ঝড়-বন্যাগুলোয় ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ ও অন্যান্য অবকাঠামো এখন পর্যন্ত পুরোপুরি সারিয়ে তোলা হয়নি। এ কারণে সম্প্রতি আঘাত হানা দুর্যোগেও বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ এখনো উদ্বাস্তুই রয়ে গেছে। এ বাস্তবতায় এসডিজির দারিদ্র্য নিরসন ও জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্য বাস্তবায়িত হওয়ার সুযোগ কোথায়?
ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ঠিক সময়ে পুনর্নির্মাণ বা মেরামত না হওয়ায় স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। ছেলেশিশুরা শিশুশ্রমে নিযুক্ত হচ্ছে এবং মেয়েশিশুদের অনেকে বাল্যবিবাহের শিকার হচ্ছে। এসডিজিতে দারিদ্র্য, খাদ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও জেন্ডার ইস্যুতে যেসব প্রত্যয় উল্লেখ রয়েছে, সেগুলোর প্রতিটি বিষয় উপকূলীয় অঞ্চলগুলোর ক্ষেত্রে নেতিবাচক পর্যায়ে রয়েছে। গত ২৩ আগস্ট জাগো নিউজে এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, লবণাক্ত পানির অতি ব্যবহার এবং ব্যবহারযোগ্য পানির অভাবে এক পুকুরে মানুষ ও গবাদিপশু ধোয়ামোছার কারণে স্থানীয় ব্যক্তিরা চর্মরোগে ভুগছেন। এ ছাড়া লবণাক্ত ও নোংরা পানি ব্যবহারের কারণে এসব এলাকার নারীরা জরায়ুর নানা সমস্যায় ভুগছেন।
২০১১ সালের আদমশুমারির তথ্য অনুযায়ী, দেশের অন্যান্য অঞ্চলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ৩৪ শতাংশ, অথচ উপকূলীয় দক্ষিণাঞ্চলের খুলনা জেলা ও বরিশাল বিভাগে সেই হার শূন্য দশমিক ১৫ শতাংশ। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের কয়েকজন শিক্ষক গত ২১ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোয় যৌথভাবে লেখা এক প্রতিবেদনে তাঁদের গবেষণার বরাত দিয়ে বলেন, উপকূলীয় অঞ্চলের ১৯টি জেলাতেই নিট অভিগমনের হার ঋণাত্মক। ২০০১-১১ সময়ে সেখান থেকে জনসংখ্যার ১১ দশমিক ২ শতাংশ অন্যত্র, মূলত ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরে অভিগমন করে। সবচেয়ে কম অভিগমনের হার লক্ষ করা গেছে কক্সবাজারে, জনসংখ্যার ৩ দশমিক ৬ শতাংশ। অর্থাৎ উপকূলীয় অঞ্চল ক্রমেই যে জনসংখ্যা কমছে, তা সুস্পষ্ট। জীবন ও জীবিকার জন্য দরকারি সম্পদ ও অবকাঠামো হারিয়ে উদ্বাস্তুতে পরিণত হচ্ছে সেখানকার মানুষ।
পৃথিবীতে সাইক্লোনের কারণে মোট মৃত্যুর শতকরা ৮০ ভাগই ঘটে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট সাইক্লোনের কারণে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, প্রতিকূল উপকূলীয় পরিস্থিতি গোটা দেশের জন্যই একটি উদ্বেগের বিষয়।
নদী, খাল-বিলসহ দখলকৃত ও মৃতপ্রায় জলাধারগুলো নতুন করে খনন করতে হবে এবং সারা বছর এগুলো সচল রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলে গোটা দেশের জলাবদ্ধতার চিত্র আমাদের অনুকূলে পাল্টে যাবে। এতে মৎস্যসম্পদ পরিস্থিতির উন্নতির পাশাপাশি এর ওপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকার মান উন্নততর হবে। উপকূলের রক্ষাকবচ সুন্দরবনসহ ম্যানগ্রোভ ও প্যারাবন রক্ষার পাশাপাশি নতুন বনায়নের উদ্যোগ দরকার। সমুদ্র উপকূলের পাশাপাশি নদীতীরবর্তী অঞ্চলেও বেশি বেশি গাছ লাগানোর উদ্যোগ নিতে হবে, যাতে প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রাথমিক আঘাত কিছুটা হলেও ঠেকানো যায়। এ ছাড়া বদ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০ জরুরি ভিত্তিতে শতভাগ বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে। এগুলো নিশ্চিত করা গেলে নতুন করে উপকূলের বাসিন্দারা জীবন-জীবিকার সংকটে পড়বে না। তাদের জীবিকার পথ প্রশস্ত হবে, জীবনের মান উন্নততর হবে।
জলবায়ু, নদীতীর ও উপকূল সম্পর্কে জ্ঞান ও সচেতনতা বৃদ্ধিতে পাঠ্যপুস্তকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বিষয়গুলো ধারণা দেওয়া দরকার। গণমাধ্যমগুলো দুর্যোগকালীন ছাড়াও উপকূলের জীবন-জীবিকা ও বাসিন্দাদের চ্যালেঞ্জ ও চাহিদাগুলো নিয়মিত তুলে আনতে পারে। এর ফলে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে দায়িত্বশীলরা সঠিক দিকনির্দেশনা পেতে পারেন। উপকূলবাসীর হালনাগাদ তথ্য, আশ্রয়কেন্দ্র ও দুর্যোগের আভাস বিষয়ে নিয়মিত তথ্য পেলে সংশ্লিষ্ট জনপ্রতিনিধিসহ দায়িত্বশীলরা দুর্যোগকালে জনসাধারণের জীবনের নিরাপত্তা এবং খাদ্য ও চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করাসহ তাদের সার্বিক সমস্যার স্থায়ী সমাধান করতে সক্ষম হবেন।
২৬ মে টাইমস অব ইন্ডিয়ার একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বঙ্গোপসাগর গোটা বিশ্বের মোট সমুদ্র উপকূলীয় এলাকার মাত্র শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ; অথচ সারা পৃথিবীতে সাইক্লোনজনিত প্রতি পাঁচটি মৃত্যুর মধ্যে চারটিরই কারণ এ বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঝড়। পৃথিবীতে সাইক্লোনের কারণে মোট মৃত্যুর শতকরা ৮০ ভাগই ঘটে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট সাইক্লোনের কারণে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, প্রতিকূল উপকূলীয় পরিস্থিতি গোটা দেশের জন্যই একটি উদ্বেগের বিষয়। উপকূল অঞ্চলকে যদি উন্নয়ন আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত করা না যায়, তাহলে এসডিজির যথাযথ বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না। তাই জলবায়ুর অভিঘাত, পরিবেশ ও উপকূলকে মাথায় রেখে যদি উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়, তাহলে অন্তর্ভুক্তিমূলক তথা সামষ্টিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
● সজীব সরকার চেয়ারপারসন, জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগ, সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটি