উন্নয়ন ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ভুল দর্শনের ফাঁদে বাংলাদেশ

উজান ও ভাটিতে পানির প্রাকৃতিক প্রবাহের পথে যত বাঁধ-ব্যারেজসহ অবকাঠামো নির্মাণ করা হবে, স্বাভাবিক প্রবাহ হারিয়ে পানির তোড় তত বিধ্বংসী হয়ে উঠবে। কোম্পানীগঞ্জের থানাবাজার এলাকা।
ছবি: প্রথম আলো

ভারতের গঙ্গা, তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার নিম্নাঞ্চল এবং বাংলাদেশে নতুন ধারার বিপর্যয়কর বন্যাগুলোর কারণ ও ধরন মোটাদাগে কয়েকটা। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিতে অধিক তাপমাত্রায় বায়ুমণ্ডলের জলীয় বাষ্প ধারণক্ষমতা বৃদ্ধিজনিত অতিবৃষ্টি অবশ্যই একটা বড় কারণ। গঙ্গা ও তিস্তা অববাহিকায় বন্যার প্রধানতম কারণ অবশ্যই উজানে বাঁধ নির্মাণ ও একতরফা পানি প্রত্যাহারে স্রোত হারিয়ে নদীতে বালু জমে নদীর গভীরতা কমে আসা। অতিবৃষ্টির পর বন্ধ বাঁধগুলো হঠাৎ যখন একসঙ্গে খোলা হয়, তখন ভরাট হয়ে পড়া পদ্মা ও তিস্তা পানি ধারণ করতে না পেরে অভাবনীয় ক্ষতির বন্যা ও জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করে। বাঁধের বন্ধ গেটগুলো শেষ মুহূর্তে খোলা হয়। বিপরীতে আধুনিক আবহাওয়া স্যাটেলাইটের কল্যাণে ব্যাপক বৃষ্টি হবে জেনেও কয়েকটা দিন আগে থেকেই উজানের বাঁধের পানি রিলিজ বা ড্রেনেজের ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। ভারতের বাঁধে ভাটির বাংলাদেশ খরায় শুকায়, হঠাৎ বানে ভাসে!

অন্যদিকে, ব্রহ্মপুত্র ও বরাক অববাহিকার উজানে প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে চলছে নির্বিচার বাণিজ্যিক বনায়ন, পাহাড় কাটা, পাথর উত্তোলনসহ খনিজ আহরণের বিশাল সব আয়োজন। বাংলাদেশেও পার্বত্য চট্টগ্রামে বাণিজ্যিক বনায়ন, পাহাড় কাটা ও পাথর সংগ্রহে কর্ণফুলীর পানিতেও পলিপতনের মাত্রা বেড়েছে। অর্থাৎ বন ও পাহাড়ে উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে বৃষ্টির পানি নদীতে পলিপতন তীব্র করছে। এতে নদীর পানি ধারণক্ষমতা ক্রমাগত কমছেই।

উজানের পানি ভাটিতেই গড়াবে—এটাই তার স্বাভাবিক প্রকৃতি। কিন্তু অদূরদর্শী উন্নয়নে কিংবা আন্তদেশীয় হিংসা ও প্রতিযোগিতায় সেই স্বাভাবিকতাকে চ্যালেঞ্জ বা বাধাগ্রস্ত করলে তার ফলাফল কতটা ভয়ংকর হতে পারে, ভারত ও বাংলাদেশের জানা হয়েছে বিস্তর। প্রাকৃতিক বিন্যাসকে চ্যালেঞ্জ করা, আমূল পরিবর্তন করে দেওয়া কোনো শক্তিশালী রাষ্ট্রের কিংবা সংস্থার পক্ষে সম্ভব নয়। নদীকে একদিকে বাধাগ্রস্ত করলে অন্যদিকে সে যে গতিপথ খুঁজে নেয়, তা হয় অনেক বেশি বিধ্বংসী।

ভারত ও বাংলাদেশে পলিথিন-প্লাস্টিক, মানববর্জ্য, নগর ও শিল্পবর্জ্য নির্বিচারে নদীতেই ফেলা (ডাম্পিং) হয়। শহর ও শিল্পাঞ্চল–সংলগ্ন অঞ্চলে নদীর তলদেশে স্থানভেদে কয়েক ফুটের পলিথিন স্তরে জমেছে। বিপরীতে নেই পরিবেশবান্ধব নগর ও শিল্পবর্জ্য শোধনের বোধ। নেই সমন্বিত ও টেকসই ড্রেজিংয়ের আয়োজনও। বাংলাদেশে বনাঞ্চল ধ্বংস, নির্বিচার গাছ কাটা, হাওর ও নদীভরাটকেন্দ্রিক জিডিপি প্রবৃদ্ধির মহোৎসব চলছে। আছে সমন্বয়হীন বালু উত্তোলন ও ড্রেজিংয়ের তাণ্ডব। ওদিকে ভারতে চলছে ব্রহ্মপুত্রের ওপর জলবিদ্যুৎ ও পানি প্রত্যাহারের নতুন-পুরোনো প্রকল্প, পাহাড় ও বনায়ন বাণিজ্যিকীকরণের মহাপ্রকল্প। সব মিলে অতিবৃষ্টির প্রাকৃতিক কারণের চেয়েও ভারত ও বাংলাদেশের উন্নয়ন-সন্ত্রাসই বিপর্যয়কর বন্যার জন্য দায়ী। অতিবৃষ্টি অতীতেও হয়েছে, ভবিষ্যতেও হবে। কিন্তু নদীর পানি ধারণক্ষমতা কেন দ্রুত কমছে, সে প্রশ্নের গভীরে গিয়ে প্রতিকার ও প্রতিরোধের পথে হাঁটা চাই!

উজানের পানি ভাটিতেই গড়াবে—এটাই তার স্বাভাবিক প্রকৃতি। কিন্তু অদূরদর্শী উন্নয়নে কিংবা আন্তদেশীয় হিংসা ও প্রতিযোগিতায় সেই স্বাভাবিকতাকে চ্যালেঞ্জ বা বাধাগ্রস্ত করলে তার ফলাফল কতটা ভয়ংকর হতে পারে, ভারত ও বাংলাদেশের জানা হয়েছে বিস্তর। প্রাকৃতিক বিন্যাসকে চ্যালেঞ্জ করা, আমূল পরিবর্তন করে দেওয়া কোনো শক্তিশালী রাষ্ট্রের কিংবা সংস্থার পক্ষে সম্ভব নয়। নদীকে একদিকে বাধাগ্রস্ত করলে অন্যদিকে সে যে গতিপথ খুঁজে নেয়, তা হয় অনেক বেশি বিধ্বংসী। আন্তর্জাতিক আইন ও রীতিনীতিকে পাশ কাটিয়ে ভাটির পানি আটকে দেওয়া, ভাটির পানির প্রাকৃতিক উৎসপ্রবাহকে তছনছ করা উদ্যোগ ও মেগা প্রকল্পের দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক প্রতিদান ঋণাত্মক। উজান ও ভাটিতে পানির প্রাকৃতিক প্রবাহের পথে যত বাঁধ-ব্যারেজসহ অবকাঠামো নির্মাণ করা হবে, স্বাভাবিক প্রবাহ হারিয়ে পানির তোড় তত বিধ্বংসী হয়ে উঠবে; ভেসে যাবে লোকালয়সহ নানা অবকাঠামো ও প্রাণ-প্রকৃতি। সেই বিধ্বংসী রূপই আজ দেখছে উজানের আসাম, বিহার, পশ্চিম বাংলা আর ভাটির বাংলাদেশ।

ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে স্বীকৃত ৫৩টি অভিন্ন আন্তর্জাতিক নদী প্রবাহিত। দেশ দুটি যদি নদীগুলাকে বাঁচিয়ে রাখতে না পারে, নদীর পানির গতিপ্রবাহ ঠিক রাখতে না পারে, নদীর নাব্যতা ধরে রাখতে না পারে, জলবিদ্যুতের নামে নদীর ওপর অত্যাচারের আয়োজন বন্ধ করতে না পারে, জল ধারণক্ষমতা বাড়াতে টেকসই ও সমন্বিত ড্রেজিং করতে না পারে, আধুনিক আবহাওয়াজ্ঞানের আলোকে অতিবৃষ্টির আগেই বাঁধ ও জলাধারের পানি বঙ্গোপসাগরে ‘ড্রেন আউট’ করতে না পারে, তবে এমন বন্যা দুই দেশে চলতেই থাকবে। বাংলাদেশ সীমান্ত অঞ্চল দরিদ্রতম অঞ্চল বলে সেখানে ভারত সরকারের মনোযোগ কম থাকতে পারে, কিন্তু বিহার ও আসামের মোট ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নেহাতই কম নয়। একেকটা বন্যায় বাংলাদেশের বিদ্যুৎ, সড়ক ও রেল অবকাঠামোর ক্ষতি, ফসল ও গবাদিপশুর সম্মিলিত ক্ষয়ক্ষতি বিপর্যয়কর!

প্রলয়ংকরী বন্যার ক্ষয়ক্ষতি উন্নয়নযজ্ঞ থেকে, কয়েক বছরে প্রাপ্ত জিডিপির চেয়েও ঢের বেশি। এ কারণে বন্যা ব্যবস্থাপনার দর্শন পরিবর্তনের সময় হয়েছে। অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেওয়ার বদলে দরকার হয়ে পড়েছে সমুদয় অববাহিকার মোট সম্ভাব্য বৃষ্টিপাত আমলে নিয়ে অগ্রিম পানি ড্রেনেজ পরিকল্পনা, অবকাঠামো সুরক্ষা এবং আগাম উদ্ধার ও ত্রাণ তৎপরতার পরিকল্পনা নেওয়া। ভারত ও বাংলাদেশ বন্যা ব্যবস্থাপনার কাজটা যৌথ ও সমন্বিত উদ্যোগে করতে পারলেই বিহার, আসাম ও বাংলাদেশের মানুষের মঙ্গল।

প্রলয়ংকরী বন্যার ক্ষয়ক্ষতি উন্নয়নযজ্ঞ থেকে, কয়েক বছরে প্রাপ্ত জিডিপির চেয়েও ঢের বেশি। এ কারণে বন্যা ব্যবস্থাপনার দর্শন পরিবর্তনের সময় হয়েছে। অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেওয়ার বদলে দরকার হয়ে পড়েছে সমুদয় অববাহিকার মোট সম্ভাব্য বৃষ্টিপাত আমলে নিয়ে অগ্রিম পানি ড্রেনেজ পরিকল্পনা, অবকাঠামো সুরক্ষা এবং আগাম উদ্ধার ও ত্রাণ তৎপরতার পরিকল্পনা নেওয়া। ভারত ও বাংলাদেশ বন্যা ব্যবস্থাপনার কাজটা যৌথ ও সমন্বিত উদ্যোগে করতে পারলেই বিহার, আসাম ও বাংলাদেশের মানুষের মঙ্গল।

অর্থাৎ গঙ্গা ও তিস্তা বেসিনের বাঁধের গেটগুলো খোলার সঙ্গে আবহাওয়া পূর্বাভাসের আধুনিকতম জ্ঞানকে সমন্বিত করতে হবে। বর্তমানে জাপান, মার্কিন ও ইউরোপীয় আবহাওয়ার পূর্বাভাস মডেলগুলোর মাধ্যমে এক থেকে দুই সপ্তাহ আগেই ভারী বৃষ্টির সম্ভাবনা ও পরিমাণ জানা যায়। এ কারণে বাঁধের জলাধারের পানি সরিয়ে নতুন পানির সক্ষমতা তৈরি, আগাম সতর্কসংকেত জারি, ত্রাণ ও উদ্ধার পরিকল্পনা সাজানোকে গতানুগতিক রেখে নতুন উচ্চতায় নিতে হবে। অন্যদিকে, ব্রহ্মপুত্র ও বরাকের উজানে বৃষ্টির সম্ভাব্য গড়ের ভিত্তিতে ভারত-বাংলাদেশ মিলেই করতে হবে সমন্বিত ড্রেজিং ও নাব্যতা রক্ষার মহাপরিকল্পনা। এর জন্য যথাযথ আন্তরাষ্ট্রীয় কূটনীতি দরকার।

অর্থাৎ জীবন ও সম্পদ বাঁচাতে, অর্থনীতি সুরক্ষায় বন্যা ব্যবস্থাপনাকে পরবর্তী পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার সময় এসেছে। ভারত ও বাংলাদেশ যৌথ উদ্যোগে আবহাওয়া স্যাটেলাইট ডেটা এবং স্যাটেলাইট ইমেজ প্রক্রিয়াকরণভিত্তিক বন্যা ব্যবস্থাপনা সহযোগিতার ক্ষেত্র প্রসারিত করতে পারে। সময়ের আগেই বঙ্গোপসাগরে অতিরিক্ত বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের জন্য নদীর বাঁধ ব্যবস্থাপনার নকশা করা যায়। জলবিদ্যুৎ বাঁধ পরিচালনার জন্য দক্ষ কৌশল নির্ধারণ করতে সফটওয়্যার ও ডেটা সায়েন্সভিত্তিক হাইড্রোলজিক্যাল সিমুলেশন মডেল তৈরি করা সম্ভব। আঞ্চলিক বন্যা সতর্কতা কেন্দ্রেও দরকার। মানুষ, পশুসম্পদ ও অবকাঠামোকে ব্যাপক ক্ষতির হাত থেকে বাঁচাতে একটি ‘উইন উইন’ পরিস্থিতি তৈরি করা জরুরি। প্রতিযোগিতাকে সহযোগিতা দিয়ে প্রতিস্থাপন করা না গেলে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতি মোকাবিলা দুই দেশের জন্যই অসম্ভব।
অর্থাৎ আন্তর্জাতিক নদীতে ভারতের পানি ব্যবস্থাপনার দর্শন এবং ভাটির বাংলাদেশে নদীর নাব্যতা ব্যবস্থাপনার কৌশল উভয়কেই রূপান্তরের ভেতর দিয়ে নিতে হবে। যার মূল উৎকর্ষ হবে অত্যাধুনিক ওয়েদার স্যাটেলাইটের সর্বোচ্চ ব্যবহার, তথ্য আদানপ্রদান এবং টেকসই নদী রক্ষার পরিকল্পনা নির্ধারণ। দরকার যৌথ কারিগরি এবং আর্থিক সহযোগিতার ক্ষেত্র বৃদ্ধি। বৃহৎ, মাঝারি ও ছোট নদীর নাব্যতা রক্ষা, পানি ধারণক্ষমতা ও ড্রেজিং প্রশ্নে ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ অবস্থান এবং পানিবণ্টন কৌশল টেকসই হওয়া উচিত। এটাই এ অঞ্চলে উন্নয়ন সভ্যতার মানদণ্ড হিসেবে বিবেচিত হওয়া দরকার। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর অর্থনৈতিক বিকাশে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে নৌ ও স্থল ট্রানজিট কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু বিপর্যয়কর বন্যার ছোবল থেকে বাংলাদেশের সড়ক ও রেল অবকাঠামো রক্ষা করা না গেলে, আন্তর্জাতিক নদীর নাব্যতা রক্ষা করা না গেলে (কারিগরি ও আর্থিক অক্ষমতায়) ট্রানজিটকেন্দ্রিক মহাসংযোগ পরিকল্পনাও মুখ থুবড়ে পড়বে।

জলবায়ু পরিবর্তনগত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা, পরিবেশ-বাস্তুতন্ত্র, জীববৈচিত্র্য সুরক্ষা, সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং স্থলভাগে লবণাক্ত পানির অনুপ্রবেশ, পানীয় জল সুরক্ষা-সম্পর্কিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে কিছু অভিন্ন চ্যালেঞ্জ রয়েছে। যদিও ভারত ও বাংলাদেশ মানচিত্রের একটি ভৌত সীমানা দ্বারা পৃথক, তবু আমাদের বায়ু, পানি, নদী, বন এবং অন্য অনেক প্রাকৃতিক সম্পদ অভিন্ন। এসবে মানচিত্রের সীমানা অকেজো। জলবায়ু পরিবর্তনগত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার প্রশ্নে এ উপলব্ধির গভীরে পৌঁছাতে হবে। মানচিত্রের সীমানা অতিক্রম করলেই নদী আরেকটি ভিন্ন সত্তা হয়ে যায় না। একটি মহান নদী-সভ্যতা একটি সামগ্রিক নদী ব্যবস্থাপনার সমন্বিত ফসল! পরিবেশ বাঁচানো মানে প্রকৃতি ও পরিবেশের জীবনচক্র ও গতিপথকে স্বাভাবিক রেখে মানুষ ও প্রাণ-প্রকৃতির অনুকূলে কাজে লাগানো। এ জন্য হাজার বছরের অর্জিত জ্ঞানের সঙ্গে আধুনিকতম জ্ঞানের টেকসই সমন্বয় দরকার।

ভারত ও বাংলাদেশ উভয়েরই ২০৩০ সালের মধ্যে সবার জন্য নিরাপদ ও সাশ্রয়ী মূল্যের পানীয় জল নিশ্চিত করার টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য রয়েছে ভূপৃষ্ঠের পানির প্রাকৃতিক উৎসগুলোকে সুরক্ষা দেওয়া, ভূগর্ভস্থ পানির ওপর অত্যধিক নির্ভরতা কমানো, নদীর পানিকে দূষণমুক্ত রাখা এবং ভূ-উপরিভাগের পানির সমন্বিত ও টেকসই আধার নির্মাণে ভবিষ্যৎমুখী পরিকাঠামোয় পর্যাপ্ত বিনিয়োগ প্রয়োজন। পয়োনিষ্কাশন এবং পলিথিন, শিল্পবর্জ্য ও মাইক্রোপ্লাস্টিকের দূষণ থামাতেও সমন্বিত কৌশল দরকার। পানি, বন, বাস্তুতন্ত্র ও পরিবেশ রক্ষার জন্য সর্বোত্তম অনুশীলনগুলো বের করে আনতে এ অঞ্চলে পারস্পরিক সহযোগিতা খুব জরুরি। প্রাকৃতিক আবাসস্থল এবং জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি কমাতে জরুরি ও কার্যকর পদক্ষেপ কী, তার আঞ্চলিক গবেষণা জরুরি। নদীকেন্দ্রিক জীববৈচিত্র্য রক্ষা করলেই পরে এ অঞ্চলের অধিকতর জলবায়ু-সহিষ্ণুতা অর্জন সম্ভব। অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত স্থিতিশীলতার জন্য নদীকে বাঁচিয়ে তাকে পরিবেশগত প্রবাহ, বাস্তুশাস্ত্র, জীববৈচিত্র্য ও পানিবিজ্ঞানের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের উন্নয়নই টেকসই উন্নয়ন; নদী হত্যার উন্নয়ন হচ্ছে উন্নয়ন সন্ত্রাস।
কয়েক বছর ধরে ভারত ও বাংলাদেশ উভয়েই বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের একই সাধারণ প্যাটার্নের সম্মুখীন হচ্ছে। ঘূর্ণিঝড় আম্পান উভয় দেশে ফসল, অবকাঠামো ও গবাদিপশুর ব্যাপক ক্ষতি করেছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অনিয়মিত বৃষ্টিপাত ও খরা ভারত-বাংলাদেশের ক্ষতি তীব্র করে তুলছে। আগাম ও মধ্যমৌসুমের বন্যা ভারতীয় বাঁধের উজান ও ভাটির উভয় অঞ্চলে অর্থনৈতিক, অবকাঠামোগত ও কৃষির বিপর্যয় ঘটাচ্ছে। বিহার, আসাম ও বাংলাদেশের জনগণ দুর্ভাগ্যবশত একই বন্যাকেন্দ্রিক মহাদুর্যোগের শিকার।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মানে প্রকৃতি বা প্রাকৃতিক দুর্যোগকে চ্যালেঞ্জ করা নয়; বরং কারিগরি ও কৌশলগত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে দুর্যোগঝুঁকি প্রশমন করা; জান-মালের ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনার আগাম, তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘমেয়াদি সব আয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মানে বানে ভাসিয়ে নেওয়ার পর কিছু অপর্যাপ্ত ত্রাণ ভিক্ষা দেওয়া, পরিস্থিতিতে বাধ্য হয়ে লোকদেখানো কিছু উদ্ধার তৎপরতা দেখানো এবং মিথ্যা বাহাসে লিপ্ত হওয়া। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার এ হীনম্মন্য দর্শনকে পরিবর্তন করা সময়ের দাবি। আমাদের ‘পোস্ট’ থেকে ‘প্রি’ ব্যবস্থাপনায়, অর্থাৎ কৌশলগত ও আগাম বন্যা ব্যবস্থাপনায় যেতে হবে।

প্রতিটি উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য পরিবেশগত সমীক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে, পরিবেশগত সমস্যাকে কার্পেটের নিচে লুকিয়ে ফেলার অভ্যাস পরিত্যাগ করতে হবে। সিলেটের নদীগুলো থেকে পাথর ও বালু উত্তোলন কতটা করা যাবে, তার সিদ্ধান্ত গবেষণানির্ভর করতে হবে। উন্নয়ন প্রকল্পের ভবিষ্যৎমুখী ইনপুট তৈরিতে আমাদের অযোগ্যতার ইতিহাস দীর্ঘ। নাসা আর্থ অবজারভেটরির গঙ্গা ‘ইরোশান ম্যাপ’-এর আদলে প্রতিটি ছোট-বড় নদীর ইরোশান ম্যাপ তৈরি করে নদী অববাহিকাকে উন্মুক্ত রাখতে হবে। স্যাটেলাইট ইমেজ প্রসেসিং পানির প্রবাহ ম্যাপ বানিয়ে তার ভিত্তিতে নদী এলাকায় উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিলে ‘উন্নয়ন সন্ত্রাস’ কমে আসতে পারে।

  • ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব টেকসই উন্নয়নবিষয়ক লেখক। গ্রন্থকার: চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও বাংলাদেশ, বাংলাদেশ: অর্থনীতির ৫০ বছর, অপ্রতিরোধ্য উন্নয়নের অভাবিত কথামালা, উন্নয়ন প্রশ্নে বাংলাদেশের কিছু সংকট ও সম্ভাবনা। faiz.taiyeb@gmail.com